জঙ্গী দমনে সবচে কার্যকরী পন্থা শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠা
একুশে জার্নাল ডটকম
জুলাই ৩০ ২০২১, ১৩:৫৮
আব্দুল্লাহ মায়মূন
গত পর্বের পর থেকে…
নতুন স্থানে আসার পর আমরা আমাদের গোঁফসহ শরীরের বিভিন্ন পশম কাটার প্রয়োজন অনুভব করি। তাদেরকে বলি, তারা যেনো আমাদেরকে এগুলো কাটার ব্যবস্থা করে দেয়। পূর্বের জায়গায় শুধু নখ কাটার জন্যে একটি নেইল কাটার দেয়, এর বেশি কিছু দেয় নি।
যাইহোক, তাদেরকে বলার পর তারা একজন নাপিত নিয়ে আসে, ওই নাপিত বাথরুম আর আমাদের রুমের মধ্যখানের প্যাসেজে আমাদের চুল এবং গোঁফ মেশিন দিয়ে ছোট করে দেয়। আমার চুল সাইজ করে দেয়, তখনো আমার চুল লম্বা ছিলো, বাকীদের সাইজ করে। আর অন্যান্য কাজের জন্যে জনপ্রতি একেকটা ওয়ান টাইম রেজার দেয়।
এসব কাজের জন্যে এভাবে প্রায় মাসখানেক পর নাপিত আসতো এবং রেজার দিত।
এরপর গোসল করতে চাই। কিন্তু গোসল করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা নেই। ওই বাথরুমের মধ্যে ‘দাঁড়িয়ে পেশাবের জায়গাই’ আমাদের গোসলের জায়গা, একটি বালতি দেয়, কিন্তু মগ দেয় নি। তবে গোসলের সাবান দেয় আর কাপড় ধোয়ার পাউডার দেয়। ওই প্রশ্রাবখানাটা একটু ভালো করে ধুয়েই গোসল করতাম, আমরা তাদেরকে বলি তারা যেনো এখানে প্রশ্রাব না করে, তারা অনেকে কথা মানলেও মাঝেমধ্যে অনেকে পেশাব করতো। এতে আমাদের কষ্ট বেড়ে যেতো। কিন্তু কিছুই করার নেই সবর করা ছাড়া।
ওই সময় আমাদের সময় পার হতো এভাবে যে, একজন ল্যাপটপ নিয়ে এসে কিছু জিজ্ঞেস করে করে লিখতো, এতে ঘন্টা দেড় ঘন্টা চলে যেতো। আরেকজন ওই ব্যক্তি যে আমাদের সাথে এসেছিলো। সে সকালে এসে ঘন্টা খানেক বসতো। মাগরিবের পর আরেকবার আসতো আর মাঝেমধ্যে দুপুরের পর আসতো। বাকী সময় তেলাওয়াত, যিকর, ঘুম, খাওয়া এবং নামাযে চলে যেতো। বাদ ফজর আমি সকালের তেইশটি দুআ ও যিকর পুরোপুরি আদায় করতাম, বাদ আছরও এভাবে আদায় করতাম। এতে করে আমার সকালে এক ঘন্টা আর বিকালে এক ঘন্টা চলে যেতো। আর ওদের সাথে আলাপ করে যেতো আরো ২-৩ ঘন্টা। বাকি সময় তেলাওয়াত, খাবার, নামায এবং ঘুমে চলে যেতো। তখন আমার তেলাওয়াতের মাত্রা বেড়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় বিশ পারা করে হত। আব্দুর রহীম রুমটির অপরপাশে থাকায় তার সাথে কথা হত না। মাঝেমধ্যে কথা বলতে চাইলে উচ্চস্বরে বলা লাগতো বিধায় খুব কম কথা হত। তো আমাদের সাথে আসা ব্যক্তিটি আমার সাথেই বেশি কথা বলতো। আব্দুর রহীমের সাথে তেমন কথা বলতো না। সে সকালে-বিকালে আমার সাথে ঘন ঘন কথা বলায় আমি তার সাথে অনেকটা খোলামেলা হয়ে যাই। তাকে বলি, ‘আমার লম্বা চুলের জন্যে তেল প্রয়োজন, বিকালে নাস্তার জন্যে