ধর্ম বনাম সংস্কৃতি! মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ১৩ ২০২৪, ১৯:১৬

কাজী শহিদুল্লাহ ওয়াহেদ: বর্ষবরণের একটি অনুষ্ঠান হিসেবে ইদানিং শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা বর্ষরণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বিশাল আকারের রাজ-রানীর পুতুল ও পেঁচাসহ নানা ধরনের পশু-পাখির মূর্তি। এসব মূর্তীকে সাথে নিয়ে বাদ্যের তালে তালে এগিয়ে যায় শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের অনেকেই পরে নানা ধরণের মুখোশ।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও নানা পেশার ও বয়সের লোক যোগ দিয়ে থাকেন। পয়লা বৈশাখে কেবল ঢাকায় নয়,মফস্বলের কোনো কোনো শহরেও এ শোভাযাত্রা চালু হয়েছে এবং ক্রমে তা চারদিকে বিস্তার লাভ করছে। বলা হয়, সারা বছর সবাই যাতে নিরাপদে খাকে সেটাই হচ্ছে এ শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়ার মালিক কে? যদি এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিরাপত্তা চাওয়া হয় তবে কার কাছে এ কামনা প্রার্থনা? মুসলমানের তো আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে এ প্রার্থনা করার অবকাশ নেই, আর যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না বা বস্তুবাদী, নাস্তিক,তাদের তো এমন কেউ নেই যার কাছে তারা প্রার্থনা করতে পারে।

বৈশাখ নামটি এসেছে ‘বিশাখা’ নক্ষত্রের নাম থেকে। এই মাসে বিশাখা নক্ষত্রটি সূর্য্যের কাছাকাছি হয়। নববর্ষের দিন রবীন্দ্রনাথ যখন ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে ডাকেন, তখন তিনি নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই বৈশাখের কাছে প্রার্থনা করেন। তাঁর বৈশাখী গানে বলা হয়েছে ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। কোন প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তি কি বিশ্বাস করতে পারেন যে, আগুনে স্নান বা গোসল করলে তথা দাহ করলে কেউ পবিত্র হয়ে যান? হ্যাঁ, হিন্দু ধর্মের ভাই-বোনেরা মনে করেন তাদের মৃতকে আগুনে পুড়িয়ে পবিত্র করা হয়। তারপর তারা স্বর্গবাসী হন। কিন্তু কোন মুসলিমের জন্য এরূপ বিশ্বাসের কোন সুযোগ নেই। কেননা ইসলাম আমাদের ‘শুচি’ হ’তে শিখিয়েছে ওযূ-গোসলের মাধ্যমে, আগুনে পুড়ে নয়।

আজ মঙ্গল শোভাযাত্রা, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন ও মঙ্গলসঙ্গীত ইত্যাদি হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মাচারকে তথাকথিত হাযার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি ও সার্বজনীনতার মিথ্যা দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ তৌহিদী জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপক অপচেষ্টা চলছে। যা ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অংশ মাত্র। আমরা এগুলি থেকে জাতিকে সাবধান করছি।

বলা হয়ে থাকে, এগুলি নাকি ‘হাজার বছরের সার্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতি’। হাজার বছর বলতে হাজার হাজার বছর বুঝানো হয়। দুনিয়া এত এগিয়ে গেলেও এত পুরানো জিনিস কেন আমরা আঁকড়ে আছি? যাতে স্রেফ ধারণা-কল্পনা ও অপচয় ছাড়া কিছুই নেই। অথচ ইসলাম মাত্র চৌদ্দশ’ বছর আগে এসেছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস, সেটা মানতে আপত্তি কেন? আর ‘সার্বজনীন’ অর্থ কি? এটা কি তাহ’লে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবারই সংস্কৃতি? অথচ আমরা জানি হিন্দুদের প্রধান চারটি দলের মধ্যে পরস্পরে হিংসার কারণে তাদের পৃথক পৃথক মন্দির রয়েছে। সেখানে অন্যেরা প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু যেসব মন্দিরে সব মত ও পথের হিন্দুরা পূজা দিতে পারে, সেগুলিকে বলা হয় ‘সার্বজনীন মন্দির’। অতএব ‘সার্বজনীন’ শব্দটি যেখানে হিন্দুদের কাছেই সার্বজনীন নয়, সেটাকে বাঙালীর হাযার বছরের সংস্কৃতি বলা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে হিন্দুদের মূর্তি ও মুখোশ মিছিল এবং অনুষ্ঠান সমূহকে ‘সার্বজনীন’ বলে মুসলমানদের মানতে বাধ্য করা কেমন ধরনের প্রগতিশীলতা?

বলা হচ্ছে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। তাহ’লে কি মুসলমানরা গিয়ে হিন্দুদের ‘দুর্গা পূজা’র উৎসবে যোগ দিবে? অন্যদিকে হিন্দুরা এসে কি ‘ঈদুল আযহা’র গরু কুরবানীর উৎসবে অংশগ্রহণ করবে? হাতির বাইরের দু’টি দাঁত থাকে। আর ভিতরে থাকে আসল দাঁত। যা দিয়ে সে চিবিয়ে খায়। এইসব উৎসববাদীরা আসলেই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী কি-না, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। যারা সংস্কৃতির মুখোশে এদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রার অমঙ্গল ঠিকানা থেকে জাতি সাবধান!

মঙ্গল শোভাযত্রা নিয়ে যারা বেশি মাতামাতি করেন তারা অসাম্প্রদায়িক হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গ ঢোলের বাদ্য- যা দেবী দূর্গাকে আহবান করাসহ অন্যান্য মুর্তিপুজার মূল বাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়- তা একটি বিশেষ সম্প্রদায় হিন্দুদের পুজার উপাদান।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে (১) মহান আল্লাহ তা’য়ালা ছাড়া কারো কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা, (২) হিন্দুদের দেবদেবীর পূজার অনুকরণে বাদ্য বাজানো, (৩) নানা ধরণের মূর্তি ও মুখোশ বহন করা, (৪) দলে দলে যুবক-যুবতী মিলে পথে-ঘাটে নৃত্য করা, এসব কি এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি? কিংবা এ-ই কি অর্থ অসাম্প্রদায়িকতার? এ অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করা কি আমাদের দায়িত্ব নয়???

আলিম, লেখক ও শিক্ষক