নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর, আশা উৎকণ্ঠার দীর্ঘ রাত

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২৩ ২০২১, ১৪:০৪

আব্দুল্লাহ মায়মূন

(গত পর্বের পর থেকে)

এক রুমে অনেক দিন হয়ে গেলো। সম্ভবত আঠার দিন হবে। মাত্র দু’জন, আমি আর ড্রাইভার। উভয় হাতে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায়, চব্বিশ ঘন্টা আলো জ্বালানো অবস্থায়, বাইরে থেকে কোনো আলো-বাতাস ঢুকে না, কোনো শব্দও শুনতেও পাই না। না আযানের সুমধুর সুর আর না গাড়ীর শব্দ। না পাখির কিচির-মিচির আর না মানুষের কোলাহল। এগুলো যেনো আমাদের কাছে অপরিচিত হতে লাগলো। চব্বিশ ঘন্টা এক অবস্থায় থাকার দরুণ আমাদের কাছে দিন ও তারিখ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে ঘড়ির টাইমই বলে না, দিন তারিখতো দূরের কথা। তাই প্রতিদিন আমার একটি কাজ ছিলো দিন ও তারিখ নিজে নিজে বের করা। এভাবেই দিন ও তারিখ ঠিক করতাম।

চব্বিশ ঘন্টা মাথার উপরে লাইট জ্বালানো থাকায় অনেক সময় রাতে ঘুম আসতো না। একে তো টেনশান, উপরন্তু লাইট জ্বালানো। তখন মাঝেমধ্যে ভাবতাম, বালিশের কাভার দিয়ে চোখ বেঁধে নেই, এতে করে চোখ অন্ধকার হবে, তাতে ঘুম আসতে পারে। তাই একবার বালিশের কাভার খুলি, কিন্তু দু’হাত হ্যান্ডকাপে আবদ্ধ থাকায় চোখ বাঁধতে পারি নি। তাই ব্যর্থ চেষ্টা না করে যেভাবে আছে সেভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করি। খালি রূমে টাইলসের ফ্লোরে শোয়া, সর্বদা আলোকিত রূমে থাকা, হ্যান্ডকাপ লাগানো অবস্থায় শোয়া অবর্ণনীয় কষ্ট। পিঠ বা শরীরের কোথায় চুলকাতে চাইলেও ভালোভাবে চুলকানোও যায় না। ঘুমাতে গেলে না ভালোভাবে কাৎ হয়ে শোয়া যায় আর না চিৎ হয়ে প্রশান্তমনে শোয়া যায়। প্রচন্ড ঘুম আসলে একটু ঘুমানো যায়। একটু নড়াচড়া বা কারো পায়ের আওয়াজ পেলেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রথম দু’দিন স্বাভাবিক মনে হলেও এখন চক্রবৃদ্ধিহারে টেনশান বাড়ছে। কখনো নিজেকে নিয়ে, কখনো ড্রাইভারকে নিয়ে, আবার কখনো নুসরাতকে নিয়ে। তারা বলেছে, নুসরাতকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু তাদের কথার গড়মিল থাকায় আশ্বস্ত হতে পারছি না। তবে খাবার ভালো দিত, কিন্তু কোনো মানুষকে চব্বিশ ঘন্টা পোলাও-গোস্ত-বিনিয়ানি দিয়ে যদি সোনার শিকল দিয়ে চব্বিশ ঘন্টা বন্দি রাখার কথা বলা হয়, তারপরেও কোনো মানুষ এই বন্দিত্ব মেনে নিবে না। আমাদের অবস্থায়ও এরকম, যদিও খাবারের ক্ষেত্রে কষ্ট দিত না, কিন্তু এই বন্দিত্ব কোনোভাবে মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। আমাকে তারা কোনোভাবে শারীরিক নির্যাতন করে নি, কিন্তু এরপরেও নিজেকে আশঙ্কামুক্ত মনে হয় নি। মাঝেমধ্যে ঘুমালে মনে হত ঘুমের মধ্যেই তারা মারধর শুরু করে কিনা? সব সময় এক ভয়, অজানা আতঙ্ক আমাকে তাড়া করতে থাকে। এতকিছুর পরও আমার নিয়মিত তেলাওয়াত, সকাল-সন্ধার জিকির অব্যাহত ছিলো। এই কয়দিনে আমার চার বার কুরআন খতম হয়। প্রথম সপ্তাহ/দশ দিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদের দরুন তেলাওয়াত কম হলেও শেষের দিকে তেলাওয়াতের মাত্রা বেড়ে যায়। কোনো কোনো দিন ১৫ পারা পর্যন্ত হয়ে যায়।

