শান্তি প্রতিষ্ঠায় শুধু সরকার নয় সামাজিক প্রচেষ্টাও জরুরি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ০৪ ২০১৮, ১৯:০৯

শায়খুল হাদীস হুসাইন আহমাদ বাহুবলী:
বিশ্বশান্তির মহানদূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন অপেক্ষা করেননি নবুওত প্রাপ্তির তেমনি অপেক্ষা করেনিন ক্ষমতার মসনদের।
অন্ধকার যুগের আরবে “হরবুল ফুজ্জার” নামের গোষ্ঠী দন্ধ চলছিল গৌরবের নিদর্শন হিসেবে। কুরায়শ আর ক্বায়স গোত্রের মাঝে চলছিল এ অরাজকতা। তৎকালীন যুগসচেতন তিন মনীষী ফযল বিন ফুযালা, ফযল বিন ওদাআ, ফযল বিন হারিস স্রোতের উল্টো দাড়ানোর প্রত্যয়ে সংগঠিত হচ্ছিলেন।

দূরের-কাছের, আপন-পর কারো উপর যুলুম চলতে দেওয়া যাবে না। বাহু শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছিলেন তারা। তারা হলফ বা শপথ করেছিলেন এই সিদ্ধান্তের উপর। তাদের এই দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রভাবে সমাজে সুখের বিন বেজে উঠেছিল।
কাকতালীয় ভাবে উদ্যোক্তাদের তিনজনের নামেই ছিল ফযল।তাই পরবর্তী প্রজন্ম তাদের এই হলফকে “হিলফুল ফুযুল” বা ফযলদের অনুস্বরণীয় শপথ নামে স্বরণ করে।
এটা ছিল নবীজির তারুণ্যে পৌঁছার আগেকার চিত্র। ফযলরা চলেগেন পৃথিবী ছেড়ে। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল তাদের হলফও। ফলে আবার ফিরে এল অশান্তির আমানিশা।
তখন নবীজি তারুণ্যে। সকলের মাঝে আলোড়িত হচ্ছিল মযলূমানের সাহায্যার্থে ফযলদের ন্যায় আবারো সংগঠিত হওয়া যায় কিনা।
আব্দুল্লাহ বিন জাদ্আন দাওয়াত করলেন গোটা বনী হাশিম ও বনী তাইমকে। আপ্যায়নের ও ব্যবস্থা করলেন।
শান্তির মূর্তপ্রতিক রহমতের নবী সেচ্ছায়, সাগ্রহে সেখানে উপস্থিত। আকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে তিনি বলে উঠলে
“শান্তির সমাজ গঠনে এমন সংগঠনে অংশগ্রহণ করে আমি যে সৌভাগ্যবোধ করছি একটা লাল উটে(বর্তমান মার্সিডিজ পাজেরো)র মালিক হলেও ততটুকু আনন্দবোধ করতাম না”
নবুওত প্রাপ্তির পর একদিন সেই সামাজিক সংগঠনের স্মৃতিচারণ করে বিশ্বনবী বলেন

“এখন ইসলামের যুগেও যদি কেউ আমাকে এমন সংগঠনের দিকে আহব্বান করে আমি অবশ্যই যোগদান করবো”। (সীরাতে ইবনে হিশাম, রাওযুল উনফ পৃষ্ঠা ৯১, তবকাতে ইবন সাদ ১ম খন্ডন পৃষ্ঠা ৮২)।

পবিত্র কা’বা শরীফ দশবার পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
তৃতীয় নির্মাণ হয় নবীজির ৩৫বছর বয়সে। নবুওত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে। এবার উদ্যোগী হল কোরাইশরা। এর আগে ২য় বারের ইব্রাহীমী নির্মানে কা’বা ঘরের ছাদ ছিল না। দেয়াল ছিল মাত্র ৯ হাত উঁচু। কা’বা চত্ত্বর ঢালুতে থাকায় বানের পানিতে ভরে যেত বাইতুল্লাহর ভিতর।
কোরাইশ নেতারা উদ্যোগ নিলে নবীজির পিতার মামা
আবু ওহব আমর মাখযূমী এক ভাষন দিলেন।
লোক সকল!
আল্লাহ্ পবিত্র। তিনি পবিত্র্ই পছন্দ করেন।
বাইতুল্লাহর সম্মানে নির্মাণ কাজে সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি হারাম উপার্জনের একটা কড়িও লাগানো যাবে না। হালাল মাল যা আছে নিয়ে এসো।
বন্টন করা হল একএক অংশের উপাদান এক এক গোত্রের স্কন্ধে।
দরজার দিকটা বনী আবদে মনাফ ও বনী যোহরার দায়িত্বে। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যভাগ বনী মাখযূম ও কোরাইশের অন্যান্য গোত্রের অংশে। বাইতুল্লাহর পেছন দিকটা বনী জাহম ও বনী সাহম এর ভাগে। হাতীমের দিকটা বনী আব্দুদ্দার বিন কুসাই, বনী আসদ ও বনী আদীর অধীনে।

