গণিতের প্রথম পাঠ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ০৯ ২০২০, ২৩:১৬

ইফতেখার জামিল


১) যে কারণে মাদরাসায় গণিত চর্চা নেই

যারা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়েছেন, তাদের সবাই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিতের সাথে পরিচিত। তবে যারা কওমি মাদরাসায় পড়েছেন, তাদের অধিকাংশই পাটিগণিতের বেশী জানেন না। কেননা অধিকাংশ মাদরাসায় ষষ্ঠ বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত গণিত পড়ানো হয়। তবে গুরুত্ব কম থাকায় এই পর্যন্তও খুব ভালো করে পড়া হয়ে উঠে না। বীজগণিত ও ডাটাএনালাইসিস ছাড়া একটা শিক্ষাব্যবস্থা চলে কীভাবে, আপনি অবাক হয়ে এই প্রশ্ন করতে পারেন।
বাস্তবতা হচ্ছে, মুসলিম ইতিহাসে জ্ঞানচর্চার তরিকা হিসেবে মানতেক ও উসুলে ফিকাহকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গণিতের চর্চা ছিল না, তা নয়, তবে ইসলামী জ্ঞানকাণ্ডের প্রধান প্রধান শাখার সাথে সম্পর্ক কম থাকায় এতে গুরুত্ব কম দেওয়া হয়েছে। মাদরাসায় সিলেবাসের প্রয়োজনে কাটছাঁট করায় গণিতের গুরুত্ব আরও কমেছে। এভাবে মুসলিম গণিত চর্চার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
আগেই বলে রাখা ভালো, এই লেখাটি মাদরাসার ছাত্রদের জন্য, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় যারা পড়েন বা পড়েছেন, তারা এই লেখা থেকে খুব বেশী উপকৃত হতে পারবেন না। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার অনেকে আরবি শিক্ষার বিষয়ে প্রাথমিক নোট লেখেন, যার কিছু অংশ আবার আমাদের কাছে অতি সরল বা ‘বেঠিক’ মনে হয়, এই লেখায় এমন কিছু পেলেও আশা করি অবাক হবেন না। আমি অনেকটা ব্যক্তিগতভাবে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের গণিত শেখার চেষ্টা করেছি, সে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বলতে চাই।

২) গণিত কেন প্রয়োজনীয়?

গণিতকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। মাদরাসায় আমাদেরকে সাংকেতিক যুক্তিবিদ্যা পাঠের ভূমিকায় কিছু কথা বলা হয়, যেটা আমরা গণিতের ক্ষেত্রেও বলতে পারি। যুক্তিকাঠামোতে ( সে আরোহী ও অবরোহী ) আপনি যদি ঠিকঠাক সাংকেতিক চিহ্ন বসিয়ে যেতে পারেন, তাহলে তার মাধ্যমে কোন অনুসিদ্ধান্তে পৌছা সম্ভব। গণিতেও আপনি আপনার চিন্তাকে সবচেয়ে বিমূর্ত কাঠামোতে নিয়ে যেতে পারেন, তাতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহজ হয়ে যায়। যাকে আপনি আবার চিত্র ও সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন।
অর্থাৎ গণিত আপনাকে প্যাটার্ন ও কানেকশন বুঝতে সহযোগিতা করে। কারখানায় অনেক উৎপাদন হলেও মূলে থাকে একটা নির্দিষ্ট নকশা। তার আদলেই বাকী সব উৎপাদন সম্পন্ন হয়। গণিতের প্যাটার্ন ও কানেকশন অনুসন্ধানের মানে কারখানার মূল নকশার চেষ্টার মতোই, বিশেষ বস্তু ও ঘটনাকে বিমূর্ত ও সাধারণীকরণের মাধ্যমে তার প্যাটার্ন ও কানেকশন বুঝার চেষ্টা। যুক্তিবিদ্যাও একই কাজ করার চেষ্টা করে। তবে এত ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ উপায়ে করতে সক্ষম হয় না। এ জন্য বলা হয়, ভবিষ্যতে গণিত যুক্তিবিদ্যার স্থান দখল করে নিবে।
পদার্থ ও রসায়নের মৌলিক অনেক সূত্র গণিতের সাহায্য ছাড়া বুঝা সহজ নয়। কেমিক্যাল ইকুয়েশন, স্পীড বা এনার্জির মতো সাধারণ বিষয়গুলো বুঝতেও গণিতের সাহায্য দরকার। অর্থনীতি বা সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়তে গেলেও অনেক সময় গ্রাফ ও ইকুয়েশন দেওয়া থাকে। আনু মুহাম্মদের অর্থশাস্ত্রের মূলনীতি ও জাফর ইকবালের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ বইদুটো হেদাতুননাহুতে থাকতে পড়ার চেষ্টা করি। তবে ইকুয়েশন ও গ্রাফ না বুঝায় বইদুটো শেষ করতে পারিনি। অনেকে মনে করেন, ভাষা জানলেই বুঝি আপনি সব বুঝবেন, আদতে ভাষার পাশাপাশি সহযোগী জ্ঞান না থাকলে অনেক বই পড়া যায় না।

