হজের আহকাম ও নিয়মাবলী

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ০১ ২০১৯, ১৫:২৬

মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী

আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়েছে। তাই জ্ঞান-গরিমায় বিচার বুদ্ধিতে এবং জীবন-যাপনের ধরণেও মানুষ অন্যান্য মাখলুকের চেয়ে ভিন্ন। এমন অনন্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “আমি জিন ও মানব জাতিকে এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” ইবাদত মূলত দুই প্রকার। এক. ইবাদতে বদনী তথা শরীরিক ইবাদত। যেমন নামাজ, রোজা, তেলাওয়াত ইত্যাদি। দুই. ইবাদতে মালী তথা আর্থিক ইবাদত। যেমন, যাকাত, ফিতরা, মান্নত ইত্যাদি। কিন্তু হজ এমন একটি ইবাদত যার মধ্যে উভয় ইবাদতের সমন্বয় ঘটে। একদিকে ব্যয় হয় সম্পদ, অপরদিকে ব্যয় শারীরিক শ্রম। আবার কিছুদিনের জন্য হলেও বিবি-বাচ্চা দেশ-গ্রাম ছেড়ে হিজরত করতে হয়। এসব কারণে মহান আল্লাহর কাছে হজের মূল্যায়ন অনেক বেশি। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি রুকন থেকে একটি হলো হজ। তা যেমন ফরয, হজ্ব আদায় করার পূর্বে হজের মাসআলা মাসায়েল জানাও ফরজ। কিন্তু হজের জরুরী মাসালা সমূহ জানা না থাকায় সঠিকভাবে হজ্ব আদায় হয় না। তাই সংক্ষিপ্তকারে হজের আলোচনা করা হচ্ছে।

হজ শব্দের অর্থ ইরাদা বা ইচ্ছা করা। ব্যবহারিক অর্থে হজ বলা হয়, নির্ধারিত মাসে নির্ধারিত তারিখে , নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত স্থানে আমাদের জীবনের অনুপম আদর্শ হযরত মুহাম্মদ সা. এর তরিকা অনুযায়ী কয়েকটি আমল পালন করা। হজের আমল সমূহ আদায় করতে হয় মাত্র ছয় দিন। তথা ৮ই জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ওযর বশতঃ হজের মুআল্লিমগণ ৭ই জিলহজ অথবা ৮ তারিখের রাতেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে হজের কার্যক্রম সূচনা করেন।

হজের প্রথম কাজ হলো, ইহরাম বাঁধা। সেলাই বিহীন দুটি কাপড়কে ইহরামের কাপড় বলা হয়। হাজীগণ পাকসাফ ও ভালোভাবে গোসল করার পর ইহরামের কাপড় পড়ে দুই রাকাত সালাতুল ইহরাম (ইহরামের নামাজ) আদায় করে হজ/উমরার নিয়ত করাকে ইহরাম বলা হয়। ইহরাম বাঁধার পর ৩ বার তালবিয়া পড়তে হয়।তালবিয়া হচ্ছে, ” লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারীকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়ালমূলক লা শারীকালাক।

৮ই জিলহজ ইহরাম বাধাঁ অবস্থায় ৪/৫ দিনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার ও হালকা আসবাবপত্র সঙ্গে নিয়ে উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়তে পড়তে মিনা অভিমুখে রওয়ানা করতে হবে।

৮ তারিখের জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা এবং ৯ তারিখের ফজরসহ মীনায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা সুন্নত। কিন্তু অনেকেই সামান্য আরামের জন্য মিনা থেকে রাতেই আরাফায় চলে যান। অথচ ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের পর আরাফার ময়দানের দিকে রওয়ানা দিতে হয়। সূর্যোদয়ের আগে আরাফায় চলে যাওয়া খেলাফে সুন্নাত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই খেলাফে সুন্নাতকে বর্তমানে সুন্নত হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়।

আরাফাহ অর্থ পরিচয়। আরাফার ময়দান হলো সেই বিখ্যাত প্রান্তর, বেহশত থেকে অবতরণ করে যেখানে হযরত আদম ও মা হাওয়া আ. দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর সাক্ষাৎ বা পূর্ণ পরিচয় লাভ করেছিলেন। আরাফার ময়দান মক্কা থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ৯ তারিখের ফজর নামাজ আদায় করে ইহরাম অবস্থায় আরাফার ময়দানে হাজির হওয়া পবিত্র হজের প্রধান আমল। কোন কারণে যদি( উকুফে আরাফা) আরাফার ময়দানে অবস্থান ছুটে যায়, তাহলে তার হজ ছুটে গেল। পরবর্তী কোন বছর তা অবশ্যই কাযা করতে হবে। এ কারণেই মেডিকেল কিংবা ক্লিনিকে ভর্তি অজ্ঞান/ অসুস্থ রোগীকেও অ্যাম্বুলেন্স বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থায় আরাফার ময়দান ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। এতে হজের মূল রুকন আদায় হয়ে যায়। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৯ তারিখের ফজরের নামাজের পর থেকে তালবিয়ার সঙ্গে তাকবিরে তাশরিকও শুরু করতে হয়। এভাবে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক নামাজের পর(মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজ) তাকবিরে তাশরিক পড়তে হয়।

আরাফার দিনে আরাফার ময়দানে বিশেষ কোন আমল বা দোয়া নেই। তবে আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শ্রেষ্ঠ দোয়া হল, আরাফার দিনের দোয়া। আরাফার ময়দানে জোহরের নামাজের পূর্বে পৌঁছে জোহরের নামাজের সাথে আসরের নামাজও আদায় করতে হয়। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আল্লাহ প্রেমিক লাখো লাখো বান্দার আরাফার ময়দানের উপস্থিতি ও নামাজের দৃশ্য সবার মাঝে জাগিয়ে তোলে অদৃশ্য এক ঈমানী শক্তি , দ্বীনি জযবা এবং মহান আল্লাহর জন্য ত্যাগের এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।