প্রায় আঠার দিন পর যখন বলেছিলো যে, আমাদেরকে এখন ছেড়ে দিবে। তখন প্রথমে ভাবছিলাম হয়তো ছেড়ে দিবে, মুক্তি দিবে। কিন্তু পরে তাদের কথায় বুঝতে পারি অন্য জায়গায় আমাদেরকে বদলী করবে। সেখানে নাকি থাকার প্রশস্ত জায়গা আছে তবে খাবারের মান নিম্ন। আমি জিজ্ঞেস করি, কোথায়? সে বলে জানে না।

আমার কাছে মনে হয় নি সে জানে না, কারণ এরা পদে পদে মিথ্যা বলে। মিথ্যা বলা যে, একটি গোনাহ, অপরাধ, মনে হয় তারা এটা মানে না। অথচ যাকে জিজ্ঞেস করেছি সে নিজেকে একজন তাবলীগী দাবি করে। এজন্যে তাগুতের অধীনে চাকুরীরত কোনো ব্যক্তিকে বিশ্বাস করি না। এদের প্রতি আমার সামান্য শ্রদ্ধাবোধ আসে না। এরা যতই নামায আদায় আদায় করুক আর যতই সিয়াম পালন করুক। তারপরেও তাদের বিশ্বাস করা যায় না। দাড়ি-টুপি পরে তাগুতের অধীনে চাকুরী করা আর টুপি-দাড়ি নিয়ে সুদী ব্যাংকে বা কোনো মদের বারে চাকুরীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু এতটুকু পার্থক্য হবে যে, কেউ হবে আবু তালিব মার্কা তাগুতের অনুসারী আর কেউ হবে আবু জাহেল মার্কা অনুসারী। দিনশেষে দুটোই তাগুতের অনুসারী। আমাকে কিডন্যাপ করার সময় যখন গাড়ীতে হামলা-ভাংচুর করা হয়, তখন হামলাকারীদের একজন ছিলো দাড়িওয়ালা। সে নিজেকে পাক্কা দ্বীনদার দাবি করে। সে এত্ত বড় দ্বীনদার যে, সে নামায না বলে, সালাত বলে। বুঝতে পারছেন, কত্ত বড় দ্বীনদার হলে এরকম তাকওয়া দেখায়!

অথচ সে দাড়ি নিয়েই আমার গাড়িতে হামলা করে। অসম্ভব নয় যে, সে যদি হামলার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। এ যেন মদ পানের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা!

যাইহোক, এর একদিন পরে রাতে ঘুমাতে যাবো তখন একজন এসে বলে, ভোরের দিকে আমাদেরকে এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, তাই যেন প্রস্তুত থাকি!

আমাদের প্রস্তুতি আর কী? সবকিছুই তাদের হাতে। শুধু মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এইটুকুই। এ কথা শোনার পর আমার আর ঘুম আসে নি, সারারাত এপাশ অপাশ করি, কিন্তু ঘুম তো আসে না। ভাবতে থাকি, না জানি নতুন জায়গা কেমন হবে? যাদের অধীনে থাকবো তাদের আচরণই বা কেমন হবে?

এভাবে নানা ভয় এবং অহেতুক ভাবনা পুরো রাত আমাকে অস্থির করে তুলে। মার্চের রাত এমনিতেই লম্বা। এরপরে আবার এত টেনশান। তাতে আমার রাত আরো দীর্ঘ হয়ে যায়। এটি ছিলো আমার সর্ব দীর্ঘ রাতগুলোর একটি…!

ভোর চারটার দিকে সম্ভবত আমাদেরকে জাগানো হয়। আমাকে আর কী জাগাবে? আমি তো এমনিতেই সজাগ। শুধু ড্রাইভারকে জাগানো হয়। আমরা ফ্রেশ হই। কিছুক্ষণ পর ফজরের নামায পড়ি। এরপর আমাদের জন্যে বড় একটি পরোটা এবং ডাল-ভাজি নিয়ে আসা হয়৷ পরোটার সাইজ অনেক বড়। বাজারে পাওয়া এমন সাধারণ পরোটার ডাবল হবে। অত্যধিক টেনশনে খাবারের রুচি কমে যায়। খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, তাই কোনোভাবে নাস্তা সেরে নেই।

নাস্তার পর অপেক্ষায় থাকি কোন সময় আবার বের হওয়ার ডাক আসে। আমি ওই খুচরা সময় তেলাওয়াত করতে থাকি। ওইদিন ছিলো শুক্রবার, তাই প্রথমে সূরা কাহফ তেলাওয়াত করে নিই। এরপর অন্যান্য অংশ তেলাওয়াত করতে থাকি। এভাবে প্রায় সাতটা হয়ে যায়(সম্ভবতঃ)।

