সিয়াম সাধনা আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৬ ২০২০, ২২:২৩

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ:

মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস হল পবিত্র রামাযান।কারণ এ মাসেই মানব জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান নিয়ে মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছে,যা সত্য ও মিথ্যাকে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য করে দিয়েছে।

♢ আল্লাহপাক বলেন-‘রমযান মাস,এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা মানবজাতির জন্য পথের দিশা,

যার মধ্যে রয়েছে হেদায়াতের দলিল এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী ।(বাকারা-১৮৫)

♢ হযরত আবু হুরায়রা(রা:)থেকে বর্ণিত,নবী করিম (সা:)

বলেছেন, মাহে রমযানের আগমন ঘটলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়,জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়।(বুখারী শরীফ:১৮৯৮,মুসলিম শরীফ:১০৭৯)

মানব জাতিকে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠনের জন্য মহান আল্লাহ পাক যেসব মৌলিক ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন,এর মধ্যে পবিত্র মাহে রামাযানের রোযা হল অন্যতম। বছরে একবার এভাবে একমাসব্যাপী রোযা পালন বা সিয়াম সাধনার সাথে আল-কুরআন এবং তাকওয়ার সম্পর্ক গভীর ও নিবিড়।

ইসলামের অন্য বুনিয়াদী ইবাদতসমূহের মত সিয়ামও শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ইবাদত নয়। এটি এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক ইবাদাত যা মানব জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। মানুষের মহৎ জীবন গঠনে সংযমের প্রয়োজন অত্যধিক।

এজন্য তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠন করতে রমজানুল মুবারক হচ্ছে মুমিনদের জন্য তাকওয়া অর্জনের মাস।

এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্যতার গভীরতা লাভ করবে এটাই রোযার মুল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ।

তাছাড়া রোযার উদ্দেশ্য হলো সর্বপ্রকার মিথ্যা-অসত্য, অন্যায়-অবিচার-অনাচার,লোভ-লালসা,পাপ ও গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এবং শুধুমাত্র মহান আল্লাহর হুকুম পালনার্থে ত্যাগ,সংযম,আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে উন্নত মানবীয় গুণাবলী অর্জন করা ।

সিয়াম সাধনার দ্বারা রোযাদার প্রকৃত ইনসানে কামিল বা উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজ এবং পৃথিবীকেও সুন্দর,শান্তিপূর্ণ-কল্যাণময় আদর্শ সমাজ রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।রোযার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এটাই ।

এমনকি সিয়াম বা রোযা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত যার সমতুল্য নেই। রোযা মানুষকে সকল প্রকার পাপাচার ও অন্যায় অনাচার থেকে সুরক্ষিত রাখতে ঢাল হিশেবে ব্যবহিত হয় । যেমনটি হাদীসের মধ্যে বলা হয়েছে ।

♢ উসমান ইবনে আবিল আস (রা:) বর্ণনা করেন,আমি রাসূলুল্লাহ(সা:)বলতে শুনেছি,রোযা হল জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল, যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের’শত্রুর আঘাত হতে রক্ষাকারী’ ঢালের মত।(মুসনাদে আহমদ,হাদীস :১৬২৭৮;

সহীহ ইবনে খুযাইমা,হাদীস : ২১২৫;)

♢ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারীম (সা:) এরশাদ করেছেন, (الصيام جنة، وحصن حصين من النار)

রোযা হল (জাহান্নাম থেকে পরিত্রান লাভের) ঢাল এবং সুরক্ষিত দুর্গ ।(মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৯২২৫; বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস-৩৫৭১)

♢ অন্যসব ইবাদত থেকে সিয়ামের মর্যাদা সর্বাধিক ।

সিয়াম বা রোযা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল যাতে লোক দেখানোর সুযোগ নেই। এটি বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার একটি অতি গোপন সম্পর্ক। নামাজ,জাকাত,

হজ সহ অন্যান্য ইবাদত পালন করলে তা দেখা যায়।

পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়ামের ইবাদত এখলাস বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল বেশি থাকে। তাই এর মর্যাদা ও প্রতিদান অন্য সবকিছু থেকে আলাদা ও সর্বাধিক । যেমনটি হাদীস শরীফে এসেছে,

♢হযরত আবু উমামা (রা:) বর্ণনা করেন,আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের আদেশ করুন। তিনি বললেন,তুমি রোযা রাখ,কেননা রোযার সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় বললাম,হে আল্লাহর