তবে কেউ যদি যোহরের ওয়াক্তে যোহর, আসরের ওয়াক্তে আসর আদায় করে তাতেও কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাই এসব উত্তম অনুত্তম ব্যাপার নিয়ে আরাফার মত পবিত্র স্থানে অতি মূল্যবান সময় তর্ক জড়ানো উচিত নয়। আরাফার ময়দানে ৯ তারিখের সূর্য পূর্ণ অস্ত যাওয়ার পর মাগরিবের নামাজ না পড়ে তালবিয়া পড়তে পড়তে মুজদালিফা অভিমুখে রওনা করতে হয়। আরাফা থেকে মুজদালিফার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। বর্তমানে আরাফা থেকে মুযদালিফা যাওয়ার জন্য গাড়ির সুব্যবস্থা আছে। তবে হেঁটেও যাওয়া যায়। অনেকে হেঁটে ও যান। শোনা যায় হেঁটে গেলে কিনা গাড়ির আগে পৌঁছানো যায়।

মক্কা থেকে মীনা মাত্র তিন মাইল। মীনা থেকে আরাফা ছয় মাইল। মীনা ও আরাফার মাঝপথে মুজদালিফা। রাত যত গভীর হোক না কেন মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও ইশার নামাজ একত্রে আদায় করতে হবে। আমাদের ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মাযহাব অনুযায়ী মুজদালিফার ময়দানে রাত্রি যাপন করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তবে মনে রাখতে হবে সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। সুতরাং যারা মুজদালিফায় রাত্রি যাপন করে সুবেহ সাদিকের আগেই মুজদালিফার সীমা থেকে বের হয়ে যায়, তারা হজের একটি ওয়াজিব তরক করে। তাই তরকে ওয়াজিবের জন্য অবশ্যই দম দিতে হবে। তবে হ্যাঁ যারা দুর্বল, অসুস্থ, বৃদ্ধ তাদের ভীড়ের কষ্ট থেকে নিরাপদ রাখতে আগে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের ওপর দম ওয়াজিব হবে না।

মুজদালিফার ময়দানে মাগরিব ও এশা একসাথে আদায় করে শুধু রাত যাপন করতে হয়। এখানে নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুজদালিফার ময়দানে মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করে, সুবহে সাদিক পর্যন্ত বিশ্রাম করেছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রাত্রে উম্মতের আরামের কথা বিবেচনা করে তাহাজ্জুদও পড়েননি। কারণ, আগের দিন যহর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কেটেছে আরাফার ময়দানে, আর পরের দিন রয়েছে রমি ও কুরবানীর মত জটিল ও কষ্টসাধ্য আমল। সুতরাং এই দিনে বিশ্রাম করাটাই ইবাদত। কারণ, শরীরেরও বিশ্রাম পাওয়ার হক আছে। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ শুরুর ওয়াক্তে আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগে মুজদালিফার সীমানা অতিক্রম করে, মীনার সীমানায় প্রবেশ করা, এটাও সুন্নত। মুজদালিফা থেকে মীনায় যাওয়ার পথে অথবা মুজদালিফা বা মীনায় থেকেও রমির কংকর সংগ্রহ করা যায়। তবে রমির স্থান থেকে কংকর নেওয়া মাকরূহ। ১০ জিলহজ মুজদালিফা থেকে মীনায় পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর ‘জামরাতুল আকাবা’য় একটির পর একটি, এভাবে সাতটি কংকর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিক্ষেপ করতে হয়। কংকর নিক্ষেপের সময় তালবিয়া পড়া যাবে না। ১০ তারিখের রমি শুধু জামরাতুল আকাবায়। রমি শেষ করার পর শুধু হজ্জে তামাত্তু ও হজ্জে কিরান আদায়কারীদের ‘দমে শোকর’ বা কুরবানী করা ওয়াজিব। কুরবানির পর মাথার চুল কেটে বা হলক করে ইহরাম মুক্ত হওয়া যায়। তবে ১০ তারিখেই কুরবানী করা জরুরী নয়। ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করা যেতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে রমি, কুরবানি ও মাথার চুল কাটা বা হলক করা; এই তিন কাজের ধারাবাহিকতা জরুরী।

এখন আরো একটি ফরজ কাজ বাকি আছে। তাহলো, তাওয়াফে জিয়ারত। ১০, ১১ ও ১২ তারিখের মধ্যে যে কোন সুবিধাজনক সময়ে মীনা থেকে এসে তাওয়াফে জিয়ারত করে পুনরায় মীনায় ফিরে রাত্রি যাপন করতে হয়। তাওয়াফে জিয়ারত ১০ তারিখে উত্তম হলেও ঐ দিন খুব ভীড় থাকে। তাই ১১ও ১২ তারিখে তাওয়াফে জিয়ারতের কাজ সম্পাদনা করা স্বস্তিদায়ক। ১১ ও ১২ তারিখ মীনায় অবস্থান করা সুন্নত। ১৩ তারিখ মিনায় অবস্থান করা উত্তম। উল্লেখ্য ১৩ মীনায় অবস্থান করলে তিন জায়গায় পুনরায় কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১০ ই জিলহজের কার্যক্রম মুটামুটি শেষ। ১১ ও ১২ তারিখে প্রতিদিন তিন জায়গায় শয়তানকে সাতটি করে ২১ টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে মীনার সীমা ত্যাগ করে বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের আমল তথা কার্যক্রম শেষ করা যাবে।