এরপরে বাথরুমে যাই ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হবার শেষদিকে পাহারারত ব্যক্তি বলে, ‘তাড়াতাড়ি বের হন!’ বের হতেই চোখ বেঁধে ফেলে। হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগিয়ে দেয়। আমার থাকার রুমে না গিয়ে সরাসরি ধরে ধরে হেঁটে হেঁটে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যায়। তারা বলে, আমার জিনিস-পত্র, কাপড়-চোপড় তারা নিয়ে নিয়েছে। আমার গায়ে দেওয়ার ফুলহাতা কোট, কাফলীন, পাঞ্জাবি একটা ব্যাগে ভরে দেয়।

এরপরে আব্দুর রহিমকে সাথে করে নিয়ে একটি মাইক্রো গাড়ীতে বসায়। প্রথমে ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসায়, এরপরে এর পিছনের সিটে বসায়।

মধ্যখানে এক সিট ফাঁক রেখে বসায়।

এরপর তারা পরষ্পরে কী আলাপ করে গাড়িতে উঠলো। গাড়ী ছেড়ে দিলো, প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমাদের চোখ খুলে দিল। দেখলাম তারা পাঁচজন। বাহিরের গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে দেখি ঢাকা সাভার। এর কিছু পরে দেখি, রাস্তায় থাকা দূরত্ব বোঝানোর জন্যে যে পাকা বোর্ড থাকে ওইটায় লেখা দিনাজপুর … কিলোমিটার। বুঝে ফেললাম, এতদিন আমরা ঢাকায় ছিলাম। সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন সকাল প্রায় নয়টা হবে। শুক্রবার দিন থাকায় ঢাকার রাস্তায় এখনো যানজট ব্যাপক হয় নি। গ্লাস দিয়ে দেখতেছি বাহিরের কাচা রোদ। অনেক ভালো লাগলো। রোদ যে দেখতে এত সুন্দর হয় তা ১৮/১৯ দিন গুম না থাকলে হয়তো বুঝতাম না। আসলে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতিটি সৃষ্টিই সুন্দর। মন খুব চাইলো একবার রোদে অবগাহন করি! কিন্তু চাইলেই কি আর পারা যায়? আমি যে এখন বন্দী, এই মুহূর্তে রোদের তাপ গায়ে লাগানোর ইচ্ছা করা মানে নিজের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তোলা। এভাবে অনেকদিন পর বাহিরের দৃশ্য দেখে মনটা অনেক প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। প্রকৃতির অপরূপ ভূমি বাংলাদেশ। মহান আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির প্রতিটি অপরূপ দৃশ্য আমি আনমনে তাকিয়ে দেখছি। দুনিয়াটা কত সুন্দর তা এই সামান্য কয়েকদিন আমাকে বুঝিয়ে দিলো। এভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি আর তাদের সাথে গল্প করছি। হঠাৎ করে আবার চোখ বেঁধে দিলো। মহান আল্লাহর সৃষ্টি উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম।

তখন আর কী করা? রাতে ঘুম হয় নি। তাই গাড়ীতেই আমার ঘুম চলে আসে। গাড়ী চলছে আর আমি ঘুমাচ্ছি। গাড়ীর ঝাঁকিতে, বাহিরের বিভিন্ন আওয়াজে মাঝেমধ্যে ঘুম ছাড়লেও কিছুক্ষণের ভেতর আবার ঘুম চলে আসে। এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা চলতে চলতে একসময় দেখি কিডন্যাপাররা বলাবলি করছে, সামনে ব্রিজ। কথা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারা আমাকে আর আব্দুর রহিমকে বলে, ব্রিজ দেখবে ব্রিজ?

কোন ব্রিজ এটা বলে নি। এরপর আমাদের চোখ খুলে ফেলে। তখন দেখি বিশাল নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ সেতু। প্রথমে চিনতে পারি নি এটা কোন ব্রিজ। পরে বুঝতে পারি এটা যমুনা ব্রিজ। এর আগে মাত্র একবার এই ব্রিজ দিয়ে আমার যাতায়াত হয়েছিলো। ২০০৯ সালে খুলনাতে তাবলীগের চিল্লায় গিয়েছিলাম। আসার পথে ট্রেনে করে এই ব্রিজ দিয়ে আসি। তাই প্রথমে চিনতে পারি নি। পরে অবশ্য চিনতে পারি।

তারা এতদিন আমার সাথে আলাপ করে বুঝেছিলো যে, স্ত্রীর প্রতি আমার বিশাল দুর্বলতা। এই নুসরাতই হচ্ছে তাদের কাছে আমার দুর্বল পয়েন্ট। তো যখন আমরা স্বাভাবিকভাবে যমুনা নদীর স্রোতের তালে তালে ব্রিজের সৌন্দর্য উপভোগ করছি আর বলছি, কী সুন্দর ব্রিজ! অনেকটা আনন্দিত প্রফুল্ল বদনে তাকিয়ে আছি বাহিরের দিকে তখন এক কিডন্যাপার বলে, ‘তোমার আনন্দ আরো বেড়ে যেত যদি তোমার সাথে ভাবী(নুসরাত) থাকতো!’

