সচ্ছলদের জন্য ঈদ প্যাকেজ —রশীদ জামীল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ১৫ ২০২০, ২২:০৪

বাচ্চাগুলো দুইদিন হলো কিছু খায়নি! শেষবার চালভাজা খেয়েছিল গত পরশু। গতকাল খুব কান্নাকাটি করছিল। আজ আর কাঁদছে না। কাঁদতে হলেও শরীরে জোর লাগে। দুইদিন না খেয়ে থাকলে শরীরে জোর আসবে কোত্থেকে?

মা কাপড়ের আঁচল দিয়ে বার বার চোখ মুছছেন। বাবা লোকটি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন বারান্দায়। চালের ফুটো দিয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির পানি এসে পড়ছে মানুষটির কপালে। তাকিয়ে আছেন বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে…

… এটি একটি কাল্পনিক চিত্র। ডানেবামে তাকালে এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। এবার চলুন একটি বাস্তবতার গল্প শুনি।

আধা বয়েসী মহিলা পাশের বাড়ির মেয়েটির কাছে গিয়ে বললেন, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

মহিলা মোটামুটি সম্ভ্রান্ত শ্রেনির। দুই ছেলের মা। এক ছেলে ওয়ার্কশপে কাজ করতো। একজন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালাতো। দেড়মাস হলো তাদের কাজ নেই। মহিলা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন

মেয়েটি বলল, জি খালা, বলুন। মহিলা বললেন, ঘরে দুকেজি ডাল ছিল। গত দশদিন থেকে ডালে পানি মিশিয়ে মিশিয়ে খাচ্ছি… বলেই মাথা নিচু করে ফেললেন।

মেয়েটি তার ঘরের ফ্রিজ থেকে এক প্যাকেট মাছ এনে মহিলার হাতে ধরিয়ে দিলো। তিনি মাথা নিচু করে প্যাকেটটি নিলেন। মহিলার চোখে জল। খাবারের জন্য হাত পাতার অভ্যাস না থাকায় তাঁকে একটু বেশিই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

ঘটনাটি আমাকে জানাল আমার এক নিকট আত্মীয়। পরের দিন সে তার স্বামীকে দিয়ে ঐ মহিলার ঘরে, এবং আশপাশের এমন আরো চারটি ঘরে দুটি করে মোরগসহ কিছু খরচপাতি কিনে পাঠিয়েছিল।

২.

দুই ছেলেকে নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। পঞ্চমজন তাদেরে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া। তাঁদের সাথে থাকে। ঘরের কাজে হেল্প করে। নবি-নন্দিনী ফাতিমার সংসারের কথা বলছি। সংসারটা আসলে ৬জনের ছিল। ছোট ছেলে মুহাসসান বা মুহসিন মারা যাওয়ায় এখন দুই ছেলে হাসান আর হোসাইনকে নিয়েই ফাতিমার সংসার।

ইফতারের জন্য ফাতিমা পাঁচটি রুটি বানিয়েছেন। রুটিগুলো সামনে নিয়ে আজানের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা- এরই মাঝে দরজায় ভিক্ষুক এসে হাঁক দিলো, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু খাবার দেন গো মা। সারাদিন রোজা রেখেছি। ইফতার করার কিছু নাই’!

হযরত আলি তাঁর প্লেট থেকে রুটিটি তুলে দিলেন খাদেমার হাতে। ‘যাও, আমার রুটিটি ভিক্ষুককে দিয়ে এসো। আমি না-হয় আজ পানি দিয়েই ইফতার সেরে নেবো।

ফাতিমা বললেন, ‘তুমি তোমার রুটি ভিক্ষুককে দিয়ে দেবে আর আমি বসে বসে দেখব? ভুলে যাচ্ছো কেন আমি কার মেয়ে’- বলেই ফাতিমা তাঁর অংশের রুটিটিও খাদেমার হাতে তুলে দিলেন। আমারটাও নিয়ে যাও।

ছেলে হাসান বললেন, বাবা একটা কথা বলি?

-বলো।

-আমার অংশের রুটিটাও দিয়ে দিই?

হযরত আলি বললেন, তোমার ইচ্ছা।

হযরত হাসান তাঁর রুটিটিও দিয়ে দিলেন। ছোট্ট হোসাইন বললেন, ভাইয়া দিয়েছে। আমিও আমারটা দিতে চাই। সেও তার রুটিটি খাদেমার হাতে তুলে দিলো।

চারজনের কাছ থেকে চার রুটি হাতে নিয়ে খাদেমা তাঁর নিজের অংশের রুটিটিও সেখানে মিলিয়ে নিলেন আর বলতে লাগলেন, আমিও আমার রুটিটি দিয়ে দিতে চাই। যেন আগামীর পৃথিবী জানতে পারে আলি ফাতিমা এবং তাদের সন্তানরাই শুধু দানশীল ছিলেন না, তাদের ঘরের কাজের মেয়েও দানশীলা ছিল।

৩.