৩) প্রাথমিক গণিত কীভাবে শিখবেন?

এখন আপনি চাইলে অনলাইনেও মৌলিক গণিত শিখতে পারেন। প্রথমেই ইউটিউব থেকে mathantics এর সব ভিডিও টেনেটেনে দেখে ফেলতে পারেন। যেসব টপিক জটিল লাগবে, সেটা একাধিকবার দেখলেন। মাদরাসা থেকে অনেকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়তে যান, দ্রুততার জন্য কিছু ফর্মুলা শিখে মুখস্থ গণিত সমাধান করার চেষ্টা করেন। এর বিপদ অনেক। ফর্মুলা আপনার সময় বাঁচাবে, তবে ফর্মুলা শেখার আগে মৌলিকভাবে টপিকটা বুঝে ফেলা দরকার। নয়তো দেখা যাবে, একটু এদিক-অদিক হলেই আপনি আর সমাধান করতে পারছেন না।
পরবর্তীতে খান একাডেমীর সাহায্য নিতে পারেন। খান একাডেমী ঠিকঠাক মতো অনুসরণ করলে বই পড়ার চাইতেও বেশী উপকার পাবেন। প্রথমে প্রি আলজেব্রা, পরবর্তীতে আলজেব্রা ওয়ান ও টু পড়তে পারেন। একটু সময় হয়তো লাগবে, তবে তাতে আপনি প্রি ক্যালকুলাস ও ক্যালকুলাস স্টেজে পৌঁছে যাবেন। খান একাডেমীতে প্রথমে মূল টপিকের আইডিয়া পাবেন। পরবর্তীতে সেই টপিকে অনুশীলন করতে পারেন। এর মধ্যে লিনিয়ার ইকুয়েশনে তেমন জটিলতা নেই। ঠিকঠাক মতো ভিডিও দেখে গেলেই এর সমাধান করা সম্ভব। তবে যারা নতুন শিখছেন, তাদের জন্য কোয়াড্রেটিক, পলিনমিয়াল ও রেশনাল ইকুয়েশনে কিছু সমস্যা হয়। আমারও সমস্যা আছে। তবে আশা করি ঠিকঠাক অনুশীলন করতে পারলে সমস্যা অনেক কমে আসবে।
এখানে মনে রাখা ভালো, বীজগণিত একটা ভাষার মতো কাজ করে, তাই এর ভাষাগত প্যাটার্ন বুঝে নেওয়া ভালো। নয়তো কোন বাস্তবচিত্রকে বীজগাণিতিক ভাষায় রুপান্তর করে সমাধান করা কঠিন হয়ে যায়। ধরা যাক, একটা ফুটবল বল বা রকেটের গতিপথের ইকুয়েশন সমাধানের জন্য বলা হল। গাণিতিক ইকুয়েশন দেওয়া থাকলে এর সমাধান করা হয়তো কঠিন নয়। তবে তথ্য থেকে ইকুয়েশন বানিয়ে সমাধান করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে যায়। বস্তুত যারা পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গণিত পড়েননি, তাদের অনুশীলনীতে অনেক খুত থেকে যায়। এক্ষেত্রে খান একাডেমী আপনাকে অনেক সাহায্য করবে। আপনার দুর্বলতা ঠিক কোথায়, সেটাও তারা আপনাকে দেখিয়ে দিবে। আরও বিস্তারিত অনুশীলনীর জন্য ইউটিউব থেকে organic chemistry tutor এর ভিডিও থেকে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ম্যাথ ইজ ফান ওয়েবসাইট থেকেও প্রাথমিক গণিত শিখতে পারেন।

