গাব্বু দ্য প্রফেসর

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ফেব্রুয়ারি ১১ ২০১৯, ১৩:১৬

নন্দিত নন্দিনী 

জাবের ভাই চলে যাচ্ছে। আমার বাসা থেকে বেরিয়ে গলির রাস্তায় উঠতে উঠতেই আমি এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। অপলক দৃষ্টিতে আগের মত করে তাকিয়ে আছি তার চলে যাবার দিকে। পার্থক্য শুধু জাবের ভাই সেদিনের মত বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। যার জন্য তাকাতেন সে ত আর নেই। আর সেদিন দাদীর চোখ ফাঁকি দিতে বারান্দায় থাকা গাছ গুলোকে যত্ন করতাম আমি আর রিবু। আজ পাশে রিবু নেই।দাদীর শাসনের চোখ আমাকে পাহারা দিচ্ছে না , তাই এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি। আর দেখছি জাবের ভাইয়ের চলে যাওয়া… হয়ত শেষবারের মত…..!

আমি ছিলাম প্রত্যন্ত এলাকার মেয়ে। কলেজে পড়ার জন্য আমাকে আমাদের মফস্বল শহরে একটা বাসা নিয়ে থাকতে হয়।কলেজের খুব কাছে আমরা একটা বাসায় ছয়জনে মিলে আস্তানা বানালাম। সেই বাসার ই মেয়ে ছিল রেবেকা ওরফে রিবু। রিবু ছিল আমাদের দুই ইয়ার সিনিয়র ।লেখাপড়া য় চূড়ান্ত অমনোযোগী ।এস,এস,সি তে দুইবার ফেল করে পরে আমাদের ইয়ারে পাস করে কলেজে ভর্তি হয়। রিবু আমাদের বয়সে বড় হলেও তাকে আমরা তুই করেই বলতাম। নাহলে সে ভীষন মন খারাপ করত। রিবু পড়াশোনায় যেমন অমনোযোগী চেহারায় তেমনি সুন্দরী । একটা মেয়ের রূপের যত প্রশংসা করা যায়, রিবুর তা ছিল। তাই ত মজনু-রোমিওদের আনাগোনা ছিল তার বাড়ির চারিদিকে । কাজের ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমে কোন না কোন গিফট আসে নি এমন দিন ছিল না। সব সে গ্রহন করত হাসি মুখে অথচ এর কোনটাই নিজে নিত না। যে হাতে করে আনত তাকেই দিয়ে দিত। না হয় অন্য কাউকে। আমরা অবাক হয়ে বলতাম, তুই যখন নিবিই না ,তাহলে গ্রহন করিস কেন?…

বলত,
— আমি এগুলো দিয়ে কি করব? আমি কি ফকিন্নি নাকি যে এগুলো ব্যবহার করব! নেই ত যে দেয় তাকে ঠান্ডা করার জন্য। যার টা না নিব সেই আব্বার কাছে গিয়ে ঝামেলা পাকাবে। সত্য-মিথ্যা বানিয়ে বলে আমাকে বিপাকে ফেলবে। তার চেয়ে দিচ্ছে দিক,পকেটে টাকা বেশি হয়ে গেছে যখন, আমার বাড়ির কাজের লোকের উপকার হবে। তারা ত এই লোভেই বয়ে আনে!!….
—তবে যে সেদিন একজনেরটা ফিরিয়ে দিতে দেখলাম?
—–ওর ব্যাপার আলাদা। ওর এত টাকা নাই। তাই আজাইরা টাকা খরচ করে যেন না দেয় ,এজন্যই ওর টা নেই না!!
—যারা দেয় তাদের বুঝি অনেক টাকা?

