মাঝেমধ্যে নিজের অজ্ঞতা দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। প্রায়ই আবিষ্কার করি, অনেক আগে থেকে অন্যরা এমন অনেক কিছু জানে, যা আমি জানতাম না। এমনই একটি বিষয় হলো, ফরয নামাযের পরে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে নিয়মিত মোনাজাত করা। আমি ছোট থেকে ভোলার বিভিন্ন মাদরাসায় হিদায়াহ আউয়ালাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করি। ভোলার মাদরাসাগুলো হাটহাজারী মাদরাসার অনুকরণ করে। ফলে সে মাদরসাগুলোতে দেখে এসেছি এবং শুনে এসেছি, হাটহাজারী মাদরাসায় ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত মোনাজাত বিদয়াত মনে করা হয়। আমি দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হই ২০০৬ সালে। পড়াশোনা করি ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এই ৬ বছর ধরে আগের জানা মাসআলায় হাটহাজারী মাদরাসাকে অবিচল দেখতে পাই। এর ব্যতিক্রম মাসআলাও যে কওমী অঙ্গনে চর্চিত হয়ে আসছে, তখন আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। কয়েকদিন আগে সালাফীদের সঙ্গে কিছু কওমী তরুণের বিতর্ক হয়। বিষয়: ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মোনাজাত করা বিদয়াত কি না। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম (মূলত খেয়াল করে আশ্চর্য হলাম), কওমী তরুণদের অবস্থান বিদয়াত না হওয়ার পক্ষে। সালাফী মতাদর্শের সঙ্গে কওমীদের বেশ কিছু বিষয়ে গবেষণাগত মতবিরোধ আছে। সম্মিলিত মোনাজাতও যে তাদের সঙ্গে একটা মতবিরোধপূর্ণ বিষয়, সত্যি আমি জানতাম না। আমাদের বড়ভাই লাবীব আবদুল্লাহ এই সময়ে তর্কের চেয়ে ঐক্য জরুরি মর্মে একটি পোস্ট করে তোপের মুখে পড়েন। যাঁরা লাবীব আবদুল্লাহকে রীতিমত ‘ধুয়ে’ দেন, তাঁরা সবাই কওমী অঙ্গনের লোক। তাঁরা প্রায় সবাই সম্মিলিত মোনাজাত বিদয়াত না হওয়ার পক্ষে।
উত্তপ্ত উনুনের উপর ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো সবাই ফুটতে শুরু করেন, যখন আমাদের আরেক বড়ভাই শায়খ আহমাদুল্লাহ ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত মোনাজাত না করে মাসনূন দোয়া পাঠ করতে উৎসাহিত করেন। শায়খ আহমাদুল্লাহ ভাইয়ের চিন্তাচর্চায় সালাফী ও দেওবন্দী ঘরানার মিলিত অবদান রয়েছে। তিনি পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের হাটহাজারী ও মেখল মাদরাসায়। পড়িয়েছেন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কওমী মাদরাসায়—আরজাবাদ ও দারুর রাশাদ। এরপর দীর্ঘদিন সৌদি আরবের ইসলামিক সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ একটা ব্যাপার আছে।
ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম, দারুল উলূম দেওবন্দে সম্মিলিত মোনাজাত করা হয়। দেওবন্দের কথা শুনে নড়েচড়ে বসতে হলো। হাটহাজারী মাদরাসা দেওবন্দের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত। এতদসত্ত্বেও দু’টি প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্রভাবে চালিত হওয়ায় অমৌলিক দু’-একটা বিষয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। ভিন্নমতের ক্ষেত্রে সবাই দারুল উলূম দেওবন্দের মাসআলাই বেশি গ্রহণ করে। কারণ দেওবন্দের গবেষণার মান নিঃসন্দেহে হাটহাজারী মাদরাসার চেয়ে ভালো।
