ভাষ্কর্য: রাষ্ট্র সংস্কৃতি ও ধর্ম

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৪ ২০২০, ১৫:৩৭

মানব বা যে কোনো প্রাণের মূর্তি ও ভাস্কর্য ইসলামের দৃষ্টিতে এক ও অভিন্ন। অভিধানগুলোতেও অভিন্ন অর্থ বলা হয়েছে। তাই ভিন্ন ভিন্ন দেখার কোনো অবকাশ নেই। উলামায়ে কেরাম কোরআন হাদিস এবং অভিধানের উপর ভিত্তি করে এক ও অভিন্ন বলছেন। যারা মূর্তি ও ভাস্কর্য ভিন্ন হওয়ার দাবি করেছেন, তাদের দাবির স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো দলিল-প্রমাণ পেশ করতে দেখা যায় না। তাদের কথা হলো যা পূজা-অর্চনার জন্য নির্মিত, তাই মূর্তি। আর তারা মূর্তি তৈরি করছেন না। আর যা স্মৃতি, স্মারক, স্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মিত হয়, তাই ভাস্কর্য। যেহেতু পূজা-আর্চনা উদ্দেশ্য নয়, তাই ভাস্কর্য নির্মাণে ইসলামে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এটি একটি খোঁড়া যুক্তি। এ বিশ্লেষণ তাদের মনগড়া। এমন বহু বিষয়ের বৈধতা দেওয়ার জন্য তথাকথিত মহল অযৌক্তিক কথা বলে থাকে। মূল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে অপ্রাসঙ্গিক কথার খৈ ফুটাতে থাকে। এটা তাদের চিরাচরিত বদ অভ্যাসে পরিণত হয়ে আছে।

মূর্তি ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপনের বিরোধিতা ওলামায়ে কেরাম সব সময় করে আসছেন। এটি নতুন কোন বিষয় নয়। এটার বিরোধিতা করা ওলামায়ে কেরামের ঈমানের দায়িত্বও বটে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের মূর্তি বা ভাস্কর্যের কারণে ওলামায়ে কেরাম বিরোধিতা করছেন, এমন মন্তব্য করা কোনো অবস্থাতেই সঠিক নয়। যুগ যুগ ধরে এই বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম কোরআন হাদিসের আলোকে আলোচনা করে আসছেন। কখনো কখনো এই বিষয়টি স্থান-কাল-পাত্রের কারণে বেশি আলোচিত হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো তথাকথিত মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য নিজেরাই এই ধরনের বিষয়গুলো হাইলাইট করে থাকে। নিজেদের একের পর এক অপকর্ম থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য এ ধরণের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যারা মূর্তি ভাস্কর্যকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন বলার অপপ্রচার চালায় তারা অনধিকার চর্চা করছেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ দেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা তারাই রাখে, যারা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ। যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দেয়া প্রতারণা, ধোঁকা ও শঠতা ছাড়া কিছুই নয়। তারা আইনের চোখে অপরাধী হিসেবে গণ্য।

মূর্তি, ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলা হলে বিভিন্ন মুসলিম দেশের দৃষ্টান্ত সম্মুখে টেনে আনা হয়। এ জাতীয় দৃষ্টান্ত পেশ করা বিজ্ঞতার পরিচায়ক নয়। এটি এক ধরনের সুবিধাবাদী নীতি। অন্যান্য বিষয়ে কিন্তু ওই সব দেশের উপমা টানা হয় না। নিজেদের অপকর্মের সাথে যে কর্মের মিল আছে কেবল তাই বলে বেড়ানো হয়। যেসব মুসলিম দেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা হয় ওইসব দেশও তো সুবিধাবাদী নীতি অনুসরণ করে থাকে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণ যোগ্য হলো কোরআন ও হাদিস। কোরআন হাদীসে যা নিষেধ করা হয়েছে তা যদি কোনো মুসলিম দেশ বা রাষ্ট্রপ্রধান করে তা কখনো অনুকরণীয় ও অনুসরণযোগ্য হতে পারে না। বরং সর্বাবস্থায় কোরআন হাদীস নিষিদ্ধ বিষয় পরিত্যাজ্য, পরিহার্য।

ভাস্কর্যের বৈধতার দাবিদাররা কোরআনে বর্ণিত ‘তিমসাল’ শব্দের ভুল ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে।পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ‘তামাসিল’ শব্দ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে মানুষ ও পশুর ছবি অর্থ প্রকাশ পায় না। বরং এ থেকে নিষ্প্রাণ ও জড় জিনিসের ছবিও বুঝা যায়। বিপুল সংখ্যক শক্তিশালী সনদযুক্ত হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি মুসলিমের জন্য প্রাণীজাতীয় কোনো কিছুর ছবি নির্মাণ ও সংরক্ষণকে চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।