—তা না, তবে তাদের না হোক তাদের বাবা র টাকা খরচ করে।গাব্বু’র মা-বাবাও নেই।
—ছেলেটার নাম গাব্বু?… কি বিশ্রী নাম!! বাবা-মা নেই বলে এত বড় ছেলে তার একটা সুন্দর নাম থাকবে না! অথচ দেখতে ত মাশা আল্লাহ…
—–আরে না! গাব্বু নাম আমি দিয়েছি। ওর আসল নাম জাবের আলী । বাবা-মা নেই। নিঃসন্তান খালা-খালুর কাছে থাকে। খালুর অবস্থাও আবার আহামরি নয়। তার উপর খালুর ভাইয়ের ছেলেরা ওকে ভাল চোখে দেখে না। তাদের চাচার টা খায় বলে!
—আহারে!
—-জানিস, গাব্বু আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। আমি দুইবার ফেল মারলাম। ও এই দুই বছরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে গেল! আমি কলেজে আসতে আসতেই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেল…
—ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে! তবে যে প্রায়ই দেখি তোর বাড়ির আশেপাশেই ঘুর ঘুর করে!
—ঢাকাই থাকে। দুইদিন ছুটি পেলেই চলে আসে। সবাইকে বলে, ঢাকা ভাল লাগে না। আমি ত জানি কেন ভাল লাগে না! হি হি হি!!
—- ও আচ্ছা , তার মানে ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছিস!
—-না রে! পানি আমি চেয়ারে বসে পা দুলাতে দুলাতেই খেতে পারতাম।কিন্তু খাব না বলে যে পন করেছি,তা ভাঙ্গা যে মহা অন্যায় হবে!
—সে আবার কেমন?
—-একটা মেয়ের ভাললাগার সব উপাদান গাব্বুর আছে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। গাব্বু আমার মত ফেল্টু না। তার স্বপ্ন আছে…যা সত্য করতে হবে।
—তুই জানিস কিভাবে ওর কি স্বপ্ন আছে?
— ক্লাস এইটে একদিন স্যার আমেরিকার বড় বড় সব বিশ্ববিদ্যালয়র কথা বলছিলেন।তখন বললেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়র কথা।গাব্বু বলে উঠল–সে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। স্যার অবাক হলেন, আর আমরা খ্যাক খ্যাক করে পাতিশিয়ালের মত দল বেধে হাসলাম। কিন্তু গাব্বু হাসেনি, লজ্জা ও পায়নি। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম…ওকে পড়লাম….সে চোখে আত্মবিশ্বাস ছিল। গাব্বু কখনও পিছনে ফিরে না। আমার বিশ্বাস, সে একদিন সেখানে যাবেই।
—ভাল ত। তুইও যাবি।

—নারে, আমি থাকলে ও সেখানে যেতে পারবে না।
—-কেন পারবে না!…তুই পাশে থাকলে চলার পথ আরও সহজ হবে।
—-তোরা জানিস না, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সেই নাইন এ পড়া অবস্থায়। আমার দাদীর বোনের নাতির সাথে। নাম ফজল। ফজল ভাই ও দেখতে ভাল। বিএ পাস করে গ্রামে র পিন্ডি চটকাইয়া বেড়ায়।
—বেকার ছেলের সাথে বিয়ে!

—তার বাপের যে সম্পদ আছে তা তিন পুরুষ বসে খেলেও ফুরাবে না। এই ছেলের কাজ করা ত অপরাধ। নিত্যনতুন বাইকে পাম-পোম মেরে ইয়াংদের মাঝে নেতাগিরি ফলানোই তার কাজ। যাক, সেসব। আমি বিএ পাস করলে বিয়ে হবে ,এমন শর্ত থাকায় এখনই বিয়ে টা হচ্ছে না। আমি দুইবার ফেল করায় দু বছর আয়ু বেড়ে গেল… হা হা হা ।
—তার মানে তুই ইচ্ছা করেই লেখাপড়া করিস না!

—( মাথা নিচু করে)… তুই বলেছিস ঠিক আছে। আর কারও সামনে এসব বলিস না।
—ওকে, তুই গাব্বুর গল্পই বল। কেন গাব্বুকে এড়িয়ে যাস?

— এই বাইকওয়ালা নেতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে মানে গাব্বু কে বিয়ে করতে চাইলে আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে হবে। কিন্তু গাব্বু কি আমাকে বেয়ার করতে পারবে?

— কেন, তুই কি রাক্ষস, এত পরিমান খাস যে গাব্বু রোজকার করে আনতে পারবে না।
—-গাব্বু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ে। এখনি টিউশনি করে যা পায় শুনেছি তা দিয়ে বৌ দুই টাকে খাওয়াতে পারবে। কিন্তু কথা হল–বিয়ে মানেই কি শুধু বৌয়ের খাওয়া পরা?…বিয়ে মানে একটা দায়িত্ব । কিছু চাওয়া-পাওয়া। প্রথম প্রথম মনে হয় সব সয়ে নেব। কিছু চাইব না। কিন্তু এক সময় না পাওয়ার পাল্লা টা ভারি হতে হতে পরে তা অভিমানে পরিনত হয়। তখন না পাওয়া গুলোর হিসেব আসে।
–কিভাবে?

