সিন্ডিকেটকারীরা জালেম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ২৮ ২০২০, ১৬:১৪

 —মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমি•

অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুত রাখার প্রবণতা বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলিতে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এটাকে কোন অপরাধই মনে করছে না। অথচ এর ফলে খদ্যের চরম সঙ্কট তৈরি হয়। পণ্যের মূল্য হুট করে বেড়ে যায় । জনসাধারণের দু:খ-কষ্টের সীমা থাকে না। একচেটিয়া কারবারের উদ্দেশ্যই হচ্ছে চড়া মূল্যের লোভে পন্য স্ট্রক বা মজুত করে রাখা। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী মৌসুমের শুরুতেই চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানারকম শস্য ও ফলফলাদি বিপুল পরিমাণে গুদামজাত করে রাখে। ফলে বাজারে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম সংকট। দাম বহুগুণে দ্রুত বেড়ে যায়। আর এই সুযোগে মজুতদাররা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে । একইভাবে শিল্পজাত পণ্যেও মজুতদারি চলে। ডিম, তেল, চিনি, গুড়, কসমেটিক , শিশুখাদ্য, সার, বীজ, তুলা, সুতা ইত্যাদি এমন কোনো বস্তু নেই ব্যবসায়ীরা যা মজুত করে না। এর পরিমাণ এত বেশি যে, বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয় । সাধারণ মানুষ তখন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে।

বর্তমানে করোনা প্রাদুর্ভাবে কার্যত লকডাউন হয়ে থাকা দেশে কর্মহীন মানুষ দিশেহারা ৷ এ অবস্থায়ও এক শ্রেণির মজুতদার চক্র বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে । চক্রটি বেশি মুনাফা লাভের আশায় কয়েকমাস আগ থেকেই শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ও গোডাউনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী গোপনে বেশি পরিমানে মজুত করে রাখে। এতে করে মজুতদারচক্র রমজানে কোন কারণ ছাড়াই দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে চাল, ডাল, আদা ও রসুনসহ নিত্যপণ্যের দুর্মূল্যে নাকাল নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ৷

মানুষের খাদ্যশস্যসহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অস্বাভাবিক পরিমাণে স্টক করে রাখার পরিণাম কী আমরা তা টের পাচ্ছি ৷ ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দেওয়া তথ্যমতে, গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে প্রতিকেজি মশুরের ডালে দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ৷ সাত দিনে কেজিতে পেঁয়াজের ‍দাম ২১ শতাংশ এবং রসুনের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে ৷ এছাড়া, মাস ব্যবধানে কেজিতে ছোলার দাম প্রায় ৭ শতাংশ, চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৪ শতাংশ এবং খেজুরের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ টিসিবি আদার দাম কেজিতে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়ার তথ্য দিলেও আদতে ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই পণ্যটির দাম আকাশ ছুঁয়েছে ৷ রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি আদা এখন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা ৷ এটা স্পষ্ট জুলুম! প্রতিটি ব্যবসায়ীকে এ কথা মনে রাখতে হবে– ব্যবসায় নীতি ও সততা রক্ষা করে চলা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব ৷

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চড়া মূল্যের লোভে জিনিসপত্র, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি গুদামজাত করে রাখতে নিষেধ করে বলেন :

” مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ ”

“যে (চড়া মূল্যের লোভে খাদ্য ইত্যাদি ) মজুত করে রাখে সে অপরাধী ” (মুসলিম: ১৬০৫)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পণ্য মজুত করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেন,

مَنِ احْتَكَرَطَعَامًا أَرْبَعِينَ لَيْلَةً فَقَدْ بَرِئَ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى، وَبَرِئَ اللَّهُ تَعَالَى مِنْهُ، وَأَيُّمَا أَهْلِ عَرْصَةٍ أَصْبَحَ فِيهِمُ امْرُؤٌ جَائِعٌ فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُمْ ذِمَّةُ اللَّهِ تَعَالَى “.