৪) গণিত ঠিক কীভাবে প্রয়োগ করা যাবে?

আমরা যারা তালিবে ইলম, ধর্মীয় প্রশ্ন ও বিষয়ে বিশেষায়িত পড়াশোনায় আগ্রহী, তারা বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে বা প্যাটার্ন বুঝাতে গণিতের ব্যবহার করতে পারেন। আপনি কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় নৈতিকতা প্রয়োগ করতে চাইলে তার বাস্তব চিত্র বুঝতে হবে। বাস্তবচিত্র বা প্যাটার্ন বুঝার জন্য চিত্র বা সমীকরণ ব্যবহারের সুযোগ আছে। বিশেষত ডাটাএনালাইসিসের ক্ষেত্রে গণিতের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা গত বিশ বছরে কীভাবে বেড়েছে, এটা বুঝানোর জন্য কোন চিত্র আঁকলে অনেক ক্ষেত্রে সরল-সমীকরণের মাধ্যমে এর একটা সাধারণ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব।
মূলকথা হচ্ছে, প্যাটার্ন বুঝার জন্য গণিতের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। তাতে চিন্তার বিমূর্তকরণ সম্ভব হবে, পাশাপাশি ব্যাপক উৎপাদনও সম্ভব হবে। গণিতের ব্যবহার বাড়ানোর মানে কারখানার মূল নকশার অনুসন্ধানের মতো, অসংখ্য বিশেষায়িত বস্তু, তথ্য ও ঘটনা থেকে সাধারণ সূত্র বের করার চেষ্টা। কেউ কেউ বলতে পারেন, গণিত তো প্যাটার্ন মেনে চলে, ইসলামী চিন্ত তো আল্লাহর বিধিনিষেধ, এটাতে প্যাটার্ন ব্যবহার করার সুযোগ কোথায়? এর উত্তর হচ্ছে, ইসলামী চিন্তা মূলত কোরআন ও হাদিসের থেকে সংগ্রহীত ইল্লত বা সাধারণসূত্রের ভিত্তিতে চলে। ফলে এখানে সাধারণীকরণের সুযোগ আছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের অন্য শাখার মতো গণিতের সত্য পরিবর্তনযোগ্য নয়, সাধারণভাবে* এর সূত্রগুলো অনুমান নির্ভর নয়।
কিছুদিন আগে আমি ক্ষমতার সাথে আলেম সমাজের সম্পর্ক ও জনসাধারণের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ার সমীকরণ ও চিত্র বের করার চেষ্টা করি। ব্যাপারটাকে আমার অর্থনীতির বিজনেস সাইকেলের মতো মনে হয়। ছোটভাই আহনাফ সাদকে আইডিয়া দিলে সে এটা বের করার চেষ্টা করে। কমেন্টে চিত্রটা দিচ্ছি। এটা কোন সফল কাজ নয়। তবে বলে রাখা ভালো, এমন অনেক কমপ্লেক্স আইডিয়া আপনি সমীকরণ ও চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারবেন। এটাই গণিতের সার্থকতা। বিমূর্তায়ন।


লেখক: আলেম, লেখক, গবেষক, সম্পাদক: ফাতেহ২৪