— ধর আজ থেকে পাঁচ বছর পর ও গাব্বু তার স্বপ্নে পৌছাতে পারল না ফলে সে তখনও আমার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভাবছে না। অথচ দেখ, আমার বিয়ের বয়স তখন পাঁচ!…বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে সংসারের খুটিনাটি অনেক বিষয় তখন সামনে আসবে।
—তুই না চাইলেই হল।

—এসব কথা প্রেমিকাদের মুখে মানায়। শুনতে ভাল শোনায়। স্ত্রী হয়ে গেলে তার মন আর জীবনের হিসেব আলাদা হয়ে যায়।
—তাহলে বলছিস, তুই গাব্বুকেও ভালবাসিস না?….

—ভালবাসা?… আগে তুই ভালবাসার সংজ্ঞা বল। ভালবাসা মানে যদি হয় তাকেই বিয়ে করে সংসার করতে হবে, তাহলে আমি গাব্বুকে ভালবাসি না। আর ভালবাসা মানে যদি হয় – তার সর্বত কল্যাণ কামনা , তাহলে গাব্বুকে আমার চেয়ে বেশি কেউ ভালবাসে না, বেশি ভালবাসতে পারবে না। কখনওই পারবে না।

—-জানিস মুন্নি, আমি স্বপ্ন দেখি—গাব্বু একদিন অনেক বড় হবে।তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।সেখানে প্রফেসর হবে। আমি দূর থেকে গাব্বু কে দেখব।সেদিন আমি নাইবা থাকলাম তার পাশে, তাতে কি!….বাবা-মা হারানো গাব্বু সমাজে সবার কাছে অনেক অবহেলা পেয়েছে। এমন কি খেলার মাঠেও মাথা নিচু করে থেকেছে…অন্যের বাড়িতে আশ্রিত বলে। আমি দেখতে চাই– গাব্বু একদিন নিজের পরিচয়ে মাথা উঁচু করে হাটছে। সেদিন নাইবা থাকলাম তার পাশে….তাতে কি!….
—-গাব্বুর আসল নাম বললি জাবের আলী ।তাহলে তুই ব্যঙ্গ করে এই গাব্বু-টাব্বু বলিস কেন?

— এটা একটা মজার আবার কষ্টের গল্প। আমাদের এই বাড়ি আগে ভাড়া দেয়া ছিল। আমি কলেজে উঠব বলে ভাড়াটিয়া সরিয়ে দিয়ে দু’বছর হল আমাদের পরিবার এখানে এসেছে। আমরা ছিলাম আমাদের শহরতলির গ্রামের বাড়িতে। আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই গাব্বুর খালাবাড়ি। গাব্বু ক্লাস টুতে এসে আমাদের বাড়ির পাশের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়। গাব্বুকে তার নিজের নামের ইংরেজি বানান টা কেউ শিখিয়ে দেবার ছিল না। তাই ছোট্ট গাব্বু জাবের লিখতে gaber লিখেছিল। আমাদের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন একটু অন্য-রকম। ছাত্রদের অপারগতা কে খুঁচিয়ে মজা পেতেন!গাব্বুর খাতায় এমন নাম দেখে তাকে সংশোধন করে দেয়ার চেয়ে জাবের কে “গাবের” বলে ডাকায় বেশি তৃপ্তি পেলেন! কিছুদিন অবশ্য সবাইই তাকে গাবের বলে ডাকত।পরে আসতে আসতে যখন তার লেখাপড়ার ধার বুঝে গেল তখন যারা তাকে হিংসা করত,তারা বাদে বাকি সবাই তাকে আপন করে নিল। আমি ও তখন থেকেই ওকে গাব্বু বলে ডাকি।
—ও আপত্তি করেনি?