কানে ভাবী শব্দ বাজতেই নুসরাতের অসহায় চেহারা স্মরণ হলো। রাতের অন্ধকারে তাকে রাস্তায় নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ফেলে আসার কথা স্মরণ হলো। মনটা হাহাকার করে উঠলো। মুহূর্তে পুরো আনন্দটাই আমার জন্যে বিষাদে পরিণত হলো। একেবারে বিষাদ সিন্ধুতে!

যাইহোক, চার/পাঁচ মিনিট পর ব্রিজটা অতিক্রম করা হলো। আর আমাদের চোখ আবার বাঁধা হলো।

এভাবে আরো কয়েক ঘন্টা গাড়ীতে থাকার পর অনুভব করলাম গাড়ী ধীরে চলছে। মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক দুলছে। মনে হলো ইটের সুরকির রাস্তা দিয়ে গাড়ী প্রবেশ করেছে। মনে হচ্ছে, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। আমাদের নতুন ঠিকানায়। হ্যাঁ, আমার ধারণাই ঠিক। গাড়ী থেমে গেলো। চোখ বাঁধা এবং হ্যান্ডক্যাপ পরা অবস্থায় আমাদেরকে গাড়ী থেকে নামানো হলো। তখন নতুন অপরিচিত শব্দ শুনতে পেলাম। একজন বললো, এই তাহলে ‘আব্দুল্লাহ মায়মুন’! এরপরে বলতে লাগলো, এরা তো ভালো মানুষ। তোমরা কেনো এদের চোখ বেঁধে রাখছো?

এ যেনো অন্তরে বিষ লালন করে মধুমাখা উচ্চারণ! এরপরে একটি রুমে প্রবেশ করাতে করাতে আমাদের চোখ খুলে দিলো। তখন প্রায় পৌনে বারোটা হবে হয়তো।

রুমের মধ্যে প্রবেশ করি। সেখানে দেখি নতুন চেহারা নতুন ইউনিফর্ম পরা কিছু লোক। দেখেই অন্তর ধড়াস করে উঠলো। তারা আমাকে নিয়ে একটি হাতাওয়ালা চেয়ারে বসালো। চেয়ারের নিচে এবং পিঠে ফোম জয়েন্ট করা। বাকী অংশ লোহার। কালো রঙের। এটা বিভিন্ন অফিসে ব্যবহৃত প্রচলিত চেয়ার।

ওই সময় এক হাতের হ্যান্ডক্যাপ খুলে চেয়ারের হাতার সাথে অন্য হ্যান্ডক্যাপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। অনেক দিন পর চেয়ারে বসলাম। অন্তরে নতুন অনুভূতি। মনে হলো চেয়ারে বসার সুযোগ পাওয়া মানে অনেক কিছু। রুমটির মধ্যখানে আমাদেরকে চেয়ারে বসানো হলো। পুরো রুমের দিকে অবলোকন করা শুরু করলাম। রুমটি ১০×১৫ হাতের মনে হলো। দুটি দরোজা পশ্চিম দিকে এবং বাকী তিন দিকে মিলে পাঁচটি জানালা। জানালার উপর আবার পর্দা টানানো এজন্যে বাহিরের দিক দেখা গেলো না। উভয় দরজা পড়ছে পশ্চিম দিকের দুই মাথায়। দরোজার মধ্যখানের অংশ পুরোটাই দেয়াল। এখানেও তারিখ দেখার জন্যে ক্যালেন্ডার এবং সময় দেখার জন্যে ঘড়ির ব্যবস্থা নেই।