মূলত আরবিতে প্রত্যেক ছবিকেই ‘তিমসাল’ বলা হয়, যা কোনো জিনিসের আকৃতির অনুরূপ তৈরি করা হয়, তা সপ্রাণ ও নিষ্প্রাণ হতে পারে। এ কারণে কোরআনে বর্ণিত হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্য যে ছবি তৈরি করা হতো তা মানুষ ও প্রাণীর ছবি অথবা ভাস্কর্য বা মূর্তি হওয়া অপরিহার্য ছিল না। তাই সুলাইমান আলাইহিস সালাম নিজের জন্য নির্মিত ইমারতগুলোতে যেসব ফুল-পাতা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও কারুকার্য শোভিত করেছিলেন, সেগুলোকেই পবিত্র কোরআনে ‘তামাসিল’ বলা হয়েছে। এমনটি ভাবাই হবে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। একজন নবী মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন, তা বিশ্বাস করাই হবে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। এছাড়াও হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শরীয়তের অনুসারী ছিলেন। মুসা আলাইহিস সালামের শরীয়তে প্রাণীর ছবি অংকন, মূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে হারাম ছিল। মূসা আলাইহিস সালামের শরীয়তের অনুসারী হয়ে নবী হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম কিভাবে মূর্তি নির্মাণ বা প্রাণীর ছবি অঙ্কন করে থাকবেন? এটা অবিশ্বাস্য।

হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহার অপূর্ণাঙ্গ আকৃতির পুতুল খেলার দলিল দিয়ে ভাস্কর্য হালাল করার অপচেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে তারা হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকেই বর্ণিত প্রাণীর চিত্রকর্মের নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করে না। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার শিশুকালের পুতুলের খেলাকে তারা দলিল হিসেবে পেশ করার অপচেষ্টা করে থাকে। আবার কাবা ঘরে মেরীর চিত্রকর্মের বহাল রাখার অসত্য, বানোয়াট কথা বলে ভাস্কর্যের বৈধতা দেয়ার চেষ্টায় কোনো অবহেলা করে না‌। তাদের এ ধরণের আচরণ সুস্পষ্টভাবে হারাম বিষয়কে বৈধতার শাড়ি পরানোর অপকৌশল মাত্র। পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে ইসলামী চাদরে ঢেকে দেয়ার চক্রান্ত বৈ কিছু নয়।

যখনই ওলামায়ে কেরাম অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোরআন হাদীসের আলোকে কথা বলেন, যুক্তি পেশ করেন, জোরালো বক্তব্য রাখেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ তোলা হয়।

আরো বলা হয় যে, উলামায়ে কেরাম উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে। উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। এটা তাদের পুরাতন রোগ। এ ব্যাধিতে তারা বহু আগ থেকেই আক্রান্ত। এছাড়াও তাদের বক্তব্য, মন্তব্য আরও কদর্য, আরও আক্রমণাত্মক ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক হওয়ায় তারা এই ধরণের আইন শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণ করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।

মূর্তি ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলায় একশ্রেণীর আতেল বুদ্ধিজীবীরা অপ্রাসঙ্গিকভাবে মাদ্রাসাগুলোতে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার অবতারণা করে থাকে। মূলত তাদের এই ধরণের আচরণ মূল বিষয় থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ফেরানোর অপচেষ্টা মাত্র। এ ধরণের অনৈতিক কর্মকাণ্ড স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী থেকে যখন প্রকাশ পায়, তখন তারা নিশ্চুপ প্রাণীর মতো আচরণ করে। টু শব্দ করতেও দেখা যায় না। তখন তারা বোবা শয়তানের ভূমিকা পালন করে। মিডিয়াগুলো নিরব নিশ্চুপ হয়ে যায়। বরং ক্ষেত্রবিশেষ তারা এজাতীয় কাজকে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। তাদের এমন আচরণ রহস্যজনক।

অনৈতিককে অনৈতিক বলতে হবে। চারিত্রিক পদস্খলনকে কোনভাবে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। চাই তা মাদ্রাসা থেকে হোক কিংবা স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পড়ুয়াদের দ্বারা সংগঠিত হোক। অপরাধ সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সমান। প্রত্যেকে নিজ নিজ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে।

ভাস্কর্যের বিরোধিতাকে কেউ কেউ অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ করে থাকেন। যখন মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটুক্তি করা হয়, ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশ করা হয়, সে সময় তো তাদেরকে কোনো কথা বলতে দেখা যায় না। ব্যঙ্গ করা, কটুক্তি করার মাধ্যমে মুসলমানদের হৃদয়ে যে আঘাত দেওয়া হয়, তাদের অনুভূতিতে যে আঘাত দেয়া হয় সে আঘাত প্রতিপক্ষ হিসেবে তারাই দেয়।

ওলামায়ে কেরাম যখনই পৌত্তলিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন, কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জাতির সম্মুখে পেশ করেন, তখন তারা বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় খোঁড়া অজুহাত পেশ করার পরও কোনো আপত্তি করা হয় না।

দেশজ সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। যুগের বিবর্তনে দেশীয় সংস্কৃতির মাঝে পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্মিত হয়। ধর্মীয় সংস্কৃতি এর বিপরীত। ধর্মীয় সংস্কৃতির মাঝে পরিবর্তন আসে না। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বের যে প্রান্তেই বসবাস করুক না কেন তারা অভিন্ন সংস্কৃতি ধারণ করে, পালন করে। কোনো দেশের সীমান্ত প্রাচীর অভিন্ন এ সংস্কৃতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্তরায় হতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতি কোরআন হাদিসের আলোকে বিনির্মিত। তাই যে সংস্কৃতি কোরআন হাদিস এর সাথে সাংঘর্ষিক, মুসলমানদের জন্য তা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য, পরিহার্য।