—আপত্তি করলে ত আর ডাকা হত না। অবশ্য আমার সামনে আপত্তি করার সাহস ওর ছিল ই না। তবে একটু বড় হলে আমার মনে হত গাব্বু বললে ও খুশিই হয়…এরপর থেকে আমার জন্যই গাব্বু স্পেশাল নাম হয়ে যায়।
—-এখন ত সে অনেক বড়। অন্তত তোর থেকে, এখন পাল্টাতে পারিস।
—–কিসের বড়! ও যখন অক্সফোর্ডের প্রফেসর হবে সেদিন ও আমি বলব ,”গাব্বু-দ্য প্রফেসর ”
— যদি অক্সফোর্ড অব্দি না যায়…?
—-আমি ওর চোখে আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্ন দেখেছি। দৃঢ়তা দেখেছি।
—এত দৃঢ়তা দেখেছিস, তাহলে তুই পাত্তা না দিলেও তোর পিছে ঘুরে কেন?
—এই এক জায়গাতেই ওর দুর্বলতা । এজন্যই আমি দূরে সরে থাকি।যাতে তার কোন দূর্বলতা না থাকে।
—আচ্ছা, সবার গিফট নিস, ওর টা নিস না,ও যদি তোর বাবা কে এসব বলে দেয়?…
—আমার বিশ্বাস বলবে না। যদি কোন দিন বলে –সেদিন থেকে ওর টাও নিব, আর মতিভাই-কে দিয়ে দেব, তার বৌকে দেবার জন্য।হা হা হা…

আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি জাবের আলী ওরফে গাব্বু রিবু’র সব অবহেলা পাত্তা না দেয়া আর কটকটে আচরণ গুলো কত যত্নের সাথে গ্রহন করত। আর রিবু তার চেয়ে যত্নের সাথে গাব্বু কে এড়িয়ে যেত। গাব্বু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে রিবু’র সাথে কথা বলার।রিবু সে সুযোগ দেয়নি। পাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পায়!… আমরা রিবুকে গাব্বুর হয়ে বুঝিয়েছি। রিবু তার প্রতিজ্ঞায় অনড়। শুধু গাব্বু যখন রিবুর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেত ,নিজেকে আড়াল করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাব্বু কে দেখত রিবু। গাব্বুর কাছে ধরা পড়ার ভয় ছিল, সাথে ছিল দাদীর কড়া চোখ! বারান্দায় আমরা কাকে দেখছি ,তা তিনি খুব খেয়াল করতেন। আমরা গাছের সাথে কথা বলতে বলতে গাব্বুর চলে যাওয়া দেখতাম।গাব্বুও কি মনে করে বার বার পিছন ফিরত! গাব্বু কে শেষ দেখেছিলাম আমাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর। রিবুর বিয়ের দিন। রিবুর অনুরোধে আমরা সবাই ছিলাম সে অনুষ্ঠানে । হঠাৎ কাজের ছেলে মতিভাই রিবুর হাতে একটা চিরকুট দিল। রিবু চিরকুট না খুলে ভাজ করা কাগজের উপরে লিখে দিল—” গাব্বু, আমাকে আর কোন দিনও ডাকবি না। আমার সামনেও আসবি না। সব চেয়ে ভাল হয় যদি দূর থেকেও আমার দিকে না তাকাস!….রিবু।

আমরা তাজ্জব হয়ে দেখছিলাম রিবুর দৃঢ়তা । হাত কাপছে, তবু লিখে ফেলছে। চোখ থেকে যে ফোটা টা ঝরে পড়ল তা অশ্রু না আগুনের গোলা!…বল্লাম- পড়েও দেখলি না কি লিখেছে!
—আমি জানি ওতে কি লেখা। ও নিশ্চয় আশেপাশে কোথাও আছে।আমাকে দেখা করতে বলছে।
— আমরা যদি ব্যবস্থা করি?
—ক্ষেপেছিস? ওর সাথে এই মূহুর্তে দেখা করলে ও যদি একবার বলে “চল, পালিয়ে যাই”…. বিশ্বাস কর ,আমি ফিরে আসতে পারব না।আর বিয়ে বাড়ি থেকে কনে চুরি করে নিয়ে গেলে আমার বাবা ওকে কি করবে তোদের ধারনাই নাই। তার চেয়ে ও চলে যাক। আজকের পরে গাব্বুর সাথে কোনদিন তোদের দেখা হয়, আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিস।
সেইদিনের পর প্রায় চব্বিশ বছর পর দেখা হল – রিবুর “গাব্বু দ্য প্রফেসর” এর সাথে। গাব্বু – সরি, জাবের আলী এখন অক্সফোর্ডের টিচার।