কিছুক্ষণ পর তারা শোয়ার দুটি খাট আনলো। হাসপাতালে পাতানো থাকা রোগীর খাটের মতো লোহার খাট। মাথায় দেওয়ার বালিশ। নিচে বিছানোর জন্যে একটি কম্বল। গায়ে দেওয়ার জন্যে আরেকটি কম্বল এবং বিছানার চাদর নিয়ে আসা হলো। আমি তাদের আচরণ-ব্যবহার, রুমের অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা দেখে ভড়কে গেলাম। অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম। না জানি এখানে কত দিন থাকা লাগে। আমার ভয়ার্ত ভাব চেহারায় ফুটে উঠলো। ওই সময় আমার প্রস্রাবে ধরে। তখন একজনকে বলি, মনে হয় সে দলনেতা হবে। সে আমার ভয়ার্ত চেহারা দেখে অনুমান করতে পারে যে, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি। সে এ সুযোগ কাজে লাগাতে দেরি করে নি। তুই-তুকারি সম্বোধনে কথা-বার্তা শুরু করে। সে ওই ব্যক্তি যে আমাদেরকে গাড়ী থেকে নামানোর সময় ভালো মানুষ বলে চোখ খুলে দেয়, এখন সেই আমার সাথে এরকম রূঢ় আচরণ করতে থাকে। সে বলে, আমাকে ঝুলিয়ে পেটাবে আরো অনেক কিছু। এগুলো শুনে আমার ভয় আরো বেড়ে গেলো। এগুলো বলতে বলতে আমাকে ধরে রুমের বাইরে বিল্ডিংয়ের ভেতরেই ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। রুমের পশ্চিম দিকে ওয়াশরুম। রুম থেকে বের হয়ে ডানে মোড় নিতেই দেখি, একটি প্যাসেজ। সেখানের শেষদিকে কলাপসিবল দরোজা। ওইটা দিয়ে আমাদের প্রবেশ করানো হয়। এর বামপাশে প্যাসেজের মাথায় দু’তলায় উঠার সিড়ি। ঠিক মাঝে একটি ছোট্ট রুম। এর পূর্বে বাথরুমের রাস্তা। উভয় পাশে একটি করে টয়লেট, মধ্যখানে ফাঁকা জায়গায় একটি কাচের জানালা আছে তা দিয়ে বাহির দেখা যায়। এখানে একটি টয়লেট রুম। দাঁড়িয়ে পেশাব করার জন্যে একটি পেশাবখানা এবং গ্লাসসহ একটি বেসিং। এর অপর পাশে দুটি হাই কমোডের বাথরুম, তবে অব্যবহৃত। এ জন্যে এগুলো দেখার উপযুক্ত নয়। এই বাথরুম এবং রুমের মাঝে দক্ষিণদিকের ওয়ালের সাথে লাগানো আরেকটি বেসিং। যাইহোক, প্রস্রাব করতে বাথরুমে ঢুকি। দেখি সেখানে লাইট নেই। এমনকি লাইটের ব্যবস্থাও নেই। অন্ধকারেই কাজ সারতে হয়। বাথরুম ক্লিয়ার করে হাত-মুখ ধুয়ে আবার রুমে আসি। এই নতুন বন্দিশালা আর পূর্বের বন্দিশালার মধ্যে পার্থক্য হলো যে, পূর্বেরটা ছিলো অত্যধিক ছোট। এটি বড়। পূর্বেরটির বাথরুমে যেতে চোখ বেঁধে দিত এখানে এরকম নেই। তো রুমে বসার পরেও আমার ভয় কাটে নি। ওই নেতার কথা শুধু কানে বাজছিলো। এ বিষয়টি খেয়াল করে আমাদেরকে নিয়ে আসা একটি ছোট কর্মচারী। সে গিয়ে তার নেতাকে বলে। তখন দেখি তৎক্ষণাত ওই নেতা আসে। ইতোমধ্যে ওই হুমকিদাতাও বাইরে চলে যায়। নেতা এসেই আমাকে আন্তরিকতা ও স্নেহের সুরে বলে, তুমি নাকি ভয় পাইছো? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এরা আমাকে মারপিটসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছে, তাই ভয় পেয়ে গেছি।’ তখন সে বলে, ‘ভয় পেয়ো না, আমি থাকবো, তোমাকে কষ্ট দেয় এরকম কিছুই হতে দিব না।’ তারপর সে চলে যায়।

এরপরে দেখি সেই হুমকিদাতা আবার আমার কাছে এসে বসলো। তখন সে মোবাইল টিপতে টিপতে স্বাভাবিক গলায় কথা বলতেছে। আমার নাম-ঠিকানা জানতে চায়। একটা সময় সে একটি আরবি শব্দ আমাকে দেখিয়ে বললো, এটি ‘আবু হুরাইদ’ না। মনে হয় কিছুদিন আরবি পড়েছে। আমি বললাম, হ্যাঁ! সে বললো, এর অর্থ কী? আমি বললাম, ‘জানি না।’ আসলেই এর অর্থ আমার জানা নেই। তখন সে বলে, তুমি না মুফতি?

– আমি বললাম, হ্যাঁ।

– তাহলে এর অর্থ জানো না কেনো?

