আলো বাতাসহীন অন্ধকার রুমে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২৫ ২০২১, ১৩:৫১

আব্দুল্লাহ মায়মুন


গত পর্বের পর থেকে…

যাক, ওই দলনেতা যাওয়ার পর আরো দু’জন আসলো তারা এসে আমাদের পকেট এবং হাতে যা ছিলো তা নিয়ে নিলো। আমার কাছে তখন ছিলো প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা, টাকার ওয়ালেট, বিয়েতে শ্বশুরবাড়ীর পক্ষ থেকে পাওয়া ঘড়ি, ব্যাংকের এটিএম কার্ড। গায়ে পরা বিয়ের ফুলহাতা কোট। আর আব্দুর রহিমের ছিলো ছয়/সাত’শ টাকা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং এন আইডি কার্ড, সব নিয়ে নিলো। শুধু গায়ে পরার বিয়ের কোট পেয়েছিলাম, আর কিছুই ফেরত পাই নি। আজপর্যন্ত ফেরত পাই নি। আর বিয়েতে পাওয়া আংটিটি কোথায় হারিয়েছি তাও বলতে পারি না।

যাক, এভাবে জোহরের সময় হলো, দুপুরের খাবার নিয়ে আসা হলো, আশপাশের কোনো রেষ্টুরেন্টের খাবার মনে হলো, কী খেয়েছিলাম মনে নেই। তবে খাবারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কষ্ট দেয় নি। সকালে খাবারের মেনু ছিলো একটি ডিম ভাজি, ডাল-ভাজি এবং দু’টো পরটা, দুপুরের ছিলো ভাত সাথে মাছ বা গোস্তের তরকারি এবং ডাল। আর রাতে ছিলো ভাতের সাথে সব্জি এবং ডাল।

মাঝেমধ্যে আছরের পর নাস্তা দিত এবং চা-কফি খাওয়াত।

জোহর-খাবারের পর বিশ্রামের সুযোগ দেয়, আর আব্দুর রহীম ঘুমিয়ে যায়। এটা টেনশনের ঘুম, সময়মত আসে না, অসময়ে ডিস্টার্ব করে। আল্লাহর ইচ্ছায় তখনো আমার মনে উল্লেখ করার মতো টেনশন আর পেরেশারী ছিলো না। যদিও নুসরাতের কথা বার বার স্মরণ হত, কিন্তু এটা বেশি পেইন দিতে শুরু করে নি।

আমিও কিছু সময় শুয়ে রইলাম। তাদেরকে বলেছিলাম, আমাকে যেনো দীনী কোনো পুস্তক এবং কুরআন শরীফ দেয়। তারা আমাকে একটি কুরআন শরীফ দেয়। প্রথমদিন কোনো তেলাওয়াত হয়নি, কারণ ওইদিন তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চলে যায়। আছরের পর তাদের এক দলনেতা আসলো। সে এসে বললো, আমার ওয়াইফ নিরাপদে বাড়ীতে পৌঁছেছে। সাথে আমার শ্বশুরও ছিলেন। সে আর‌ও জানায় যে, নুসরাতের কাছে পনের শত টাকা পাওয়া গিয়েছে। তখন আমার টেনশান বাড়া শুরু করে। কারণ তারা রাতে বললো, নুসরাত বাড়ীতে পৌঁছে গেছে। এখন আবার বলছে, সে বাড়ীতে পৌঁছেছে। তাহলে আগের বাড়ীতে পৌঁছে যাওয়া এবং বর্তমান বাড়ীতে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য কী? এদিকে তারা বলছে তারা ভ্যানেটি ব্যাগে পনের শত টাকা পেয়েছে, এর অর্থ কী? আমি তখনো জানতাম না যে, ভ্যানেটি ব্যাগ তারা নিয়ে এসেছে। তারা আমাকে এটা বুঝতেও দেয়নি যে, তারা ভ্যানেটি ব্যাগ নিয়ে এসেছে। তাহলে ভ্যানিটি ব্যাগ পেলো কোথায়? কারা পেলো? তাহলে কি নুসরাতকে স্থানীয় থানায় নিয়ে গিয়েছিল? তাদের একেক সময় একেক কথায় আমার টেনশন বাড়তে শুরু করলো। তাছাড়া গাড়ীতে তাদের কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছিলাম। একটি নুসরাতকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া। বাকী দুইটার প্রথমটা তার মোবাইল পৌঁছে দেওয়া এবং ড্রাইভার আব্দুর রহীমকে ছেড়ে দেওয়া। আমার সামনে যে, দুইটা আছে এগুলো তারা পূরণ করেনি, তাহলে আড়ালেরটা কতটুকু কীভাবে কী করেছে কে জানে?