বিস্কুট হলে ভালো’। পুরাতন জায়গায় চুলের তেল আর নাস্তার ব্যবস্থা থাকলেও এখানে সে রকম ব্যবস্থা নেই। তাই আমি তাকে বললাম, এগুলোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে। তখন কিছু ব্যবস্থা হয়। পরে আবার ফুরিয়ে যায়। তখন তাকে আবার বলি, তখন সে আমার চুলের জন্যে ২৫০গ্রাম অলিভওয়েল, নাস্তার জন্যে এক কার্টন বিস্কুট এবং এক কেজি খেজুর নিয়ে আসে। কয়েকদিন এভাবেই চলে।
দীর্ঘদিন তার সাথে আলাপ করায় সে একথা বুঝতে সক্ষম যে, আমি একজন লেখক, পাঠক এবং (স্বঘোষিত!) গবেষক। মাদরাসার নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরেও আমার যথেষ্ট পড়ালেখা আছে। তাই সে বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে। আমার মতামত জানার চেষ্টা করে। সব আলোচনা তো তুলে ধরা যাবে না। কিছু কথোপকথন তুলে ধরছি।
একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি তো অনেক পড়ালেখা করো। বলো তো, বাংলাদেশে জঙ্গি দমনের সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা কী?
– বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনের সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হচ্ছে দেশে শরীয়াহ শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন করা। কারণ জঙ্গিরা শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার দাবি দেখিয়ে মানুষকে তাদের দলে টানে। তাই দেশে যদি শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে জঙ্গিরা দলে টানার কোনো যৌক্তিক দাবি খুঁজে পাবে না। এতে জঙ্গিবাদ দমন হয়ে যাবে। নতুবা একেক সময় জঙ্গিদের একেক নতুন দল বেড়ে উঠবে। এক সময় ছিলো হুজি। পরে আসলো জেএমবি। এরপরে আসলো আইএস আর এখন আছে আনসার আল-ইসলাম। সরকার যদি মূল জায়গায় পরিবর্তন না করে অন্যান্য উপায়ে জঙ্গি দমন করতে চায়, তাহলে এভাবে একের পর এক নতুন দল বেড়ে উঠবে আর একটির শূন্যতা অন্যটি পূরণ করবে।
– আর কোনো উপায় নেই?
– না, আর কোনো উপায় নেই। তবে সরকার যদি জুলুম-নির্যাতন কমিয়ে দেয় তাহলে হয়তো জঙ্গিবাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হবে, কিন্তু নির্মূল হবে না। এ সরকার হচ্ছে একটি জালিম সরকার, তাই মানুষ সরকারের এ জুলুম থেকে বাঁচার জন্যে শরীয়াহ শাসনের দিকেই ধাবিত হবে।’
আরেকদিন সে জিজ্ঞেস করে, তোমার যদি একটি সন্তান হয়, তাহলে তুমি তাকে কী বানাবে?
– আলিম বানাবো?
– দু’টি হলে?
– দুটোকেই আলেম বানাবো।
– তিনটি হলে?
– আলেম বানাবো!
– (অনেকটা হতাশ হয়ে) যদি দশটি হয়?
– (আমি ভরাট গলায়) দশটি কেনো, একশোটি হলেও আলেম বানাবো!
– তুমি কি চাও না তোমার একটি ছেলে ভালোভাবে সম্পদ উপার্জন করুক?
– রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। এটার জন্যে এত টেনশান করার দরকার নেই। আমরা ভাই-বোন সাত জন, সবাই আলেম-আলেমা, আমাদের তো রিযিকের জন্যে অভাব হয়নি। আমাদের সন্তানদের কেনো হবে? দুনিয়া উপার্জনের চেয়ে ঈমানের হেফাজত বেশি জরুরী।
এরপরে তাকে আমি একটি ঘটনা বলি। ‘আমি খুব ছোট ছিলাম, তখন বয়স কত আর হবে? ৮/৯ বছর। তখন আমাদের বাড়ীতে কিছু মেহমান আসেন। বাড়ীতে তখন আমার আব্বাও ছিলেন, আব্বা তখন ওই পুরুষ মেহমানের সাথে আলাপ করেন। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেন,
– আপনার তো চার ছেলে, আপনি এসব ছেলেদের কোন লাইনে পড়াবেন?
– আব্বা জবাব দেন, আমি আমার সব ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবো, আলেম বানাবো।
– মা-বাবাকে মাছ-ভাত খাওয়ানোর জন্যে কাউকে রাখবেন না?
– তাদের রিযিক আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে, আমি সবাইকে মাদরাসায় পড়াবো।’
ঘটনা এখানেই শেষ। আমার আব্বা এ কথাগুলো তখন বলেছিলেন, যখন তিনি দেশে একটি মাদরাসার শায়খুল হাদীস পদে ছিলেন, স্বল্পবেতন, তাও আবার বাকি ইত্যাদি কারণে আমাদের পরিবার অনেক টানাটানি করে চলতো। প্রতি মাসে আব্বাকে সন্তান-পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে ঋণ করতে হতো। আল্লাহ তা’আলা এক সময় এই অবস্থা থেকে আমাদেরকে উত্তরণ করেন। আব্বা এক সময় একটি দ্বীনী মাদরাসায় শায়খুল হাদীস পদে আমন্ত্রণ পেয়ে ইংল্যান্ড চলে যান। এক সময় আমাদের আম্মা, দুই ভাই ও দুই বোনকেও লন্ডন নিয়ে যান। আঠারোর উপর বয়স হওয়ায় দেশে আমি, আমার বড় ভাই এবং বড় বোন মিলে তিনজন থাকি। আমার আব্বা ইংল্যান্ড চলে গেলেও আমাদের সাত ভাই-বোনের কাউকেই মাদরাসা ছেড়ে অন্য লাইনে পড়তে দেন নি। একপর্যায়ে আমাদের সাত ভাই-বোনের সবাই আলেম-আলেমায় পরিণত হন। এখন আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দাদা-নানার দিকে কেউই আমাদের মতো দ্বীনি-দুনিয়াবি দিক থেকে সুখ-শান্তি ও সম্মানে নেই। তাদের অনেকেই নিজে আলেম হওয়া সত্ত্বেও সন্তানকে দুনিয়া কামানোর জন্যে দুনিয়াবি লাইনে পড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু শান্তি ও সুখ এভাবে পান নি। দেখা গেছে, ব্যাংকে ভালো চাকুরী পেয়ে ছেলে তার আলেম বাবাকে ভুলে গেছে। এটা আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। এজন্যে তাঁর শোকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না। লাকাল হামদ ইয়া রাব্ব! এসব কিছুর পিছনে রয়েছে আব্বার অল্পতুষ্টি, ধৈর্য এবং দৃঢ়তা।