– মুফতি হলেই কি সব কিছু জানতে হয়?

– হ্যাঁ!

– আপনি তো বাংলা শিক্ষিত তাই না?

– হ্যাঁ!

– বাংলাভাষার কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারবেন?

– হ্যাঁ!

– তাহলে বলুন তো ‘ধুনন’ অর্থ কী?

– তখন সে কী একটা ভুল উত্তর দেয়। – – – আমি বলি, হয় নি। আমি আরো বললাম, আপনি পারেন নি! কারণ কোনো মানুষই সবজান্তা নয়।

এতে সে আটকে যায়, এরপর সুবোধ বালকের মত আরো কিছু সময় মোবাইল টিপে চলে যায়।

ইতোমধ্যে বাহির থেকে সুমধুর সুর আমাদের কানে আসতে থাকে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত সেই সুমধুর আযানের ধ্বনি। আজ শুক্রবার তাই আযানটা একটু আগে হয়ে যায়। আযানের শব্দ শুনে মনে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হয়। এই আযানের শব্দ শোনার জন্যে মন কতই না ছটফট করেছিলো। আজ সেই শব্দ শুনে ছটফট বন্ধ হলো। কিন্তু কবে যে জুমআর নামায পড়তে পারবো সেই অপেক্ষায় থাকি। কিছুক্ষণ পর সব নেতারা চলে যায়। আমাদেরকে পাহারা দেওয়ার জন্য থাকে ছয় জন লোক।

ইতোমধ্যে খাটও প্রস্তুত হয়ে যায়। আমাদের জন্যে একটি লুঙ্গি এবং একটি গেঞ্জির ব্যবস্থা করে। এরপরে আমাদেরকে খাটে উঠার জন্যে বলা হয়। খাটে উঠি। এক হাত খাটের সাথে হ্যান্ডক্যাপে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারা আমাকে তেলাওয়াতের জন্যে এখন পর্যন্ত কোনো কুরআন কারীম দেয়নি। তাই সময় কাটানোর কোনো উপায় নেই। শুধু জিকির আর শুক্রবারের বিশেষ আমল দরুদ পড়া ছাড়া। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। একটি পলিথিনে করে ভাত, তরকারী আর ডাল। তরকারী বেগুনের। এর মধ্যে দিয়ে দিয়েছে এক টুকরো গরুর গোশত। জীবনে কখনো বেগুনের তরকারীর সাথে গরুর গোস্ত খাই নি।

খাবার খেয়ে নিজেই প্লেট ধুতে হলো। পূর্বের জায়গায় যেহেতু সর্বদা রুমে থাকাই হত এ জন্যে আমাদের কাজ ছিলো শুধু খাবার খাওয়া, আর তারা এগুলো উঠিয়ে ধুয়ে নিত। সেখানে তারা আমাদের কাপড়ও একবার ধুয়ে দেয়। আমরা গোসলের সময় শুধু গেঞ্জি আর লুঙ্গি ধুইতাম। কিন্তু এখানে সবকিছু নিজে নিজে করতে হয়। রুম বড় থাকায় মাঝেমাঝে একটু হাটাচড়ার জায়গাও পাওয়া যায়, যদিও হাটা হয় নি। পুরো রুমে দুটি মাত্র খাট। আর আছে বিভিন্ন ডিজাইনের অনেকগুলো চেয়ার। আমাদের জন্যে টুথব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান দেওয়া হয়। আর প্লেট ধোয়ার জন্যে দেওয়া হয় হুইল পাউডার। এভাবেই আমাদের নতুন দুনিয়ার জীবন শুরু হলো। অত্যন্ত বিরক্তিকর অলস অবসর সময়।

কুরআন কারীম না থাকায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,। জুমআর পর খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। না ঘুম আসতেই চায় না। শুধু এপাশ-ওপাশ করি। জিকির-দরুদে মনোযোগ দিই। এরপরও বিভিন্ন দুশ্চিন্তা গ্রাস করতে থাকে। অন্ধ ভয় আচ্ছন্ন করতে থাকে। তখন জিকিরের মাত্রা ব্যাপক বাড়িয়ে দেই। এতে মনে প্রশান্তি আসে। ঘুম তো আসে না। আমাদের পাহারায় নিযুক্ত থাকা দু’জনের একজনকে দেখি চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। আরেকজনকে দেখি, চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, দেখো, তারা ঘুমাতে চাচ্ছে কিন্তু ঘুমানোর জায়গা পাচ্ছে না, আর আমরা ঘুমানোর জায়গা পেয়েছি কিন্তু ঘুম আসছে না। এটাই দুনিয়া, যেখানে মানুষের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয় না। এই দুনিয়াই মুমিনের জন্যে কারাগার। তো এভাবে আসর হয়। আসরের পর ওই হুমকিদাতা নেতা আসে, সে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে, বলার মধ্যে নেই আগের মতো উত্তেজনা আর হুমকি। শুধু স্বাভাবিক কথাবার্তা। মাগরিবের পর আসে আমাদেরকে নিয়ে আসা নেতা। সেও বিভিন্ন কথাবার্তা বলে। আমাদেরকে আশার বাণী শোনায়, আব্দুর রহিমকে দু’দিন পর ছেড়ে দিবে আর আমাকে দু’সপ্তাহ পর এখান থেকে স্থায়ীভাবে ছেড়ে দিবে। এভাবে আবার শুরু হয় মিথ্যার ফুলঝুরি।