মাসআলা যেটাই ‘অধিক শুদ্ধ’ হোক এটা তো নিশ্চিত যে, শায়খ আহমাদুল্লাহ নতুন কিছু বলেন নি। তিনি আজ যা বললেন, হাটহাজারী মাদরাসা ও মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ.-এর অবস্থান এ-ই। এ-কারণে শায়খ আহমাদুল্লাহকে ‘ধুয়ে দেয়া’র মজেজা বুঝলাম না। আহমাদুল্লাহ ভাই যদি ভুলও বলেন, দেওবন্দে চর্চিত মাসআলার বিপরীতও যদি বলেন—এজন্য তাঁকে ধুয়ে দেয়ার আগে হাটহাজারী মাদরাসা ও মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ.-কে ধুয়ে দেয়া উচিত। শায়খ আহমাদুল্লাহর জন্মেরও আগে মুফতী ফয়যুল্লাহ এটিকে বিদয়াত বলেছেন।
এই মাসআলায় দেওবন্দ ও হাটহাজারী মাদরাসার বিরোধ আলোচনার যোগ্যই নয়। এটি একেবারে অমৌলিক ও খুব ঠুনকো একটি বিষয়। তারপরও বিশেষভাবে এই ক্ষেত্রে হাটহাজারী মাদরাসার অবস্থানই আমার কাছে শক্তিশালী মনে হচ্ছে। হাটহাজারী মাদরাসা ও এই মাদরাসার অন্যতম চিন্তাগুরু মুফতী ফয়যুল্লাহর অবস্থান হলো— (১) ফরয নামাযের পরে (২) হাত তুলে (৩) সম্মিলিতভাবে (৪) নিয়মিত মোনাজাত করা বিদয়াত। শর্তগুলো খেয়াল করুন। সবগুলো শর্ত একত্রে পাওয়া গেলেই শুধু বিদয়াত। এসব শর্তের কোনো একটা অনুপস্থিত থাকলে বিদয়াত নয়। স্রেফ একটা পন্থায় বিদয়াত। এছাড়া আর যত পন্থা আছে, তাতে বিদয়াত হবে না। যেমন:
১. ফরয নামাযের পর একা একা হাত না তুলে অনিয়মিত মোনাজাত করা
২. ফরয নামাযের পর একা একা হাত তুলে অনিয়মিত মোনাজাত করা
৩. ফরয নামাযের পর একা একা হাত না তুলে নিয়মিত মোনাজাত করা
৪. ফরয নামাযের পর একা একা হাত তুলে নিয়মিত মোনাজাত করা
৫. ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত না তুলে অনিয়মিত মোনাজাত করা
৬. ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে অনিয়মিত মোনাজাত করা বিদয়াত নয়।
বর্তমান সময়ের অন্যতম বিজ্ঞ আলেম মাওলানা আবদুল মালেক হাফিযাহুল্লাহর একটা লেখা সম্মিলিত মোনাজাত প্রমাণ করার জন্য অনেকে পেশ করেছে। আমি লেখাটা পড়ে বুঝেছি, তিনি দালিলিকভাবে সম্মিলিত মোনাজাত সাব্যস্ত করেছেন। তবে ফরয নামাযের পরে সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে ‘নিয়মিত’ মোনাজাত সম্পর্কে তিনি কিছু বলেন নি। ফলে তাঁর অবস্থানের সঙ্গে মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ.-এর অবস্থানের বিরোধ নেই।
যাঁরা ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে নিয়মিত মোনাজাত করা বিদয়াত নয় বরং মুস্তাহাব বলছেন, আমার জানামতে তাঁদের দলিল হলো—
১. আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত,
عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: مَا مِنْ عَبْدٍ بَسَطَ كَفَّيْهِ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ، ثُمَّ يَقُولُ: اللَّهُمَّ إِلَهِي وَإِلَهَ إِبْرَاهِيمَ … إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ لَا يَرُدَّ يَدَيْهِ خَائِبَتَيْنِ
(মর্মার্থ) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে বান্দা প্রত্যেক নামাযের পরে হাত সম্প্রসারিত করে দোয়া করে, আল্লাহর জন্য জরুরি যে তার হাত নিষ্ফল ফেরত না দেয়া। (আমালুল-ইয়াউম ওয়াল-লাইলাহ ১/১২১)
২. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفَعَ يَدَهُ بَعْدَ مَا سَلَّمَ، وَهُوَ مُسْتَقْبَلٌ الْقِبْلَةَ فَقَالَ: اللَّهُمَّ خَلِّصِ الْوَلِيدَ بْنَ الْوَلِيدِ…
(মর্মার্থ) রাসূলুল্লাহ সা. সালাম ফেরানোর পর কিবলার দিকে ফিরে হাত তুলে দোয়া করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর ২/৩৯০)
৩. আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রা. থেকে বর্ণিত,
أن رجلاً رفع يديه بالدعاء قبل أن ينتهي من صلاته ، فلما فرغ قال له عبد الله : إن النبي صلى الله عليه وسلم لم يكن يرفع يديه بالدعاء إلا بعد أن يفرغ من صلاته