আমি যখন তাকে পুরো ঘটনা এভাবে বলছিলাম, তখন সে তন্ময় হয়ে আমার কথাগুলো শুনছিলো। এরপরে সে আর কখনো এভাবে বলে নি। সে আমার কাছে খুব ঘন ঘন আসতো। আমাকে কোনো সময় ভাই আর কোনো সময়ে বন্ধু বলে সম্বোধন করতো। আমি বুঝতাম এগুলো তার অভিনয়। আমিও পাল্টা অভিনয় করে তাকে পাম্প দিতাম। সে একেক সময় একেক বিষয়ে আলাপ তুলতো। কখনো আমার পরিবারের কাহিনী শোনার কথা বলতো। আমার নানাবাড়ীর গল্প শোনার কথা বলতো। আবার কখনো নবীদের কাহিনী শোনার কথা বলতো। তার আসা-যাওয়া গল্প ছিলো আমার সাথে। অপরপাশে যে আব্দুর রহীম ছিলো তার সাথে তেমন গল্প করতো না। সে গল্প শোনার সময় আমার সামনে মোবাইল টিপতো। আমি প্রথমে মনে করতাম যে, সে এমনিতেই মোবাইল টিপতেছে। পরে অনেক দিন পরে বুঝলাম। সে আমার কথা রেকর্ড করতো। আমি যাতে বুঝতে না পারি, এজন্যে সে মোবাইল টিপার ভান ধরতো। পরে রেকর্ডকৃত কথাগুলো আবার শুনে পরদিন বিভিন্ন প্রশ্ন করতো। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আপনি কেনো আমার কাছে এত ঘন ঘন আসেন? তখন জবাব দেয়, তুমি একা থাকলে একাকীত্ব তোমার মাথায় সমস্যা করতে পারে। এজন্যে আমি এসে গল্প করি, যাতে তোমরা টেনশন না করো।
আমি কথাগুলো শুনে মুচকি হাসি আর মনে মনে বলি, তোমার সব চিন্তা শুধু আমাকে নিয়ে। অপরপাশে যে আব্দুর রহীম একা একা সময় পার করছে তার কাছে তো আসা-যাওয়া করো না। তার সাথে গল্প করতেও দেখি না৷ এটা ছিল তার একটি মিথ্যা কথা। সে এগুলো বলে আমাকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করি। তো সে এবং তাদের বিভিন্ন নেতা আমার সাথে এভাবে এসে আমার সাথে বিভিন্ন কথা বলতো, এ সব ক্ষেত্রে আমি অত্যন্ত ধীর-স্থিরে বুঝে শুনে উত্তর দিতাম, যেহেতু একই প্রশ্ন বার বার করতো এ জন্যে যাতে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য না হয় এগুলো লক্ষ্য রাখতাম। অধিকাংশ সময় হাসিমাখা মুখে উত্তর দিতাম। তাদের কাছে আমার অনেক উত্তর যুক্তিপূর্ণ মনে হতো। তখন তারা অনেক সময় হাসতে হাসতে বলতো, হুজুর আপনি এত সুন্দর করে উত্তর দেন কীভাবে?
আমিও তখন এর জবাবে পাল্টা হাসি দিয়ে বলতাম, আপনাদের এই সৌহার্দ্যপূর্ণ আতিথেয়তা আমাকে এই উত্তর দিতে শিখিয়ে দেয়। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা যুক্তিতর্কের কোনো ক্ষেত্রে আমাকে আটকাতে পারে নি। একদিন সে বলে, সরকারী চাকুরী সম্পর্কে তুমি কী বলো?
আমি বলি, সব সরকারী চাকুরীর সমান হুকুম নয়। যারা শিক্ষকতা, বিদ্যুৎ বিভাগ, জনকল্যাণ বিভাগে চাকুরী করে এটা সরাসরি হারাম হবে না। তবে ওখানে যদি হারাম কারণ পাওয়া যায়, যেমন- বেপর্দা নারীর সাথে সাক্ষাৎ, সুদ ও ঘুষের লেন-দেন তখন এটা হারাম হবে। কিন্তু কিছু বিভাগ আছে এগুলো মৌলিকভাবেই হারাম, যেমন- বিচার বিভাগ। কেননা এখানে আল্লাহর আইনে বিচার হয় না, বিচার হয় মানবরচিত কুফরী আইনে, যদি আল্লাহর আইনে বিচার করা হয় তাহলে দেশীয় আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে, তাই এটা কোনোভাবেই হালাল নয়, এটাকে হালাল করতে হলে অবশ্যই আল্লাহর আইনে বিচার করতে হবে।