প্রথমদিন এভাবেই চরম বিরক্তির সাথে কাটে। কুরআন না থাকায় মনে হয় সময় যেতেই চায় না। এভাবে পরদিন আসর পর্যন্ত যায়। আসরের পর আমাকে কুরআন দেয়। কুরআন পেয়ে সাথে সাথে হাতে নিই, মনে হচ্ছে আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুধার্ত আর কুরআনই হচ্ছে সেই ক্ষুধা নিবারণের খোরাক। একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাবার পেলে যে অবস্থা হয় আমারও কুরআন পেয়ে সে অবস্থা হলো। সাথে সাথে হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে তেলাওয়াত শুরু করি। ওইদিন ঘুমানোর পূর্বে আট পারা তেলাওয়াত করি। নামায-খাবার সময়মত সম্পন্ন হয়। তবে খাবারের মান তেমন ভালো নয়। মোটামুটি চলে। এরপর শুয়ে পড়ি। এখানে ঘুমাতে তেমন অসুবিধা হয় না। শুধু একহাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগানো। দুটি হ্যান্ডক্যাপ না থাকায় হাতটা একটু নড়াচড়া করা যায়, তবে যে হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগানো ওই পাশে একটু আরামে ঘুমানো যায়। কিন্তু পার্শ্ব পরিবর্তন করলে হাত কোমরের উপর আটকে যায়। তবে তাদেরকে বললে তারা হাত পরিবর্তন করে দেয়। এভাবে সকাল হয়, ফজরের নামায পড়ে যিকর-আযকার ও তেলাওয়াত করে শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সকালের নাস্তা আসে। একটি পলিথিনে করে মোটা চাউলের শুকনো খিচুড়ি। আবাসিক মাদরাসার বোর্ডিংয়ে থাকার অভ্যাসের ফলে এগুলো আমি কষ্ট করে হলেও খেতে পারি, কিন্তু বেচারা আব্দুর রহিম! সে এগুলো খেতে পারে না। ড্রাইভার মানুষ, ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। ড্রাইভারদের রুচি থাকে অনেক উন্নত। সে খিচুড়ির অবস্থা দেখে খেলোই না। সে আর আমি এক রুমে হলেও দু’জনকে রাখা হয়েছে রুমের দুই পাশে। পূর্বে দিকে তাকে আর পশ্চিম দিকে আমাকে। রুম বড় হওয়ায় উচ্চস্বরে কথা না বললে একজন আরেকজনের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে না।

তো নতুন দুনিয়ায় আসার আমাদের দু/তিন দিন হয়ে গেলো। ওই সময়ে আমি বেশি তেলাওয়াতে মগ্ন থাকতাম। আর আব্দুর রহিম নীরবে শুয়ে থাকতো আর টেনশান করতো। তাদের আশ্বাস বাণী শুনে সে আবার আশার স্বপ্ন জাগাতে থাকে যে, দ্রুত মুক্ত হয়ে যাবে। ওই সময় এক নেতা আসতো ল্যাপটপ নিয়ে। সে আমাদের বিভিন্ন নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লিখতো। আর আসতো আমাদের সাথে আসা সেই নেতা। সে দিনে-রাতে দু/তিনবার এসে আমার সাথে গল্প করতো। একবার আসলে ঘন্টা দেড় ঘন্টা বসে থাকতো। কখনো তেলাওয়াত শুনতো আবার কখনো বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতো। তাকে বলি, আব্দুর রহিম সকালের নাস্তা খায় না, না খাওয়ার কারণও বললাম। তখন সে ওদের বলে আব্দুর রহিমের জন্যে সকালের নাস্তায় পরোটার সাথে ডাল-ভাজি এবং ডিম ভাজা আর আমার জন্যে খিচুড়ির সাথে ভাজা ডিমের ব্যবস্থা করে। এভাবে চলে যায় সপ্তাহ খানেক। একদিন দেখি, সবাই তটস্থ হয়ে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পরে বুঝলাম তাদের বড় নেতা এসেছে। তখন বেলা ১২টা হবে। আমাকে দু’জন দু পাশে ধরে রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়। এরপর সিড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠায়, সেখানে পাঁচ হাত × পাঁচ হাত সাইজের এক রুমে ঢুকিয়ে চলে আসে। আমি রুমে ঢুকেই দেখি কয়েকটি চেয়ার পাতা, এগুলোর সামনে অফিসের টেবিলের মতো একটি টেবিল। এরপাশে একটি চেয়ার। চেয়ারে বসা আছে একজন ব্যক্তি। এই তাদের বড় নেতা। আমাকে দেখেই সে চেয়ারে বসতে বললো। এরপর চেয়ারের সাথে আমার এক হাত হ্যান্ডক্যাপে লাগিয়ে দেয়।