ইতোমধ্যে খবর এল জেদ্দার সমুদ্রবন্দরে একটা জাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। সহজে কাঠ সংগ্রহ করা যাবে। ওলীদ বিন মুগীরা সেখান থেকে শুধু কাঠ নয় বাকূম রুমী নামে এক কাঠমিস্ত্রীও সাথে নিয়ে আসলেন।

সকল উপাদান উপস্থিত। পুরাতন বাইতুল্লাহর ভাঙ্গবে কে ? কারো সাহস হচ্ছিল না। ওলীদ বিন মুগীরাই
اللهم لا نريد الا خيرا
বলে হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর দিক থেকে ভাঙ্গতে শুরু করলেন।
লোকেরা বলতে শুরু করল রাতটা যাক। সকালে দেখি ওর কি অবস্থা হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে পাকড়াও হলে আমরা কা’বা ঘর পুরাতন ভিত্তির উপর ছেড়ে দেবো। নতুবা ওর সাথে যুগ দেবো।
সকালে সবাই দেখল তিনি সুস্থ। কাজে হাজির। সকলে মিলে পুরাতন দেয়াল ভাঙ্গতে শুরু করল।
ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দেয়ালের নীচে এসে এক পর্যায়ে গোটা মক্কায় প্রকান্ড বিস্ফোরণের প্রচন্ড আওয়াজ শুনা গেল। সকলে ভিত সন্ত্রস্ত হয়ে আর নীচে যেতে চাইল না।
এখান থেকেই পুনঃনির্মান শুরু করল।
বন্টন মোতাবেক প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাগের পাথর-কাঠ নিয়ে এসে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করল।

এ পর্যন্ত বাইতুল্লাহর নির্মাণে বরকত লাভে আশায় সকলেই সাধ্যমত অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিপত্তি ঘটল এমন একটা কাজে, যাতে সকলের অংশগ্রহণ সম্ভব না। আর তা হল হাজরে আসওয়াদ স্বস্থানে প্রতিস্থাপন।

সকলেই এই কাজটা করে সম্মানের ভাগ বেশি পাওয়ার মানসে তুমুল ঝগড়া শুরু করল। এমনকি তরবারী উচিয়ে পরস্পরের মাঝে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল।
এ ভাবেই চলে গল তিন-চার দিন। অবস্থা বেগতিক দেখে তৎকালীন মক্কার সর্বোচ্চ বয়ষ্ক-প্রবীন আবু উমাইয়া বিন মুগীরা মাখযূমী একটা প্রস্তাব রাখলেন।

আগামী ভোরে সবার আগে যিনি মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে ঢুকবেন আমরা তাঁর ফায়সালা মেনে নেব। সবার ঐক্যমত্যের পর সকালে দেখা গেল মহা-নবী সাঃ সকলের আগে হাজির।
সকলেই সমস্বরে বলে উঠল
هذا محمد الأمين رضينا محمد الأمين
তিনি আমাদের বিশ্বস্ত মুহাম্মদ। আমরা তার সিদ্ধান্ত মেনে নেব।
নবীজি একটা চাদর আনতে বললেন। চাদর আনা হল। তিনি হাজরে আসওয়াদ চাদরে রাখলেন। অতঃপর সকল গোষ্ঠীর নেতাদেরে বললেন সকলে মিলে চাদরে ধরে প্রতিস্থাপনস্থলের কাছে নিয়ে রাখ।
সকলে মিলে তাই করল। ঐক্য-সাম্য, সৌহার্দ্য -শৃংখলার এক অনন্য নজীর স্থাপন হল।
অতঃপর তিনি চাদর থেকে নিজ হস্ত মোবারক দ্বারা স্ব স্থানে পুনঃস্থাপন করলেন।

এভাবেই নিভে গেল প্রায় সপ্তাহকাল ধরে চলমান যুদ্ধাংদেহি পরিস্থিতির অশান্তির আগুন। স্বজনপ্রীতি পরিহার করে সাম্যনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি যে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত করেছিলেন তা আজও আমাদের মনুষ্য সমাজের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
আবশ্য এর আগে তাঁর ব্যক্তিজীবনকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন সবার আপন করে। আর এটাই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান সোপান।

-হুসাইন আহমাদ বাহুবলী
লেখক,শায়খুল হাদিস।