এমনিভাবে প্রশাসন বিভাগ, তথা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী। এগুলোও হারাম। যদিও এটা বিচারবিভাগের মতো হারাম নয়। কেননা এরা আল্লাহর বিরুদ্ধে আইন বানায় না। বরং তারা কুফরি আইনের পাহারাদার। তাছাড়া জালিমের সহায়ক, নিজেও জালিম। তারা সামান্য প্রমোশনের জন্যে নিরপরাধ কাউকে খুন করতে, কাউকে মিথ্যা মামলা দিতে সামান্য পরিমাণ দ্বিধা করে না। তারা চাকুরী রক্ষার জন্যে পতিতালয় আর মদের বার পাহারা দিতে বাধ্য। তাই এগুলো জায়েয হতে পারে না। কারণ হাদীসে এসেছে- لا طاعة المخلوق في معصية الخالق! (স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য জায়েয নেই।)
তাছাড়া ফেকহি মূলনীতি হচ্ছে- الاضطرار لا يبطل حق الغير. (অপরাগতা অন্যের অধিকার হরণ করার বৈধতা দেয় না!)। তবে হ্যাঁ, যদি তারা জুলুম কম করে তখন হয়তো আল্লাহ তা’আলা শাস্তি কম দিবেন। যেভাবে আবু তালিব কাফির হওয়া সত্ত্বেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার কারণে জাহান্নামে তাকে সর্বনিম্ন শাস্তি দেওয়া হবে।
আমার এ উত্তরগুলো শুনে তারা বিমর্ষ হয়ে যেতো। একদিন একজন বলে, তুমি কি জানো? বর্তমানে যারা এসব দায়িত্বে আছে তারা যদি এ দায়িত্ব না নিতো, তাহলে এরচেয়ে খারাপ লোকেরা এসব দায়িত্ব নিত। এর দ্বারা জনগণের উপর দুর্ভোগ আরো বেড়ে যেতো। তখন আমি জবাবে বলি, আপনার এ কথা হচ্ছে ওই রকম যে, একজন নামাযি দাড়িওয়ালা ব্যক্তি রাস্তার মধ্যে একটি মদের বোতল পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পেলো। তখন সে বললো, আমি যদি এ মদ পান না করি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ লোক এ মদ পান করবে। এই যুক্তি দেখিয়ে সে মদ পান শুরু করলো। তখন কি তার এই যুক্তি দ্বারা মদ পান হালাল হয়ে যাবে?
এ কথা শুনে সে নীরব হয়ে যায়।
একদিন একজন জিজ্ঞেস করে, বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তুমি কী বলো?
আমি জবাব দেই, যে ব্যক্তি মনে প্রাণে সানন্দে কোনো ধরনের অজ্ঞতা, বাধ্যবাধকতা এবং অপারগতা ছাড়া এ সংবিধানের উপর আস্থা স্থাপন করবে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি হচ্ছে চারটি। ১- গণতন্ত্র, ২- জাতীয়তাবাদ, ৩- সমাজতন্ত্র এবং ৪- ধর্মনিরপেক্ষতা।
এই চারটাই হচ্ছে সংবিধানের অপরিবর্তনযোগ্য মূলনীতি। এগুলো হচ্ছে সরাসরি ইসলামবিরোধী কুফরি জীবনব্যবস্থা। তাই এগুলোর উপর বিশ্বাস করা মানে ইসলামি জীবনব্যবস্থা ত্যাগ করে কুফরি আদর্শ গ্রহণ করা। এক সাথে যেভাবে হিন্দু ও মুসলমান হওয়া যায় না, এমনিভাবে এক সাথে এ সব জীবনব্যবস্থা আর ইসলামি জীবন এক হতে পারে না।
আমার উত্তরগুলো ছিলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট, কাটা কাটা; আমি যে আবার বেঁচে আসবো এর কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। তাই ভাবলাম, যা বলবো আল্লাহর জন্যে বলবো, এতে যদি আমি মারাও যাই তাহলে হয়তো আমার এ কথাগুলো একদিন তাদের অন্তরে নাড়া দিবে। তাই মরার আগে সত্য কথাই বলে যাই।
