তাবলিগ এবং বিশ্ব ইজতেমা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১০ ২০২০, ০৮:১৯

ইলিয়াস মশহুদ : তাবলিগ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, প্রসার করা, বয়ান করা, চেষ্টা করা, দান করা ইত্যাদি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোকে তাবলিগ বলে। তাবলিগ আদর্শ যিনি পৌঁছান, তাকে মুবাল্লিগ বলে। বিশ্বনবী সা. এ প্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘আমার পক্ষ হতে একটিমাত্র বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’
বাংলাদেশে তাবলিগ আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। সে হিসেবে এবারের টঙ্গীর ইজতেমা হবে ৭৫তম বিশ্ব ইজতেমা। সুদীর্ঘ সাড়ে তিন যুগ ধরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। গতবারের মতো এবারও দিল্লির নেজামুদ্দিনের তাবলিগি মারকাজের যিম্মাদার মাওলানা সা’দ কান্ধালভীকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হয়নি, তাই ২০১৯ সালের ধারাবাহিকতায় এবছরও প্রথম পর্বে আলমী শুরার উলামায়ে কেরামের অধীনে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে আজ শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) থেকে শুরু হচ্ছে উলামায়ে কেরামের অধীনে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। ইতিমধ্যে ময়দানের সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাড়তি পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঠের ভেতর ও বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। ইজতেমা ময়দানে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। এবার ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করবেন সাড়ে আট হাজার পুলিশ সদস্য।
আজ থেকে শুরু হওয়া ইজতেমার আখেরি মোনাজাত হবে রবিবার। এই পর্বে দিল্লির মাওলানা সাদপন্থী কেউ অংশ নেবে না। মাঝে চারদিন বিরতি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নেবেন সাদপন্থীরা। তাবলিগের আভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে এবার বাহ্যত দুই পর্বে ইজতেমা হলেও দুই পক্ষ পৃথক পৃথক ইজতেমা করছে। ‘তাবলীগ’ অনুসারীদের একটি বৃহত্তম সমাবেশ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা।
বর্ণিত আছে যে, আজ থেকে প্রায় ৬ দশক আগে ১৯১০ সালে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে হাতেগোনা ক’জন মানুষ নিয়ে হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রাহ. তাবলিগের মেহনত শুরু করেন। তাবলিগের এ মেহনত এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আজকের তাবলিগ জামায়াতের সার্থক রূপকার হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রাহ. ১৩৫১ হিজরি সনে হজ থেকে ফিরে আসার পর সাধারণ মুসলমানদের দুনিয়া ও সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ছোট ছোট দলবদ্ধ করে মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য দ্বীনি শিক্ষা দিতে থাকেন। এরই মাঝে একদা তিনি মহানবী সা. কে স্বপ্নে দেখেন এবং মহানবী সা. তাকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের জন্য নির্দেশ দেন। মহানবীর সা. নির্দেশ মোতাবেক তিনি দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সূচনা করেন। তারপর এ কাজকে আরও বেগবান ও গতিশীল করার জন্য উপমহাদেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও বুযূর্গদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হয় এবং দিল্লির কাছে মেওয়াতে সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য ইজতেমা বা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়।
হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধালবী রাহ. এ কর্মপ্রয়াসকে তখন বলতেন ‘ইসালে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির প্রাথমিক পাঠ। প্রথমত তিনি টেস্ট কেস হিসেবে ভারতের সাহারানপুর ও মেওয়াত এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি ৬টি বিশেষ গুণ অর্জনের মেহনত করেন জনসাধারণ্যে। সেই বিশেষগুণ হলো- কালেমা, নামায, ইলিম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের সেবা) সহিহ নিয়ত ও তাবলিগ। অন্য একটি গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ইলিয়াস রাহ. প্রথমে বর্তমান ধারার এ তাবলিগকে নাম দেন ‘তাহরীকুস সালাত’ বা নামাযের আন্দোলন।
এরপরই ক্রমেই তাবলিগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গ-ি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের সর্বত্র। হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ রাহ.’র মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগ শুরু হয়। তারপর ১৯৪৬ সলে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলিগের মারকাজ কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে। এরপর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গির পাগারে এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে টঙ্গির ভবেরপাড়া তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত সেখানেই ১৬০ একর জায়গায় তাবলিগের সর্ববৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, তাবলিগ জামায়াতের সদর দফতর দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও এর বার্ষিক সমাবেশের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়। কথিত আছে, তাবলিগ জামায়াতের মুরুব্বিদের বৈঠকে ইজতেমার স্থান নির্ধারণের জন্য নাকি লটারি হয়েছিল, সেই লটারিতে বাংলাদেশের নাম ওঠে। আর সেই থেকেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ এ বিশ্ব ইজতেমা। ভারতের মুম্বাই ও ভূপালে এবং পাকিস্তানের রায় বেন্ডে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও জনসমাগমের বিচারে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমাই বড় এবং বিশ্ব দরবারে বিশ্ব ইজতেমা বলতে বাংলাদেশের টঙ্গিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমাকেই বুঝায়।
