১০ বিভাগীয় মহাসমাবেশ থেকে কী পেলো বিএনপি? 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ১১ ২০২২, ১২:২৮

সৈয়দ শামছুল হুদা: ধারাবাহিক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বিএনপি তাদের নির্ধারিত ১০ বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করেছে। যুগপৎ আন্দোলনের নতুন ১০ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। ১০ টি বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যে ১০ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার এর সমাবেশটি ছিল অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। অনেক চড়াই- উৎড়াই পার হয়ে সমাবেশ সফলভাবেই সমাপ্ত হয়েছে। এখন সময় হয়েছে পর্যালোচনার। এসব মহাসমাবেশ থেকে কী পেলো বিএনপি? কী পেলো সারাদেশের সাধারণ কর্মীরা ?

অর্জনটা বুঝতে হলে প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হবে। প্রায় ১৪ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। বিপরীত দিকে বর্তমান সরকার এই ১৪ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ও আধিপত্য বিস্তারে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছে। কোনো প্রকার রাখ-ঢাক না রেখেই প্রশাসনকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করেছে। বিচারবিভাগ, সামরিক বিভাগ, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগসহ অন্যান্য সকল বাহিনীকে একেবারে শতভাগ নিজেদের মতো করে সাজাতে সক্ষম হয়েছে। বিরোধী মতের সকল দলকেই প্রায় নেতৃত্বহীন করে দিয়েছে। যে দেশে ব্যক্তি নির্ভর রাজনীতি চলে, সেই দেশে বিএনপির প্রধান দুই শীর্ষ নেতাই অবরুদ্ধ ও প্রবাস জীবনে বাধ্য হয়েছে। এহেন অবস্থায় আজকে বিএনপির সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, তারা কর্মীদেরকে ধরে রাখতে পেরেছে এবং সম্পূর্ণরূপে চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে।

সমাবেশগুলোর আগের একটি চিত্রের কথা বলি, বিএনপির মতো বিশাল দলের মহাসচিব সদ্য প্রসূত একটি শিশু দল, যাদের নির্বাচনী কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, দলের রেজিষ্ট্রেশনও নেই, সেই দলের মহাসচিব যখন বক্তব্য রাখছিল, তখন ফখরুল সাহেব তার মাইকটা বারবার ঠিক করে দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বিএনপি কতটা খাদে পড়েছে। কতটা অসহায়। যদিও এটা ভদ্রতার ব্যাপার। ফখরুল সাহেব নিরেট একজন ভদ্র ও সজ্জন মানুষ। তদুপরি তিনিতো বিএনপির মতো একটি দলের মহাসচিব। ছোট্ট একটি দলের অফিসেও তিনি ছুটে গেছেন। তাদেরকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়েছেন। সেই দিনটি থেকে বিগত এক-দেড়মাসে ফখরুল সাহেবের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতায় তিনি যথেষ্ট পরিপক্ষতা দেখিয়েছেন। দল হিসেবে বিএনপি দেশি ও বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করতে সামর্থ হয়েছে।

নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারি সরকারকে দিনক্ষণ ঠিক করে কোনো বিরোধী দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফেলে দিবে- যারা এমনটা মনে করে ১০ তারিখের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন তারা হয়তো হতাশ হয়েছেন। কিন্তু যারা রাজনীতি বুঝেন, যারা বিএনপির এই ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থ বুঝেন, তারা বুঝতে পারছেন যে, ১০টি বিভাগীয় সম্মেলন সফলভাবে সমাপ্ত করার মাধ্যমে তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত কতটা উচ্চতায় পৌঁছেছে দলটি। ২ মাস আগেও বিএনপির এই অবস্থান ছিল না।

বিএনপিতে সবচেয়ে বড় সঙ্কট ছিল নেতৃত্বের। খালেদা জিয়া জেলে বন্দি। তারেক রহমান বিদেশে। এটা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই নানা কথা চলমান ছিল। সরকার বারবার খুচাতো। কিন্তু এই বিএনপিতে তারেক রহমান এর একক নেতৃত্ব বিএনপির সকল নেতারা মেনে নিয়েছে। বিএনপিতে তারেক রহমানকে নিয়ে এখন আর কোনো অস্বস্তি নেই। হীনমণ্যতা নেই। এটাই বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

বিএনপির জন্য সঙ্কট হলো, বর্তমান সরকারের স্যাটাপ। সরকার রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরের প্রতিটি মানুষকে এমনভাবে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছে- যার সুযোগ নিয়ে প্রতিটি অফিসার এখন কোটি কোটি, শত কোটি টাকার মালিক। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে চাইলেও তারা এখন তাকে ছাড়তে চাইছে না। কারণ তারাও বিগত ১৪ বছরে এত বেশি পরিমাণে দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে, যে কারণে তারা ভরসা পাচ্ছে না- এই সরকার না থাকলে তাদের ‍উপায় কী হবে? প্রশাসনকে দুর্নীতির সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার জন্য সরকার তাদের অবাধ সুযোগ দিয়েছে। তারা সেই সুযোগ লুফে নিয়েছে। দু হাতে জনগণের রক্ত চুষেছে। এখন সেই জনতা রাজপথে নেমে এসেছে। সত্যিই যদি জনতার ভোটে সরকার গঠিত হয়, তখন সেই লোকগুলো কোথায় পালাবে? রাজনীতিবিদরাতো কেউ দেশ ছাড়বে, কেউ আত্মগোপনে যাবে, কেউ আতাঁতের পথ বেছে নিবে। কিন্তু প্রশাসনের সেই সব সীমাহীন দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীটি চরম বিপদে পড়বে। এটা বিএনপির ক্ষমতায় আসার পথে বড় একটি বাধা। এই বাধা অতিক্রম না করা পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলনে চাঙ্গারূপ দেখা যাবে না। চোখে পড়বে না।