এসব প্রশ্ন যে একজন করতো তা নয়, বরং অনেকেই করতো। সবাইকে আমি একই উত্তর দিতাম। আমি যে এগুলো শুধু মুখে বলেছি এরকম নয়, বরং তাদের চাওয়া মতো লিখেও দিয়েছি।
একদিন বাদ মাগরিব ওই ব্যক্তি আসলো, অনেকক্ষণ আলাপ হলো, একপর্যায়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বিষয়টি অনুভব করলো। সে কারণ জিজ্ঞেস করলো। আমি প্রথমে জবাব দিতে চাই নি। তার পীড়াপীড়িতে উত্তর দিই। তখন বললাম, নুসরাতের কথা স্মরণ হচ্ছে, তাকে রাস্তায় রেখে এসেছি না জানি তার কী হলো? তাছাড়া আপনাদের কথার উপর আস্থা রাখা যায় না। একেক সময় একেক কথা বলেন। আপনারা বললেন, ড্রাইভারকে ছেড়ে দিবেন, নুসরাতের মোবাইল পৌঁছে দিবেন। কই এ দুইটার কোনো কথাই পূরণ করেন নি। আমার চোখের সামনে যে দু’টি আছে এগুলো পূরণ করেন নি। আমার চোখের আড়ালে যা আছে তা পূরণ করেছেন এটা বুঝবো কীভাবে?
তখন সে কিছুটা কোমল হয়, মোবাইল দিয়ে একটি নিউজ পোর্টালের মধ্যাংশ দেখায়, ‘যার মধ্যে আছে নুসরাতকে এলাকার চেয়ারম্যান নিরাপত্তা দিয়েছে। স্থানীয় পুলিশও এসেছে!’ এরবেশি শুরু শেষ অংশের কিছুই দেখায় নি। এতে আমার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়, পুলিশ এসেছে! তার মানে কি তাকে থানায় নিয়ে গেছে? থানায় নিলে তাকে ছেড়ে দিয়েছে? নাকি হয়রানি করেছে?
সে আমাকে বুঝাতে থাকে কোনো হয়রানি ছাড়া তাকে ছেড়ে দিয়েছে। তখন তাকে বলি, তাহলে পুরো নিউজ পড়তে দেন না কেনো? এভাবে কয়েকটি পয়েন্টে প্রশ্ন করার পর সে কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে উঠে চলে যায়।
আরেক দিন এসে সে বলে, আমার পরিবার কোর্টে মামলা করেছে, বিস্তারিত কিছু জানায় নি।
আরেকদিন আমাকে আমার একটি ছবি দেখায়, যেটিতে আমার মাথায় সাদা পাগড়ী আর পরনে কালো জুব্বা ছিলো।’ এরকম আরো কিছু ছবি দেখায়, তখন আমি ধারণা করে নিই, নিশ্চয় আমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লেখালেখি হয়েছে। নতুবা এত দিন পর এ ছবিগুলো পেলো কীভাবে?
একদিন রাত প্রায় সাড়ে বারটার সময়, মাথায় খুব বেশি তেল দিয়েছি। লম্বা চুল আঁচড়িয়ে শুতে যাবো। এমন সময় হঠাৎ করে কয়েকজন লোক এসে আমাকে দু’তলায় তাদের নেতার রুমে নিয়ে গেলো। গিয়ে দেখি আরেক পাতি নেতা তার পাশেই বসা আছে। আর এদিকে টুপি ছাড়া প্রচুর তেল দিয়ে আঁচড়ানো আমার লম্বা চুল, গায়ে শুধু হাফ হাতা একটি গেঞ্জি। আমাকে একটি জ্বল জ্বল লাইটের নিচে বসতে বললো, আমি বসি। তখন আমার লম্বা পরিপাটি তৈলযুক্ত চুলের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে ওই নেতা বললো, কী সুন্দর চুল, একটুকুও পাকে নি!(আসলে আমার পনের/বিশটা চুল সাদা ছিলো, কিন্তু চুলে প্রচুর তেল দেওয়ায় তা দৃশ্যমান হয় নি)
পরে বললো, তোমার বয়েস কত?