রাসুল(সা:)আমাকে কোনো নেক আমলের কথা বলুন, তিনি বললেন, তুমি রোযা রাখ,কেননা এর কোনো সমতুল্য কিছু নেই। (সহীহ ইবনে খুযাইমা,হাদীস ১৮৯৩;সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস ২৫৩৩ )

♢ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন,মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,কিন্তু রোযা আলাদা । কেননা তা একমাত্র আমার জন্য। তাই আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১ (১৬৪); মুসনাদে আহমদ, হাদীস :৯৭১৪)

♢ রোযার ফজিলতের ব্যাপারে অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে, আল্লাহ পাক বলেন,প্রত্যেক ইবাদতই ইবাদতকারী ব্যক্তির জন্য,পক্ষান্তরে রোযা আমার জন্য । আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। (সহীহ বুখারী হাদীস-১৯০৪)

এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে সকল ইবাদত

আল্লাহর জন্য,তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে । তবুও রোযা এবং অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে ।

তা হল,অন্যান্য সকল ইবাদতের কাঠামোগত ক্রিয়াকলাপ, আকার-আকৃতি ও নিয়ম পদ্ধতি এমন যে, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ছাড়াও ইবাদতকারীর নফসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান থাকে । মুখে প্রকাশ না করলেও অনেক সময় তার অন্তরে রিয়া তথা লোক দেখানো ভাব সৃষ্টি হতে পারে । তার অনুভূতির অন্তরালে এ ধরনের ভাব লুকিয়ে থাকে । তা সে অনুভব করতে না পারলেও তার ভিতরে কিন্তু অবচেতনভাবে বিদ্যমান থাকে ।

ফলে সেখানে নফসের প্রভাব এসে যায় । পক্ষান্তরে রোযা এমন এক পদ্ধতিগত ইবাদত,তার আকার আকৃতি এরূপ যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত ইবাদতকারীর নফসের স্বাদ গ্রহণের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

রোযাদার ব্যক্তি সে নিজ মুখে রোযার বিষয়টি প্রকাশ না করলে সাধারণত তা আলেমুল গায়েব আল্লাহ পাক ব্যতীত কারো নিকট প্রকাশিত হওয়ার মত নয়। তাই রোযার ক্ষেত্রে মাওলার সন্তুষ্টির বিষয় একনিষ্ঠ ভাবে প্রতিভাত হয়।একারণেই রোযা ও অন্যান্য ইবাদতের মাঝে এরূপ বিস্তর ব্যবধান। যার ফলে সিয়াম ও সাধনা মহান আল্লাহর নৈকট্য ও পুরস্কার লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হিশেবে বিবেচ্য ।

রামাযান মাসে ফজিলতপূর্ণ আরো একটি আমল হল কিয়ামুল’লাইল বা তারাবীহ’র নামায । যার গুরুত্ব ও ফজিলতের ব্যাপারে আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বর্ণিত দুটি হাদীস পেশ করছি । যেমন: হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বর্ণনা করেন,রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন,আল্লাহ পাক তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন,আর আমি তোমাদের উপর কিয়ামুল’লাইল তথা তারাবীহ’র নামাযকে সুন্নত করেছি।

সুতরাং যেব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব পাওয়ার আশা নিয়ে রামাযানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে,সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল।(মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৬৬০,সুনানে নাসায়ী, হাদীস,২৫১৮)

♢ হযরত আবু হুরায়রা(রা:) হতে বর্ণিত,রাসুলুল্লাহ(সা:) বলেছেন,যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব পাওয়ার আশায় রমযান মাসে কিয়াম করবে (তথা তারাবীহ’র নামায পড়বে) তার পূর্বেকার পাপসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে । (বুখারী মুসলিম )

আসুন আমরা এই রহমত,মাগফিরত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম ও কিয়াম তথা তারাবীহ’র নামায এবং অন্যান্য সাধনার মাধ্যমে মহান’আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করি ।

এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষিত পুরস্কার অর্জনের লক্ষ্যে একনিষ্ঠভাবে তারি এবাদত বন্দেগিতে মগ্ন হই ।

পাশাপাশি বর্জন করি সকল পাপাচার,অন্যায়,অবিচার ও অপরাধমুলক কর্মকান্ড । আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। আমীন