বিএনপির জন্য আরো একটি সমস্যা হলো, এদেশের ইসলামী দলগুলো বিশেষ করে কওমী ধারার দলগুলো সবসময় তাদেরকেই সঙ্গ দিয়ে এসেছে। ৪ দলীয় জোট সরকারে থাকার সময় বিএনপি এদেরকে যথেষ্ট মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এরফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ আছে। সেই ক্ষোভটাকে কাজে লাগিয়ে এবং কিছুটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করে ইসলামী ধারার শক্তিটাকে এতটাই কোণঠাসা করেছে বর্তমান সরকার, যে কারণে তারা এখন গোপনেও বিএনপির সাথে বসার সাহস পাচ্ছে না। একদিকে নানা কৌশলে বিএনপির সাথে এদের দূরত্ব তৈরি করেছে, অপরদিকে হেফাজত ইস্যুতে সরকার এতই শক্ত রাজনৈতিক ঢলা দিছে আলেম-উলামাদের ওপর, যেটা সামলে উঠার ক্ষমতা এখনো তাদের হয়ে উঠেনি। অনেক দলের আমীর বা মহাসচিব হয়তো কোনো মসজিদের ইমাম, অথবা কোনো মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। বর্তমান সরকার কওমী ধারার দলগুলোর ভেতরগত দুর্বলতা বুঝে গেছে। এদের পেছনে সরকারের গোয়েন্দা শক্তিকে কঠোরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ আলেম-উলামাগণ বিরোধী দলীয় আন্দোলনকে সমর্থন করলেও প্রকাশ্যে তারা কিছু বলতে পারছিল না। বিভাগীয় সমাবেশগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়ায় এখন আলেম-উলামাগণও বিএনপিকে কিছুটা মূল্যায়ন করবে। উলামাদের মধ্যেও তাদের প্রতি সিমপ্যাথি বৃদ্ধি পাবে।

বিএনপি সারাদেশে একটি নিরঙ্কুশ একক নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এসব বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে। তারা এটা যাচাই করে নিতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা এই কর্মীবাহিনী নিয়ে কতদূর যেতে পারবে। এটা তারেক রহমান এর জন্য দরকার ছিল। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এখন তারেক রহমান এর একক নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। যে কারণে ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ওপর দিয়ে এত বড় ঝড় বয়ে যাওয়ার পরও মাঠ পর্যায়ে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। পরবর্তী নেতৃত্ব নির্ধারণে কোনো বিলম্ব হয়নি। আন্দোলনে কর্মীদের মধ্যে কোনো প্রকার হতাশা ছড়িয়ে পড়েনি।

যদিও বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে যে, এত ত্যাগ স্বীকার করে বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্ব কী পেলো? সরকারের তো কিছুই হলো না। সরল হিসেবে বিরোধী দলের বিরাট অর্জন না হলেও এই ১০ টি বিভাগীয় সম্মেলনের সুফল অচিরেই বিএনপি পাবে বলে মনে হচ্ছে। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বিএনপি- শেখ হাসিনাকে গণভবন থেকে রাজনীতির মাঠে নামতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তিনি চিতল মাছ দেখিয়েছেন, নানা হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। তথাপি বিএনপির প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশ আওয়ামীলীগের জন্য ছিল একেকটি বড় ধরনের বিপদ সংকেত। মানুষ ক্ষেত থেকে যেমন উঠে এসেছে, তেমনি শহুরে জীবনের এসি রুম থেকেও মাটির মানুষের সাথে মিশতে নেতাদের বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছে। এটা বিএনপির বিরাট অর্জন।

১০ টি বিভাগীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি নতুন কর্মসূচীর ধারণা সামনে নিয়ে এসেছে। যুগপৎ আন্দোলন। ২৪ ডিসেম্বর এর শুরু। এসব বিভাগীয় সম্মেলন সেদিনের গণমিছিলের জন্য বড় ধরনের বটিকা হিসেবে কাজ করবে। জামায়াত দীর্ঘদিন পর রাজনৈতিক কর্মসূচী ঘোষণা করার সাহস পেয়েছে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ আওয়ামীভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল তা কাটাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এদেশের আলেম সমাজ এই ভীতি থেকে বের হতে পারেনি।

১০ বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিক একটি লড়াই থেকে বিএনপির অর্জন অনেক। মানুষ এখন কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। হয়তো অচিরেই এর সুফল জনগণ ভোগ করবে। লীগ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট চাপে ফেলতে বিএনপি সক্ষম হয়েছে। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ স্তরের সকল নেতাদের প্রতি অভিনন্দন। ২৮ শে অক্টোবর ২০০৬ সালে যে লগি-বৈঠার তান্ডব দিয়ে বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু, ৭ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সেই তান্ডবের ধারাবাহিকতার শেষ। দেখা যাক সরকার কি তান্ডববিহীন আন্দোলনে বিদায় নিবে নাকি তাদের দেখানো পথের সেই তান্ডবের আন্দোলনের মাধ্যমেই বিদায় হয়, সেটাই দেখার জন্য সময়ের অপেক্ষা।

জেনারেল সেক্রেটারী

বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট বিআইএম