আমি বললাম, একত্রিশ।
তখন সে তার পাশের পাতি নেতাকে উদ্দেশ্য করে বললো, দেখছো? সে এই অল্প বয়েসে (দ্বীনের) কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে? আর আমরা কী করতেছি? এ সব ভালো ভালো মানুষের পিছনে ছুটে আছি!
তার কথার ভাব-ধরন দেখে মনে হলো, সে আমাদের উপর জুলুম করার কারণে মনে শান্তি পাচ্ছে না। দুনিয়াতে জালিমদের উপর আল্লাহর অন্যতম শাস্তি হচ্ছে তাদের মনের অশান্তি।
একদিন এক পাতি নেতা এসে বললো, তার বিয়ের পাঁচ বছর হয়েছে, অথচ তার কোনো সন্তান হয় নি। একবার নাকি যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি যেনো তার সন্তান হওয়ার জন্যে দুআ করি। তখন আমি বলি: দুআ করবো, তবে শর্ত হচ্ছে আপনার সন্তানকে মাদরাসায় পড়াতে হবে। তখন সে হকচকিয়ে উঠে এবং বলে, আলেম হয়তো নাও বানাতে পারি, তবে কথা দিচ্ছি আমি তাকে অবশ্যই ইসলামি শিক্ষা দিব।’ অনেকদিন পরে জানতে পারি তার নাকি একটি ছেলে হয়েছে। সে আল কায়েদার প্রধান শায়খ আইমান আজ-জাওয়াহিরির অনেক ভক্ত, উনার কথাবার্তা এবং কর্মকৌশল নাকি তার অনেক ভালো লাগে। উনার নামেই তার ছেলের নাম রাখে ‘আইমান’!
কী পাঠক? শক খাইলেন নাকি? হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা। একজন মানুষ যখন সৎ আদর্শবান হয় তখন শত্রুও তার প্রশংসা করে।
একদিন তারা বলে আজ ২৬ শে মার্চ, অর্থাৎ আমরা গুম হওয়ার আজ একুশ দিন। ওইদিন তাদের জন্যে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বড় খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদেরকেও এ খাবার দেওয়া হবে, কারণ আমরা তাদের মেহমান! কী বিচিত্র মেহমান! তো রাতে বড় খাবার এলো। এক টুকরো মুরগীর রোষ্ট, দু চার পিছ গরুর ভূনা গোস্ত আর ৩০০ গ্রাম পোলাও।
তখন এত ভালো খাবার খেতে চাইলেও খেতে পারি নি। দীর্ঘদিন হাটা-চলা না থাকায়, সূর্যের আলো গায়ে না লাগায় অনুভব করি পেটে কিছুটা জ্বালা-পোড়া শুরু হয়েছে, হজম শক্তি কমে যাচ্ছে। এজন্যে কিছু খেয়ে বাকিগুলো ফেলে দিই।
এভাবেই নতুন জায়গায় প্রায় দশ দিন চলে যায়। তখন আমাদের সাথে আসা ওই পাতি নেতা চলে যায় এবং এর বদলে আরেকজন আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
মিহনা’র অন্যান্য পর্বের লিঙ্ক নিচে দেয়া হল—
- মিহনা: গুম জেল রিমান্ডের ৬৪১ দিন
- ড্রাইভারকেও অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ওরা আসে আমার স্ত্রীর কাছে
- চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ওরা আমাকে গাড়ির ফ্লোরে শুইয়ে রাখে
- আলো বাতাসহীন অন্ধকার রুমে
- ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে যাওয়া, মুক্তিপণ চেয়ে ফোন কল
- ওরা আমাকে যেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে
- লন্ডনী কন্যা, পুলিশ ও এক অদ্ভুত কাহিনী
- নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর, আশা উৎকণ্ঠার দীর্ঘ রাত