নিজের আহার অন্যের মুখে তুলে দিতে পারার আনন্দ কেবল তাঁরাই জানে যারা কখনো এই কাজ করতে পেরেছে। একের বিনিময়ে দশ- আল্লাহর ওয়াদা তো আছেই। আর আল্লাহর হিসাবে কখনো ভুল হয় না। চলুন হযরত ফাতিমার আরেকটি গল্প শুনা যাক।

জ্বরে কাতরাচ্ছেন ফাতিমা। আলি কাছে গিয়ে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলেন। ‘ফাতিমা! কিছু খেতে ইচ্ছে করছে’?

ফাতিমা ডালিম খেতে চাইলেন। গরিব স্বামী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটি ডালিম এনে দিলেন অসুস্থ স্ত্রীর হাতে। তারপর চলে গেলেন নবিজির দরবারে। কন্যার অসুস্থতার কথা পিতাকে জানানো দরকার।

ফাতিমা ডালিমটি খাবেন বলে হাতে নিয়েছেন- ঠিক তখনই একজন ভিক্ষুক এসে হাঁক দিলো। ‘আল্লাহর নামে কিছু খেতে দেনগো মা। সারাদিন কিছু খাইনি’! ফাতিমা ডালিমটি তুলে দিলেন ভিক্ষুকের হাতে।

ওদিকে নবিজি কন্যার অসুস্থতার খবর শুনে বিচলিত। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন কিছু ডালিম নিয়ে হাজির হয়ে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমার হাদিয়া কবুল করুন। নবিজি ডালিমের প্যাকেটটি আলির হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো আমার ফাতিমাকে দিয়ে দিও’।

ডালিমের প্যাকেটটি নিয়ে ঘরে ফিরলেন আলি। অনেকগুলো ডালিম থেকে একটি ডালিম পকেটে রেখে দিলেন অথবা সাস্থায় পড়ে গেল। ডালিমগুলো ফাতিমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও ডালিম’।

ফাতিমা বললেন, এগুলো কোত্থেকে আসলো?

আলি বললেন, আল্লাহ দিয়েছেন।

ফাতিমা প্যাকেটটি খুললেন। গুনে দেখলেন ৯টা ডালিম। বললেন, আরেকটি কই?

আলি বিস্মিত হলেন! আরেকটি মানে কী?

ফাতিমা বললেন, তুমি না বললে এগুলো আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ দিলে তো কম দেওয়ার কথা না। আমি আমার আব্বার মুখে শুনেছি আল্লাহ তো বলেছেন, কেউ আল্লাহর জন্য ১টি ব্যয় করলে আল্লাহ ১০টি ফিরিয়ে দেন। আমি আজ ১টি ডালিম আল্লাহর জন্য দিয়েছি। সুতরাং আল্লাহ দিলে ১০টিই দেওয়ার কথা, ৯টি না।

৪.

এমন ঈদ এর আগে আর এসেছে কি না- জানি না। অন্তত এই সময়ের দেড়শ কোটি মুসলমানের জীবনে যে আসেনি- এটা তো নিশ্চিত করেই বলা যায়। আগামীর ইতিহাস কীভাবে লেখা হবে- কেউ জানে না।

মৃত্যু অবধারিত- এটা সবাই জানি। যে কেউ যেকোনো সময় মারা যেতে পারি-এটাও জানা ছিল। করোনা এসে জানা কথাটিকে পাকাপোক্ত করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এই ঈদটা যে জীবনের শেষ ঈদ হবে না- গ্যারান্টি আছে?

ঈদে নতুন কাপড় কেনার একটা রেওয়াজ আছে। যে যার সামর্থ অনুযায়ী ঈদের বাজেট করেন। কেউ ৫ হাজার, কেউ ১০ হাজার, কেউ ৫০। কেউ আরো আরো বেশি। এবারের ঈদটা কি আমরা অন্যভাবে করতে পারি না? মানবতার এই দুর্দিনে ঈদের বাজেটটা অভুক্ত মানুষের হাতে তুলে দিতে পারি না ? আমাদের সন্তানরা না-হয় পুরনো কাপড় পরেই একটা ঈদ করুক। মানবতার এই শিক্ষাটা তারাও শিখে রাখুক। আর এটাই হোক এবারের ঈদে স্বচ্ছলদের ঈদ প্যাকেজ।

আমরা কি পারি না কাজটি করতে? আমরা কি পারি না ঈদের বাজেটটা যদি বিলিয়ে দিতে? যদি পারি, খোদার কসম, এবারের ঈদ হবে জীবনের শ্রেষ্ট ঈদ। আর ব্যাপারটি আপনি নিজেই ফিল করতে পারবেন। বিশ্বাস না হলে করেই দেখুন।