সে আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। এক সময় আমার আব্বার প্রসঙ্গ আসে। আব্বার কথা স্মরণ হতেই আমার চোখের সামনেই আব্বার উদাস চিন্তিত চেহারা ভেসে উঠে। মনে হচ্ছে তিনি খুব পেরেশান। সাথে সাথে চোখে পানি চলে আসে। তখন আব্বার বিভিন্ন কথা কানে বাজতে থাকে। আমাকে দেওয়া তার নসিহতগুলো খু–ব স্মরণ হতে থাকে, নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। ওই নেতা তখন আমার চোখে পানি দেখে প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে দেয়। এতে করে আব্বার জীবনের বিভিন্ন দিক আমার সামনে ভেসে উঠে। তিনি ছোট থেকে বড় হয়েছেন কারো সাথে ঝগড়া মারামারি করেন নি। ছাত্রজীবন বলুন আর কর্মজীবন বলুন কোনো জীবনেই তিনি কারো সাথে মারামারি তো দূরে, কটু ব্যবহার এমনকি রূঢ় আচরণ করেন নি। তাঁর শৈশবের ব্যাপারে আমাদের দাদী-ফুফুদের কাছ থেকে শুনেছি। সবাই তাঁর নম্র-ভদ্র ব্যবহারের কথা বলতেন। তাঁর উস্তাদ-ছাত্র এবং সহপাঠী ও বন্ধুদের কাছ থেকে তার ব্যাপারে কখনো ভালো ছাড়া মন্দ কিছু শুনি নি। তিনি নিজেকে সর্বদা ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতেন, যেখানে ঝামেলা বুঝতে পারেন সেখান থেকে দূরে থাকতেন। অত্যন্ত সহজ, সরল, বিনয়ী, নম্রভাবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন এবং যৌবন পেরিয়ে আজ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। জীবনে কখনো তাঁকে নিয়ে কাউকে কোনো মন্দ কথা বলতে শুনি নি। আমার শ্বশুর বলেন, জীবনে একজন মানুষ পেয়েছি, ‘তিনি হচ্ছেন (আমার আব্বা) মাহমূদ হোসাইন’। আব্বার ব্যাপারে আমার এগুলো স্মরণ হচ্ছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। স্বাভাবিক পানি নয়, অস্বাভাবিক অশ্রু। অঝোরভাবে চোখ বেয়ে পড়তেছে, সাথে হেচকি। আব্বা সিলেটের আঙ্গুরা মাদরাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে আঙ্গুরা মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম, জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন এবং বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শায়খ জিয়া উদ্দীন দা.বা. বলতেন, ‘আব্বা হচ্ছেন মানুষের সুরতে ফেরেস্তা চরিত্রের ব্যক্তি!’ কথাটি একাধিক সূত্রে শুনেছি। মনে মনে ভাবলাম, এরকম একজন সহজ সরল বিনয়ী স্বভাবের ঝামেলামুক্ত মানুষ না জানি আমার জন্যে কত পেরেশানী ভোগ করছেন!

আব্বার ব্যাপারে যখন এগুলো স্মরণ হচ্ছিলো তখন প্রবল বন্যার মতো চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিলো। একপর্যায়ে কান্না থামলো। তখন ওই বড় নেতা আমার দিকে মনোযোগ দিলো। এরপর সে সামান্য মুচকি হেসে আমার হাতে একটি চকলেট ধরিয়ে দিল এবং ইশারা দিয়ে খেতে বললো। আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলো। এভাবে জোহরের সময় হয়ে যায়। মধ্যখানে জোহরের নামাযের বিরতি দিলো। তারপর আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে নিচতলায় আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিলো।

মিহনা’র পূর্বের পর্বগুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন