অমুসলিমদের অধিকার রক্ষায় রাসূল সা.
একুশে জার্নাল
জানুয়ারি ১৩ ২০২১, ০৯:২৯
মুফতি আহমদ যাকারিয়া
ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা, যে ধর্মের বিশ্বসমাজ গড়ে তোলার মতো ঔদার্য আছে। ইসলাম ধর্মমতে মুসলমান ও একই রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সামাজিকতার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য নেই। গোশত ছাড়া অন্য খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে আহলে কিতাব ও অন্যান্য কাফিরের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। সবাই একে অন্যের খাবার বৈধ পন্থায় গ্রহণ করতে পারবে।
ইসলাম শুধু অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয়নি, তাদের সঙ্গে সামাজিক অংশীদারিত্ব, সৌজন্যবোধ ও সামাজিকভাবে মেলামেশার সুযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি ইসলাম অমুসলিমদের সবক্ষেত্রে মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে। তাদের যথাযথ সম্মান দিয়েছে।
অমুসলিমদের অধিকার রক্ষায় ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। মুসলিম সমাজে অমুসলিমরা বসবাস করবে এটিই আল্লাহর অমোঘ বিধান। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন।’
(সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৯)
সংখ্যালঘু ও অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলমানদের আচরণ কেমন হওয়া চাই- এ আয়াত পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে। এটিই ইসলামের নীতি ও রীতি। কোনো প্রকার শত্রুতা বা যুদ্ধাবস্থা না থাকলে তাদের সঙ্গে সুন্দর ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ইসলামের আগে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এমন সুন্দর ও সুস্পষ্ট আইন মানবসভ্যতায় আর দেখা যায় না।
বর্তমান পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা কম-বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দেশে দেশে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই ইসলামের নীতি অনুসরণ করে এই সংকটের সহজ সমাধান করা যেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. এর পদক্ষেপসমূহ
অমুসলিমদের প্রতি জুলুম করা নিষিদ্ধ:
নবী করিম (সা.) কারো উপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন, যদিও মজলুম ব্যক্তি অমুসলিমও হয়। তিনি বলেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)।’
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১২৫৭৭)
অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়া:
অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়াও সুন্নত। নবী করিম (সা.) অমুসলিম রোগীদের দেখতে যেতেন এবং তাদের ঈমানের দাওয়াত দিতেন। তাদের সেবা করতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি গোলাম নবী করিম (সা.)-এর খেদমত করত। যখন সে অসুস্থ হলো, তখন মহানবী (সা.) তাকে দেখতে গেলেন, তার মাথার দিকে বসলেন আর তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো! তখন সে তার পিতার দিকে তাকাল। পিতা বললেন, তুমি আবুল কাসেমের অনুসরণ করো। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করে নিল। তখন নবী (সা.) এই কথা বলে বের হলেন যে, আল্লাহর শোকরিয়া, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
(বুখারি শরিফ, হাদিস : ১২৫৬)
অমুসলিম মৃতদের সম্মান করা:
অমুসলিম জীবিতের যেমন হক রয়েছে, তেমনি মৃতদেরও হক রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের দাফনে সহযোগিতা করা যাবে এবং তাদের জানাযাকেও সম্মান দিতে হবে। কেননা তারাও মানুষ। আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা থেকে বর্ণিত, সাহল ইবনে হুনাইফ ও কায়েস ইবনে সা’দ কাদেসিয়াতে বসা ছিলেন। তখন তাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে কিছু লোক অতিক্রম করল। তখন তারা দু’জন দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হলো যে, ইনি হলেন কাফির। তখন তারা বলেন, মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একসময় এক জানাযা নেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো, এটা তো এক ইহুদির জানাযা। তখন তিনি বললেন, তা কি প্রাণী নয় (মানব নয়)?’
(বুখারি : ১২১৩)
অমুসলিমদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা নিষেধ:
যেসব অমুসলিম মুসলিম দেশসমূহে জিম্মি হিসেবে (মুসলিম রাষ্ট্রের আইন মেনে) বসবাস করে, তাদের হত্যা করা যাবে না। তেমনি যারা ভিসা নিয়ে মুসলিম দেশে আসে, তাদের হত্যা করা যাবে না। তাদের জানমালের নিরাপত্তা মুসলমানদের মতোই অপরিহার্য। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’
(বুখারি, হাদিস : ৩১৬৬)
আবু বাকারা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’
(মুসনাদে আহমদ : ২০৬৪৮)
অমুসলিম আত্মীয়-স্বজনের অধিকার:
সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে গিয়ে নানা শ্রেণির, নানা পেশার, নানা মত ও পথের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় অমুসলিমদেরও। অমুসলিম ব্যক্তি হতে পারে কোনো মুসলমানের প্রতিবেশী। যদি কারো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হলো—তার সঙ্গেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়তার অধিকার রক্ষা করে চলতে হবে।
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’
(বুখারি, হাদিস : ৬১৩৮)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান (দলিল ও প্রমাণ) নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে সদাচরণ করো। আর এমন ব্যক্তির পথ অনুসরণ করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। তারপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদের সে বিষয়ে অবহিত করব, যা তোমরা করতে।’
(সুরা লোকমান, আয়াত : ১৫)
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা আমার কাছে এলেন রাসুলের যুগে মুশরিক অবস্থায়। তখন আমি রাসুল (সা.) থেকে ফাতওয়া তালাশ করে বললাম, আমার মা এসেছেন, তিনি ইসলাম ধর্মবিমুখ। আমি কি তাঁর সাথে আত্মীয়তা রক্ষা করব? তখন তিনি বলেন, হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে তুমি আত্মীয়তা রক্ষা করবে।
(বুখারি, হাদিস : ২৬২০)
অমুসলিমদের সামাজিক নিরাপত্তা:
মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি, বরং তাদের সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়েছে। কারণ, তারাও সমাজের অংশ। এ কারণেই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৯২)
অমুসলিমদের সঙ্গে কখনো নিপীড়নমূলক আচরণ করা যাবে না। তাদের অধিকার খর্ব করা যাবে না। রাসুল (সা.) তা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি কেয়ামতের দিন রাসুল (সা.) নিজেই নির্যাতিত অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বিচার চাইবেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত অমুসলিমকে নির্যাতন করে, তার অধিকার খর্ব করে, তাকে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয় বা তাদের অসম্মতিতে ধন-সম্পদ হরণ করে নেয়, কেয়ামতের দিন আমিই সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব। ’
(আবু দাউদ: ২৫০৩)
অমুসলিমদের ধনসম্পদের নিরাপত্তা:
অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ধনসম্পদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে ইসলাম। তাদের ধনসম্পদ জবরদখল করা যাবে না। অন্যায়ভাবে তা আত্মসাৎ করা যাবে না। তাদের সম্পদ দুর্নীতি করে খাওয়া যাবে না। অন্য কোনোভাবেও তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা যাবে না। রাসুলের যুগেই এই নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। নাজরানের অমুসলিমদের সঙ্গে মহানবী (সা.) চুক্তি করেন। তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নাজরান ও তাদের আশপাশের লোকজন আল্লাহর প্রতিবেশী। তারা আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদের নিরাপত্তায় থাকবে। তাদের সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ছোট-বড় সবকিছুর নিরাপত্তা দেওয়া রাসুলের দায়িত্ব।’
(দালায়িলুন নুবুওয়াহ, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা: ৫৮৪)
অমুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা:
রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অমুসলিম অমুসলিমদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিধান রয়েছে ইসলামে। বিশেষত প্রতিবন্ধী, অনাথ-দরিদ্র ও বৃদ্ধদের ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে অধীনস্তদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। ’ (বুখারি, হাদিস: ৬১৪২) অমুসলিমরাও অন্যান্য নাগরিকদের মতোই রাষ্ট্রের নাগরিক। তাই তাদের প্রতি শাসকরা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলেন- সেই জবাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে।
একবার এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রাসুল (সা.) দাঁড়ালেন। লোকজন বলল, ‘এটি ইহুদির লাশ। ’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (মুসলিম, হাদিস : ১৬৯)
অমুসলিমদের ব্যাপারে ইসলামের নীতি হলো, তাদের মানবিক মর্যদা রয়েছে। সমাজে তাদেরও অধিকার-মর্যাদা রয়েছে। তাদেরও তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার দিতে হবে। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে বা জুলুম নির্যাতন শুরু করলে তখন রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। সিরাতের গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করলে এই চিত্রই আমরা দেখতে পাই।
অমুসলিমকে হাদিয়া-তোহফা দেয়া:
মুসলিম অমুসলিমকে হাদিয়া তোহফা দিতে পারে, তাঁর দেয়া হাদিয়া তোহফা গ্রহণও করতে পারে। নবী করিম সা. অমুসলিম রাজা-বাদশাহের দেয়া হাদিয়া-তোহফা কবুল করেছেন। এ ব্যাপারে বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত উম্মে সালমা রা. কে নবী করিম সা. বলেছিলেন, ‘আমি নাজ্জাশী বাদশাকে রেশমী চাদর ইত্যাদি তোহফা তথা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলাম।’ বস্তুত ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবেই মর্যাদা দেয়, সম্মান করে। তাহলে আহলে কিতাব, জিম্মি ও চুক্তিবদ্ধ কোন মানুষের সাথে অনুরূপ মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার ও আচরণ অবলম্বিত হবে না কেন?
অমুসলিমদের প্রতি আচরণ কেমন হবে?
অমুসলিমদের প্রতি আচরণ কেমন হবে, তার বর্ণনা ওঠে এসেছে হাদিসের একাধিক বর্ণনায়। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অমুসলিমদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন, উত্তম আচরণ করেছেন। তারঁ উম্মতের প্রতি ভালো আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হাদিসে এসেছে- একবার বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে একবার এক ইয়াহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে ওই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটি তো ইয়াহুদির লাশ! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?’ (বুখারি)
অমুসলিমের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা প্রদান:
ঐতিহাসিকভাবে ইসলামে অমুসলিমদের প্রতি ন্যায় বিচার ও সমতা বিধানের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মদিনার ইহুদিরা সব সময় ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসুল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী (সা.) নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা স্বধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন।
(ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৭১)।
অমুসলিম প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করা:
যদি কারও কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হল- তার সাথেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের হক রক্ষা করে চলতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ দুটি সম্পর্ক রক্ষা করার ওপর যথেষ্ট জোর দেয়া হয়েছে।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর উপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন,
إِنِ اسْتَقْرَضَكَ أَقْرَضْتَهُ وَإِنِ اسْتَعَانَكَ أَعَنْتَهُ وَإِنْ مَرِضَ عُدْتَهُ وَإِنِ احْتَاجَ أَعْطَيْتَهُ وَإِنِ افْتَقَرَ عُدْتَ عَلَيْهِ وَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ هَنَّيْتَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ عَزَّيْتَهُ وَإِذَا مَاتَ اتَّبَعَتَ جَنَازَتَهُ وَلَا تَسْتَطِيلُ عَلَيْهِ بِالْبِنَاءِ فَتَحْجُبَ عَنْهُ الرِّيحَ إِلَّا بِإِذْنِهِ وَلَا تُؤْذِيهِ بِرِيحِ قِدْرِكَ إِلَّا أَنْ تَغْرِفَ لَهُ وَإِنِ اشْتَرَيْتَ فَاكِهَةً فَأَهْدِ لَهُ …
‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে।
(খারায়েতী, তবারানী, আবুশ শায়খ- ফাতহুল বারী খণ্ড. ১০, পৃ. ৫১৯, কিতাবুল আদব, বাব-৩১)
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নি- তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কিছু নির্দেশনা এমনও রয়েছে, যেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আনকাবুতের ভাষ্য-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
আমি মানুষকে বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর আচরণের আদেশ করেছি। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না।
(সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৮)
সূরা লুকমানে একই প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে,
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ.
তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচরণ কর। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন কর, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে।
(লুকমান, আয়াত : ১৫)
কুরআনে কারীমের উক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, যদি কোনো মুশরিক বাবা-মা তাদের মুসলিম কোনো সমত্মানকে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক করতে বলে, তাহলে তাদের এ আদেশ কখনো মানা যাবে না। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। বাবা-মায়ের হক আদায় করতে হবে।
প্রতিবেশীর অধিকার সম্বলিত যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সেসব হাদীসে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি- সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে রাসুলের (সা.) এবং সাহাবাদের (রাঃ) জীবন থেকে আরো দু-একটা উদ্ধৃতি দেয়া সংগত বলে মনে করছি।
১- মহানবী (সা.) একদিন মসজিদে নববীতে কতিপয় সাথীদের নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুইন এসে মসজিদের ভিতরে এক কোনে প্রস্রাব করছিলো। রাসুল (সা.) এর সাথীরা ওকে প্রহার করতে উদ্যত হলে মহানবী (সা.) তাদেরকে নিবৃত্ত করলেন। প্রস্রাব করা শেষ হলে শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) তাকে বুঝিয়ে বললেন যে, “ওটা মুসলমানদের ইবাদতখানা, প্রস্রাবের স্থান এটা নয়।” এই বলে তিনি তাকে বিদায় দিয়ে দিলেন এবং পরে তার সাথীদেরকে নিয়ে মসজিদের প্রস্রাব ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন।
২- হযরত উমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে যখন মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রা.) দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় একদিন আলেক জান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ -চৈ পড়ে গেলো। কেউ একজন যিশু খ্রীষ্টের প্রস্তরনির্মিত মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলছে। খ্রীষ্টানরা ধরে নিল যে এটা মুসলমানদের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। খ্রীষ্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে আসলেন আমর ইবনুল আ’ স এর কাছে। আমর শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিলো অন্যরকম। তারা চাইলো মুহাম্মদ (সা.) এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপভাবে নাক ভেঙ্গে দিতে। খ্রীষ্টানদের এ মতামত ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে নবী (সা.) আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সে নবীর মূর্তি তৈরীকে মুসলমানরা কিভাবে মেনে নিতে পারে? হযরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রীষ্টান বিশপকে বললেন, “ আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।” খ্রীষ্টান নেতারা সকলে এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রীষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা.) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসন এর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারী গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।” একথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষ্মধারী তরবারী হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রীষ্টানেরা স্তম্ভিত। চারিদিকে থমথমে অবস্থা। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বললো, “আমিই দোষী, সিপাহ সালারের কোন অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি, এই, তা আমার হাতেই আছে। তবে মূর্তি ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিলো না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারীর নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিলো। স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তরবারী ছুঁড়ে দিয়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি! ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা.), যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভিক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যিশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। সেই মহান ও আদর্শ নবীকেও আমার সালাম জানাই।” পরধর্ম সহিষ্ণুতার এ জলন্ত উদাহরণ আজো বিশ্ববাসিকে হতবাক করে।
৩- হযরত আলী (রা.) যখন মুসলিম জাহানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সে সময়ে একবার তাঁর ঢাল চুরি হলো। চুরি করলো একজন ইহুদী। হযরত আলী (রা.) আদালতের শরণাপন্ন হলেন। বিচারপতি খলিফা হযরত আলী (রা.) এর কাছে সাক্ষী চাইলেন। সাক্ষী হিসেবে খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলে এবং চাকরকে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আপন সন্তান ও চাকরের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় কাজী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন। মুসলিম জাহানের অধিপতি হয়েও তিনি কোন বিশেষ বিবেচনা পেলেন না। ইসলামী আইনে শাসক-শাসিত, উঁচু-নীচু, শত্রু-মিত্র সকলেই সমান। ইহুদী বিচার দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো, অপূর্ব এই বিচার, ধন্য সেই বিধান যা খলিফাকে পর্যন্ত খাতির করেনা আর ধন্য সেই নবী যার প্রেরণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। হে খলিফাতুল মুসলিমীন, ঢালটি সত্যিই আপনার। আমিই তো চুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয় তার সাথে আমার জান-মাল, আমার সবকিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম।”
৪- হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম জিম্মিকে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। (আল বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান)
৫- অমুসলিমদের উপাসনালয় রক্ষায় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের জন্য তিনি একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জীবন ও সম্পদ, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না।
(তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)
৬- হযরত ওসমান (রা.) এর খেলাফত কালে হযরত ওমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে ফতোয়া দেয়া হয়। কেননা তিনি হযরত ওমর (রা.) এর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে অমুসলিম হরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে ছিলেন।
৭- হযরত আলী (রা.) আমলে একজন মুসলমান কর্তৃক জনৈক অমুসলিমকে হত্যার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। যথারীতি দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। সেসময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বলল, ‘আমি মাফ করে দিয়েছি।’
কিন্তু আলী (রা.) তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, ‘ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।’ সে বললো, ‘না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না।’ তখন তিনি খুনিকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন,
‘আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই এবং তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।’
(আল বুরহান, ২য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা)
উপরিউক্ত প্রতিটি ঘটনা ইসলামের সহনশীল দিকের ইতিবাচক দিকগুলো ফুটে তুলে। যে ইতিবাচক দিকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অগণিত অমুসলিম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অন্যন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
শেষ কথা:
অমুসলিমদের সাথে সুন্দর ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রক্ষার শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ইসলাম তাকিদের সাথে বারবার এ নির্দেশও দিয়েছে- ‘কোনো মুসলমান যেন কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে।’ এবং এ তাকিদও করেছে, সৌজন্য ও উদারতার নামে যেন নিজেদের দ্বীনদারি আক্রান্ত না হয়। দ্বীনের বিষয়ে আপোস করা কোনোক্রমেই বৈধ নয়। এমনিভাবে সদাচরণের ক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে মুসলিম ভাই থেকে প্রাধান্য দেওয়াও বৈধ নয়।
ইসলাম কোন ধর্মীয় উন্মাদনা, বিদ্বেষ, কিংবা পরমৎ অসহিষ্ণুতার নাম নয়। ইসলাম মানবতা, মনুষ্যত্ব, সাম্য ও শুভেচ্ছার নাম। ইসলামের আবেদন দেশ-কাল-বর্ণ- ভাষা কিংবা গোত্রের সীমানায় আবদ্ধ নয়। এর প্রীতি সর্বজনীন ও শাশ্বত। মানবতা যেখানে বিধ্বস্ত, ইসলাম সেখানে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিয়ে হাজির হয়েছে। কোরআনের ভাষায়, “মানুষ আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা জীব”।
ইসলামী সমাজে অমুসলিমদের জীবনযাত্রা, ধন-প্রাণের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা মুসলিম নাগরিকদের সমতুল্য।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তি দূর। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তিনি কারো প্রতি কোনো ধরণের পক্ষপাত মূলক আচরণ করেননি। কারো সঙ্গে আপোষ করেননি। অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করেনি।
মানুষ হিসেবে তিনি সবার প্রতি ছিলেন উদার ও উত্তম আচরণকারী। প্রতিবেশি যে-ই হোক অর্থাৎ মুসলিম কিংবা অমুসলিম তার অধিকারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন।
সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উদার নীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। ইসলামের সুমহান আদর্শগুলো গ্রহণ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরা। আর তাতে মুসলিম-অমুসলিম সব মানুষের কাছে পৌছে যাবে বিশ্বনবির সুমহান আদর্শ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অমুসলিমদের সঙ্গে আচার-আচরণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকনির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।