হাটহাজারী ছাত্র বিক্ষোভ ও সরকারের প্রশংসনীয় ভূমিকা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ২৪ ২০২০, ১০:৪১

সৈয়দ শামছুল হুদা

দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী আজ অনেক শান্ত। বিরাজ করছে প্রশান্তির নীরবতা। যদিও আল্লামা আহমদ শফী রাহিমাহুল্লাহকে হারিয়ে সারাদেশের সকল আলেমদের মত দারুল উলুম হাটহাজারী এর সকল ছাত্র ও আসাতেজায়ে কেরাম শোকে মুহ্যমান‌‌। তারপরেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আজ দারুল উলুমে বিরাজ করছে অনেক স্থিতিশীলতা। সেখানে ছাত্রদের মধ্যে কোন পেরেশানি নেই, শিক্ষকদের মধ্যে নেই কোন প্রকার অস্থিরতা। এর জন্য সবচেয়ে বড় কোরবানিটা করতে হয়েছে আল্লামা আহমদ শফী রাহিমাহুল্লাহ কেই।

দারুল উলুম হাটহাজারীতে নজিরবিহীন এই স্থিতিশীলতার জন্য আজকে প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি বাংলাদেশ সরকারের এবং স্থানীয় প্রশাসনের। ছাত্রবিক্ষোভের সময় প্রশাসন যে পরিমাণ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রশংসা না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে। ১৬ ই সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভে সারাদেশের মানুষ বিশেষ করে উলামায়েকেরাম চরম পর্যায়ের উৎকণ্ঠায় ছিলেন। বুধবার দিন রাতে শুরা বৈঠকের মাধ্যমে ছাত্রদের দাবির আংশিক পূরণ হওয়ায় ছাত্র বিক্ষোভ স্থগিত করা হয়। এ সংবাদে আমরা স্বস্তি বোধ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭ ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে পুনরায় ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হলে সেখানে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয় যা দেখতে দেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। এমনই পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন কঠোর ভূমিকা নিতে প্রস্তুত হয়। ঠিক সেই সময়ে আল্লামা আহমদ শফী ভিডিও বার্তা দিয়ে দেশবাসীকে, বিশেষ করে প্রশাসনকে শান্ত থাকতে আহ্বান জানান। নায়েবে মুহতামিম আল্লামা শেখ আহমদ সাহেব অত্যন্ত দূরদর্শী ও ধৈর্যশীল ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রদের পাশে থেকে প্রশাসনকে বারবার হুঁশিয়ারি দিতে থাকেন, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে।

১৭ ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যে কোন সময় দারুল উলুম হাটহাজারীতে ছাত্র বিক্ষোভ দমনে প্রশাসন অ্যাকশনে যেতে পারে। আমরা দূর থেকে ছাত্রদের আশঙ্কার কথা শুনে প্রতিটি মুহূর্ত অস্থিরতায় কাটিয়েছি। কিন্তু সরকার কোন প্রকার উসকানিতে পা দেয়নি। কোন প্রকার ছাত্রবিক্ষোভে হস্তক্ষেপ করেনি। এটা বিগত ১২ বছরের মধ্যে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আমরা যাদেরকে সরকারের পক্ষের লোক মনে করেছিলাম, তাদের এই চরম দুঃসময়েও সরকার তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে দেশের আলেম সমাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে হাটহাজারীতে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতা, যোগ্যতা, মেধার সাথে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এজন্য হাটহাজারীর পুলিশ প্রশাসনসহ চট্টগ্রামের সকল পুলিশ প্রশাসনকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। ১৭ ই সেপ্টেম্বর দারুল উলুম হাটহাজারী শুরা বৈঠকে ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সারাদেশে যখন সুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে পরক্ষণেই সংবাদ আসে যে, আল্লামা আহমদ শফী ভীষণরকম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হবে। হযরতকে বাহিরে নেওয়ার সময়ও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়। সেই সময়ও পুলিশ সহনশীল ভূমিকা পালন করে অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দেয়। অতঃপর ১৮সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন আল্লামা আহমদ শফী এর ইন্তেকালের সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন ঢাকার আজগর আলি হসপিটালে কিছু বিশৃংখল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সারা দেশের আলেমদের মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, হয়তো সরকার দারুল উলুম হাটহাজারী ছাত্র-শিক্ষকদের উপরে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারে।

কিন্তু আমাদের হতবাক করে দিয়ে সরকার সেখানেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমস্যার সমাধান করে। এরপর যখন সিদ্ধান্ত আসে যে, হযরত এর জানাজা দারুল উলুম হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত হবে, তখন নতুন করে শঙ্কা দেখা দেয় যে, গত দুদিনের প্রতিক্রিয়ায় দারুল উলুম হাটহাজারীতে জানাযার সময়ে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে কি না। এই সময়েও সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সকল প্রকার উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে আল্লামা আহমদ শফী রাহিমাহুল্লাহ এর নজিরবিহীন জানাযায় কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোথাও টু শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে ৭জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১০ প্লাটুন বিজিবি আশেপাশের চারটি থানায় নিয়োজিত করে। এভাবে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর ছাত্র বিক্ষোভ এবং আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালের পরে বৃহৎ জানাযার সুন্দর সমাপ্তি ঘটে।

বিগত ১২ বৎসরে আমরা পুলিশের অনেক বাড়াবাড়ি দেখেছি, দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের নমুনা দেখেছি। সেই ধারণা থেকে ভয় ও শঙ্কা কাজ করছিল যে, উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে কোন বড় ধরনের অঘটন ঘটে যায় কি না। আলহামদুলিল্লাহ, কোনো সমস্যা হয়নি। জানাযা শেষে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে বসে মাদ্রাসার শুরা কমিটি নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্ত মনে মাদ্রাসার সকল সিদ্ধান্ত সুন্দরভাবে নিতে সক্ষম হয়েছেন। এতে স্থানীয় প্রশাসন কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেছে বলে জানা যায়নি।

সরকার একটিমাত্র ভুল করে, আর সেই ভুলটা হলো : মাদ্রাসার ভিতর যখন চরম পর্যায়ের অস্থিরতা বিরাজ করছে ঠিক সেই সময়ে সরকারকে কে বা কারা ভুল বুঝিয়ে করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করায়। এতে আরও দ্রুত শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কারণে সরকার পুলিশ প্রশাসন দিয়ে মাদ্রাসা বন্ধের দিকে এগিয়ে যায়নি। সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশ না মানা সত্ত্বেও সরকার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেনি। সাধারণত: আওয়ামীলীগ সরকার অতীতে কখনই এমনটা করেনি। এজন্যও সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এর মাধ্যমে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যতা বিদ্যমান থাকে।

সরকার চাইলে যেকোনো ধরনের বড় বড় সমস্যা সুন্দরভাবেই যে সমাধান করতে পারে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী ছাত্র বিক্ষোভ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

লেখক: জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)।