একব্যক্তি নামায শেষ হওয়ার আগে হাত তুলে দোয়া করলেন। নামায শেষ হওয়ার পর আবদুল্লাহ বিন যুবাইর তাঁকে বললেন, নবী সা. কখনো নামায শেষ হওয়ার আগে দোয়ার জন্য হাত তুলতেন না।
খেয়াল করে দেখুন, এর কোনো একটা দলিল দ্বারাও ‘নিয়মিত’ মোনাজাত করা সাব্যস্ত হয় না। ফরয নামাযের পর সম্মিলিত বা একা একা মোনাজাত করার বিরোধিতা তো কেউ করছে না, শায়খ আহমাদুল্লাহও তা বলছেন না। এটাকে একমাত্র নিয়ম বানিয়ে ফেলা নিয়ে মতানৈক্য।
অন্যদিকে যাঁরা ফরয নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে নিয়মিত মোনাজাত করার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের দলিলগুলো দেখুন। তাহলে আপনারা সহজেই তুলনা করতে পারবেন।
১. আনাস রা. থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي شَيْءٍ مِنَ الدُّعَاءِ إِلَّا فِي الِاسْتِسْقَاء
রাসূলুল্লাহ সা. ইস্তিসকা ছাড়া কখনো দোয়ার সময় হাত তোলেন নি। (মুসনাদ আবি ইয়া’লা ৫/৩৩৩, সুনান দারা কুতনী ২/৪২৬,
২. সাওবান রা. থেকে বর্ণিত,
قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذَا انْصَرَفَ مِنْ صَلَاتِهِ اسْتَغْفَرَ ثَلَاثًا وَقَالَ: اللهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ، تَبَارَكْتَ ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
রাসূলুল্লাহ সা. যখন নামায শেষ করতেন, তিনবার ইস্তেগফার করতেন এবং আল্লাহুম্মা আনতাস-সালামা ওয়া মিনকাস-সালাম এই দোয়াটা পড়তেন। (সহীহ মুসলিম ১/৪১৪)
ইস্তেগফারও মূলত দোয়া। কিন্তু আমরা যেভাবে হাত তুলে দোয়া করি, এতে সেরকম দোয়া বোঝায় না। এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আওযায়ী বলেছেন, ইস্তেগফার মানে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়া। আমাদের প্রচলিত মোনাজাতের ধরন এটা নয়।
৩. মুয়াবিয়া রা. থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ، إِذَا فَرَغَ مِنَ الصَّلَاةِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
রাসূলুল্লাহ সা. নামায শেষ করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু… দোয়াটি পড়তেন। (সহীহ মুসলিম ১/৪১৪)
এছাড়াও বেশ কিছু দোয়া ও যিকির রাসূল সা. থেকে বর্ণিত যে, এসবের ওপর তিনি নিয়মিত আমল করতেন।
এই সবগুলো হাদীসে নিত্যবৃত্ত অতীতকাল ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো রাসূল সা.-এর নিয়মিত আমল ছিল। রাসূল সা. যে দোয়া করতেন, তাও বর্ণিত আছে। তবে তা আমাদের মতো অনির্ধারিত নয়। হাদীসের ভাষ্যে নিত্যবৃত্ত অতীতকাল ব্যবহার দেখে বোঝা যায়, নির্ধারিত কিছু দোয়াই রাসূল সা. নিয়মিত করতেন। অন্যদিকে মোনাজাতের হাদীসগুলোতে এই ধরনের শব্দ নেই। সুতরাং যদি ধরেও নিই রাসূল মোনাজাত করেছেন, তা তাঁর নিয়মিত আমল ছিল না।
এ-বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে, ফরয নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলত মোনাজাত মুস্তাহাব হলেও উত্তম ও সুন্নাহ হলো, হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নির্দিষ্ট দোয়া ও যিকির পাঠ করা। যা সর্বসম্মতিক্রমে উত্তম তা ছেড়ে জায়েয বা সর্বোচ্চ মুস্তাহাবের জন্য অনলাইন-যুদ্ধের যৌক্তিকতা আমি বুঝতে পারছি না।
পুনশ্চ: অনেকে ভুল বুঝবেন না যেন। মোনাজাত করা যে সাওয়াবের কাজ, এ-ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই। একটি হাদীসের ভাষ্যমতে দোয়া করা সমস্ত ইবাদতের মুল। দোয়া করা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। তর্ক হলো, ফরয নামাযের পরে হাত তুলে সম্মিলিতভাবে নিয়মিত মোনাজাত করা ও একে অনিবার্য মনে করা নিয়ে।

আবুল কাসেম আদিল॥ ১১-০৬-২০২০।