দেশে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে । এত বছর পর গিয়েছিল খালার সেই ছোট্ট কুটিরে, সেখানে খালা-খালু নেই। তাদের সব কিছু দখল করেছে খালুর ভাইয়ের ছেলেরা। শুধু গাব্বুর পুরানো জিনিসপত্র রেখে দিয়েছে, যদি কোনদিন তার দরকার পড়লে চায়–এটা ভেবে। না এটা ভালবাসার টানে না। বরং সেই ভয়ে যে , গাব্বু এখন নিজের পরিচয়ে মাথা উঁচু করেই হাটে। পুরানো সেসবের মধ্যে কোন এক ডাইরিতে নাকি আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল! আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ই আমার বর্তমান ঠিকানা পেয়েছে। গাব্বু কে দেখে আমি যত না অবাক হয়েছি, তার চেয়ে অবাক হয়েছি– সে যখন আমাকে গাব্বু বলেই পরিচয় দিল!… যদিও সেদিনের সেই জাবের আলী আর আজকের গাব্বু-দ্য প্রফেসরের এত মিল যে আমি দেখেই চিনেছি জাবের আলী তথা আমাদের জাবের ভাই-কে।

পুরো বিকেলটা কাটল আমাদের সেসময়র স্মৃতিচারণ করে। আমি এক ফাকেঁ রিবুর কথামত তার হয়ে ক্ষমা চাইতে গেলেই থামিয়ে দিল জাবের ভাই। বলে, মুন্নি, ওর অপরাধ আমাকে উপেক্ষা করা না, আমাকে ভালবাসা!… তোমরা কতটুকু জান জানি না, তবে আমি ওর তীব্র রাগান্বিত চেহারার মাঝে ওর চোখে যে ভালবাসা দেখেছি তা অবজ্ঞা করার ক্ষমতা আমার ছিল না। তার শেষ প্রমান পেয়েছিলাম ওর বিয়ের দিন। আমি তাকে শেষবারের মত দেখা করতে বলেছিলাম, নিজের প্রতি আস্থা থাকলে সে সেদিন দেখা করত। কিন্তু সে জানত, গাব্বুর ডাক সে উপেক্ষা করতে পারবে না। তাই আসে নি। আমি তার কথা রেখেছি, কখনোই তাকে ডাকিনি। তার সামনে যাইনি। তবে দূর থেকে দেখেছি। অনেক বার। যতদিন দেশে ছিলাম। ওর আর আমার মাঝখানের এর দূরত্ব ই আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে ।জানো, ও যখন এস,এস,সি তে ফেল করল– আমি জিজ্ঞাসা করলাম–কিরে তুই ত ফেইল করবার মত ছাত্রী না। ফেইল করলি কেন? উত্তরে বলেছিল, তুই ত ফার্স্ট বয়। খুব ভাল রেজাল্ট করেছিস, আমাকে পড়াবি?

আমি বল্লাম- ধুর, ফাজলামি করিস না। ও বল্ল ,কেন তুই যখন অক্সফোর্ডের প্রফেসর হবি,তখন ত দেশবিদেশের কত্ত ছাত্রছাত্রী পড়বে, আমাকে দিয়েই শুরু কর। আমার তখন মনে হয়েছিল,আমার ছোট বেলার অক্সফোর্ডের টিচার হবার কথাটা ও খুব করে মনে রেখেছে। হয়ত চায়, আমি আমার কথাটা সত্য করি।যখন বুঝলাম সে আমাকে ভালবাসে অথচ বাস্তবতার খাতিরে আমার থেকে অনেক দূরে থাকে, তখন মনে হয়েছে ,একটা মেয়ে আমার স্বপ্ন সার্থক করতে নিজের সাথে এত ছলনা করছে, তার কথা আমাকে রাখতেই হবে। আমাকে অক্সফোর্ডের প্রফেসর হতেই হবে।….জানো মুন্নি ,পথ টা মোটেও সহজ ছিল না। যতবার বাধা এসেছে ,কিভাবে যেন পার হয়ে গেছি। এই দুনিয়ায় আমার এমন স্বজন নেই যে দুয়া করবে। দুঃসময় পার করে ঠিক ওর নাম টা মনে পড়ত! মনে হত, ও নিশ্চয় আমার জন্য দু’আ করছে!

বারান্দায় দাড়িয়ে জাবের ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখছি আর ভাবছি— কখনোই একান্ত কাছে না আসা ,পাশাপাশি না হাঁটা দুটো মানুষের পরষ্পরের প্রতি এত আস্থা, এত প্রেম, এত ত্যাগ, পরষ্পরকে এত বুঝত তারা!!!… এজন্যই বুঝি বলে –বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।
পরষ্পরের থেকে দূরে থেকেও ভাল থাকিস রিবু, ভাল থাকবেন জাবের ভাই–গাব্বু দ্য প্রফেসর ।