কথিত আছে, ইলিয়াস রাহ. প্রথম যখন মানুষের কাছে ধর্মীয় প্রচার শুরু করেন, তখন তেমন কোনো সাড়া মিলেনি। তাই তিনি অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি আশপাশের দিনমজুর, শ্রমিক-কৃষকদের ডেকে এনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রেখে দু’বেলা খাবার দিতেন এবং তাদেরকে নামায শিক্ষা দিতেন, নামাযের সুরা শিখাতেন, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ বর্ণনা করতেন। অবশেষে বিদায় বেলা তাদের প্রত্যেককে মজুরি তথা পারিশ্রমিক দিয়ে দিতেন। এ পদ্ধতি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হলো। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তার নামাযের আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেল। মানুষ তখন নিজেরাই অর্থ ব্যয় করে ইলয়াস রাহ.’র পদাঙ্ক অনুকরণ করে দাওয়াতী কার্যক্রম চালাতে থাকেন।
যখন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রচেষ্টা শুরু হয়, তখন এর নাম ছিলো শুধুই ইজতেমা। যা অনুষ্ঠিত হতো ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। ১৯৬৪ সালে কাকরাইলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের ইজতেমা শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগারে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে এগুতে এগুতেই আজকের টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা। যে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে বিশ্বের প্রায় একশটি রাষ্ট্রের তাবলিগ প্রতিনিধিরা। শিল্পনগরী টঙ্গীতে ইজতেমাকে স্থানান্তরিত করা হয় ১৯৬৬ সালে। আর সে বছর থেকেই তাবলিগ জামাতের এই মহাসম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ সম্মিলন হজে যেমন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মুসলমানদের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের অভাবনীয় নজির দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায়ও দেখা যায় মুসলিম ঐক্যের অপূর্ব এক মিলনমেলা। এর ফলে পূণ্যভূমি মক্কা-মদিনার পর তুরাগ তীরে অবস্থিত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা পরিচিতি লাভ করে বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিলনকেন্দ্র হিসেবে।
বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী। বর্তমানে দু’পর্বে ছয়দিন। কিন্তু টঙ্গীতে এর আমেজ থাকে প্রায় মাসখানেক। আর এ ইজতেমার প্রস্তুতি তো তিন/চার মাস আগ থেকেই শুরু হয়ে যায়। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত তাবলিগ আন্দোলনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামি আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের কোটি কোটি মুসলমান এ আন্দোলনে সময় বিনিয়োগ করে থাকেন।
যতটুকু জানা যায়, ইজতেমা নিয়ন্ত্রণকারী তাবলিগ জামাতের কোনো সংবিধান নেই। অলিখিত সংবিধানও নেই। তারপরও এ আন্দোলন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সুশৃঙ্খল আন্দোলন। তাবলিগ জামাতের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। এটিকে বলা হয় মজলিসে শুরা। এ কমিটির কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। ২১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও বহু ব্যক্তি এ কমিটির মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাবলিগে যারা অপেক্ষাকৃত বেশি অবদান রেখেছেন, তারাই এ কমিটির আলোচনায় কথাবার্তা বলেন। তবে কে কতো বেশি অবদান রেখেছেন, তা নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি নেই। তাবলিগ আন্দোলনে ক্ষমতা বা পদমর্যাদার কোনো প্রতিযোগিতা নেই, প্রতিদ্বন্ধিতা নেই। নেতৃত্বের কোন্দল নেই। যিনি একবার কেন্দ্রীয় শুরায় আমির নির্বাচিত হন, তিনি আমৃত্যু সে পদ অলঙ্কৃত করেন। তাবলিগ অনুসারীরা তাদের আমিরকে সম্বোধন করেন ‘হযরত জী’ বলে। ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত কাকরাইল মসজিদ বাংলাদেশ তাবলিগ জমাতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা হেড কোয়ার্টার।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস রাহ. ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামি দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০’র দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ রাহ.। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। পুরো সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন একঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক। আর্থিক, শারীরিক সহায়তা দিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তারা এই সমাবেশকে সফল করতে সচেষ্ট থাকেন।
পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ; যা বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শুধুমাত্র বিদেশী মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান সনাক্ত করেন।