‘যে বেক্তি ইহতিকার করবে অর্থাৎ, অতিরিক্ত দামের আশায় ৪০ দিন যাবৎ খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করে আটক রাখবে, আল্লাহর সঙ্গে তার ও তার সঙ্গে আল্লাহর সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।’ (মুসনাদ আহমাদ: ৪৮৮০)

অন্য হদিসে রাসুল (সা.) বলেন :

“‏ الْجَالِبُ مَرْزُوقٌ وَالْمُحْتَكِرُ مَلْعُونٌ ‏”‏ ‏.

‘আমদানিকারী (পণ্য সরবরাহকারী) ব্যবসায়ী রিযিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত। (ইবনে মাজাহ ২১৫৩) ৷

অন্যত্র বলেন :

“‏ مَنِ احْتَكَرَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ طَعَامَهُمْ ضَرَبَهُ اللَّهُ بِالْجُذَامِ وَالإِفْلاَسِ ‏”‏ ‏.‏

‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি করে আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে শাস্তি দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২১৫৫)

মানুষের খাদ্য, কাপর-চোপর ও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্ট্রক করে রাখার পরিণাম বিবেকবানদের নিকট অস্পষ্ট নয়, যা গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ছাড়া ব্যাপকহারে কল-কারখানা, মেল-ফেক্টরি, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী, পেশাজীবী ও দিনমজুরসহ সকলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটা স্পষ্ট জুলুম! এই কাজ থেকে সৃষ্টি হয় মুনাফাখোরি মানসিকতা, ব্যবসায়িক অসাধুতা। জন্ম নেয় নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি । এ জন্যেই আজ দেশে দেশে কালোবাজারি, চোরাকারবারি ও চালচুরি বেড়ে গেছে । মানবসেবা কিংবা জনস্বার্থ ব্যবসায়ীদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। যেভাবেই হোক না কেন, অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিই এদের একমাত্র লক্ষ্য। মানবিকতা ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা বৈষয়িক উন্নতির পথ বেছে নিয়েছে। প্রতিটি ব্যবসায়ীকে এ কথা মনে রাখতে হবে ব্যবসায় নীতি ও সততা রক্ষা করে চলা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। সবাইকে একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহিতা করতে হবে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

“كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ : الْإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ “.

“তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) জিজ্ঞাস করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাঁকে তাঁর অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার বর্গের অভিভাবক, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামী-গৃহের কর্ত্রী, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। খাদিম তার মনিবের ধন-সম্পদের রক্ষক, তাকেও তার মনিবের ধন-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ( বুখারি : ৮৯৩)

ব্যবসাও একটি দায়িত্ব ও জিম্মাদারি এবং জনগনের পক্ষ থেক আমানতদারি। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।

দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও শাস্তি ।

রাসুল সা. বলেন :

“لا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ ، وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلاَهُ”.

‘কেয়ামতের দিবসে বান্দার দুই পা জায়গা থেকে এক চুলও সরবে না, যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে তার জীবনকাল সম্পর্কে, কোথায় সে তা ব্যয় করেছে; তার ইলম-জ্ঞান সম্পর্কে, সে অনুযায়ী কী করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কীভাবে সে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার দেহ সম্পর্কে, কীভাবে সে তা ক্ষয় করেছে।’ ( তিরমিজি : ২৪১৭)।

অথচ সততা ও আমানতদারিতার সঙ্গে যদি ব্যবসা করা হয়, তাহলে দুনিয়ার জীবনে লাভ পরকালেও রয়েছে সফলতা ।

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন:

“رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ

لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا عَمِلُوا وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ ۗ وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ”

‘এরা এমন লোক (মুমিন ব্যবসায়ী) যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ (যিকির) থেকে সালাত কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করেন সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।( তারা আল্লাহর পবিত্রতার ঘোষণা করে,) যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্ট কর্মের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দেন৷ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজিক দান করেন ’। (সুরা নুর : ৩৭,৩৮)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :

“التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشُّهَدَاءِ”

সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসয়ী (কিয়ামতের দিন) সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন ৷

(তিরমিজি: ১২০৯)