আমাকে যে বিষয়টি বার বার অবাক করছিলো তা হলো যে, তারা আমাকে এখন পর্যন্ত কোনো শারীরিক নির্যাতন করে নি। আমার প্রতি তাদের ব্যবহারও ছিলো অত্যন্ত চমৎকার। গাড়ীতে দুই/একবার তুই বলেছিলো, এরপরে আর তুই বলেনি। শুধু তুমি, আপনি আর কখনো কখনো ভাই বা বন্ধু বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু এতকিছুর পরও আমার মনের আশঙ্কা থেকেই গেলো। মনে হত ঘুমের মধ্যে এসে হয়তো নির্যাতন শুরু করে দিবে। একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ‘আপনারা কি আমাকে মারবেন? আমার ধারণা ছিলো যে, আপনারা আমাকে অনেক শারীরিক নির্যাতন করবেন। কই, কিছুই তো করতেছেন না’!

তখন তারা এর জবাবে একেক সময় একেক উত্তর দিত। কোনো সময় বলতো যে, আমাকে দেখে তাদের মায়া লাগে। আমার কথা তাদের ভালো লাগে, এজন্যে মারামারি করবে না। কোনো সময় বলতো তারা মারামারি করে না। কোনো সময় বলতো তারা আলেমদেরকে নির্যাতন করে না ইত্যাদি। তাদের উত্তর ছিলো রহস্যে পরিপূর্ণ। তাই আমি তাদের কোনো কথাতেই আস্থাশীল হতে পারি নি। এভাবে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। আব্দুর রহীম ঘুম থেকে উঠলো। যেহেতু জিজ্ঞাসাবাদ তাকে করছে না, শুধু আমাকেই করছে, তাই সে নীরব বসে থাকতো আর টেনশন করতো। হঠাৎ এক সময় দেখি তার হেচকি উঠে গেছে, প্রচন্ড হেচকি, মনে হয় কিছু একটা হয়ে যাবে, তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে এর কারণ কী? আমিও কোনো সদুত্তর দিতে পারি নি, কারণ তার সাথে আমার এই প্রথম সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাতেই রচিত হলো তার আর আমার এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। কিছুক্ষণ পর সে বিভিন্ন আশ্বাসবাণী শুনে সুস্থ হয়। তারা তাকে কালই ছেড়ে দিবে ইত্যাদি। আব্দুর রহীম যখন সুস্থ হয় তখন অসুস্থতার কারণ জানার চেষ্টা করি, প্রথমে উত্তর দিতে চায় নি। অনেকক্ষণ জিজ্ঞেস করার পর উত্তরে সে বলে, সে তার মাথায় দুইবার মারাত্মকভাবে আঘাত পায়। এরপর থেকে অত্যধিক টেনশনে এরকম অবস্থা হয়। কোনো কোনো সময় সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে সুস্থ করা লাগে। বর্তমানে তার টেনশানের কারণ তার আট মাসের শিশুকন্যা এবং গাড়ী। গাড়ীটি তার নিজস্ব নয়, অন্যের গাড়ী, সে ভাড়ায় চালায়।

প্রথম দিন এভাবেই রাত ১২টা বেজে যায়। এরপর শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর‌ই আবার রাত দুইটায় জাগিয়ে দেয়। ঘন্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদের পর আবার শুয়ে পড়ি। এভাবে ফজরের নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়ি। সকাল নয়টার দিকে নাস্তা করি।

আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সেদিন থেকে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তেলাওয়াত করতে থাকি। পুরো দিনে প্রায় ছয় পারা তেলাওয়াত হয়। আমার চুল তখন লম্বা ছিলো। আমি তাদেরকে বলি তেলের ব্যবস্থা করে দিতে। তারা জানতে চায়, কোনো ধরনের তেল? আমি বলি, অলিভওয়েল। তারা দেড়’শ গ্রাম টিনের কৌটার অলিভওয়েলের ব্যবস্থা করে দেয়। একটা চিরুনীর ব্যবস্থা করে দেয়। তাছাড়া আমার জন্যে একটি পাঞ্জাবি এবং আব্দুর রহীমের জন্যে গেঞ্জি, আমাদের দুজনের জন্যে একটা করে লুঙ্গি এবং টুথপেস্ট ও টুথব্রাশ এনে দেয়।

আমাদের যখন বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হত তখন আমাদের চোখ বেঁধে ফেলা হতোষ। তারপর একটি রুম পাড়ি দিয়ে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার পর চোখ খুলে দেওয়া হত। সেখানে বাথরুমের দরজার লক লাগাতে দিত না। তবে দরোজা চাপিয়ে দিতাম। বাথরুমে থাকাবস্থায় সব সময় একজন পাহারাদার থাকতো। বাথরুম শেষ হলে সে নিয়ে আসতো। তখন আবার চোখ বেঁধে আমাদের নির্ধারিত রুমে নিয়ে আসতো। নামাযের সময় হলে তারাই জানিয়ে দিত, কারণ আমরা ভেতর থেকে কোনো ধরনের আওয়াজ শুনতাম না। বাহিরের আলো-বাতাস ঢুকার কোনো রাস্তাই ছিলো না এই রুমে।

মিহনা’র গত পর্বগুলো—

প্রথম পর্ব 

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব