রামাজানের শিক্ষা যেন ভুলে না যাই

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ৩১ ২০২০, ১২:২৪

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দিন আহমদ

মুমিনের আত্মতুষ্টি ও আত্মশুদ্ধির মাস ছিল বরকত ও রহমতময় মাহে রামাজান । এটি ছিল তাদের জন্য আত্মসমর্পণ ও মাগফিরাতের মাসও। পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেছেন ।

আল্লাহ পাক তার রোযাদার বান্দাদের জন্য এ মাসে ক্ষমা ও পুরস্কারের ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ পাক বলেন,নিশ্চয়ই মুমিন নারী ও পুরুষ যারা রোযাদার তাদের জন্য রাখা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ হতে মাগফিরাত ও মহা পুরস্কার । ( সুরা আহযাব-৩৫)

রব্বে কারীম চান রোযাদার বান্দাগণ সবাই তাদের পালনকর্তার সেই প্রতিশ্রুতি লাভ করুক ।

রোযাদার সকল মুমিনের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস যে মহান আল্লাহ কাউকে তার দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে মাহরুম বা বঞ্চিত করবেন না । এরূপ দৃৃঢ় আশা ও বিশ্বাস নিয়েই রোযাদার বান্দাগণ পূর্ণ একটি মাসকে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অতিবাহিত করেছেন ।

খোদার দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি তিনি নিজেই তাঁর সায়িম বান্দাদের দেন এ কথাও হাদিসে বর্ণিত রয়েছে ।

যেমন: এ ব্যাপারে একটি বর্ণনা রয়েছে যে,আল্লাহ পাক বলেন,প্রত্যেক ইবাদতই ইবাদতকারী ব্যক্তির জন্য, পক্ষান্তরে রোযা আমার জন্য । আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। (সহীহ বুখারী হাদীস-১৯০৪)

আমাদের জন্য লক্ষণীয় বিষয় হলো পূর্ণ একটি মাস আমরা সিয়াম সাধনায় কাটিয়েছি ।

আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে আমরা দিনের বেলায় উপবাস বা অনাহার থেকেছি । মানসিক ও শারীরিক সকল প্রকার চাহিদাকে দিনের বেলায় বিসর্জন দিয়েছি। আর রাতের বেলায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ,তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য যিকির আযকার সহ কুরআন তিলাওয়াত করেছি অনেক । এটাই কী আমাদের শেষ করণীয় আমল ও সফলতার জন্য যথেষ্ট ? নাকি মাহে রামাজান পরবর্তী সময়েও এরূপ এবাদত বন্দেগি আমাদেরকে অব্যাহত রাখতে হবে ?  রামাজান তো আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে কীভাবে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায় ।

তাছাড়া রামাজান আমাদের এই শিক্ষাও দিয়েছে যে, সব মিথ্যা-অসত্য,অন্যায়-অবিচার-অনাচার,লোভ-লালসা,পাপ ও গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে শুধুমাত্র এক আল্লাহর হুকুম পালনার্থে ত্যাগ,সংযম,আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে উন্নত মানবীয় গুণাবলী অর্জন করতে।

রমজানের এক মাসের রোজার দ্বারা এই শিক্ষাও লাভ হয়,ধনী ব্যক্তিরা বুঝতে পারে উপবাস থাকলে কি কষ্ট হয়, সারা বছর যারা অনাহারে অর্ধাহারে থাকে তাদের কি পরিমাণ তারা কষ্ট তা অনুধাবন করা যায়। আর তাদের প্রতি অনুগ্রহের হাত প্রসারিত করা যায়। গরিব-দুঃখীরা না খেয়ে থেকে কী অবর্ণনীয় কষ্ট করে তা উপলদ্ধি করতে পারলে সমাজে শান্তি আনয়ন সম্ভব হয়।তাই রামাজান পরবর্তী সময়েও রামাজানের শিক্ষা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা।

বরং পবিত্র মাহে রামাজানের আমলগুলোকে পরবর্তী মাস সমূহেও আমাদের জীবনে চলমান রাখতে হবে ।

এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে রামাজান পরবর্তী সময়ের জন্য রাসূলের বাতানো সকল দিক নির্দেশনাকেও ।

এক রামাজানের পর থেকে আরেক রামাজানের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সকল প্রকার মিথ্যা,অন্যায়-অনাচার,লোভ-লালসা,চুরি ও ডাকাতি সহ নানাবিধ গর্হিত কাজ থেকে ।

এজন্যই তো আল্লাহ্‌র রাসূল (সা:) আমাদের জন্য রামাজান পরবর্তী কিছু আমল বাতলে দিয়েছেন। যার বাস্তবায়ন করতে পারলে একজন রোযাদার সারা বছর আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভে থাকতে পারে ।রামাজান পরবর্তী সময়ে রাসূলের বর্ণিত কিছু আমল ও নির্দেশনা নিম্নে পেশ করছি ।

♢ শাওয়ালের ছয়টি রোযা :

হযরত আবু আইয়্যুব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রামজানের রোযা রেখেছে এবং পরে শাওয়াল মাসের ছয়দিন রোযা রেখেছে, সে সারা বৎসরের রোযা রাখার সওয়াব পাবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১১৬৪)

হাদিসে বর্ণিত রোযার হুকুম হলো নফল । শাওয়াল মাসে এক সাথে কিংবা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পূর্ণ এক মাসে উক্ত রোযা ছয়টি রাখা যায় ।

♢ যুলহজ্জে প্রথম দশকে রোযা পালন :

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা:)বলেছেন,এই দিনগুলি (অর্থাৎ যুলহিজ্জার প্রথম দশ দিনের তুলনায় এমন কোন দিন নেই ,যাতে কোন সৎকাজ আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।লোকেরা বলল,আল্লাহ্‌র পথে জিহাদও নয় কী ? তিনি বললেন, আল্লাহ্‌র পথে জিহাদও নয় ।

তবে কোন মুজাহিদ ব্যক্তি যদি তার জান মালসহ বের হয়ে যায় এবং তার কোন কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে ( অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করে,তাহলে হয়তো তার সমান হতে পারে । ( বুখারী শরীফ: ৯৬৯)

♢ আরফার রোযা : 

আবু কাতাদাহ (রা:) বলেন,আল্লাহ্‌র রাসূল (সা:) কে আরফার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন,তার পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গোনাহ মোচন করে দেয় । ( মুসলিম শরীফ :১১৬২ )

♢ মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে রোযা :

হযরত ইবনে আব্বাস(রা:) হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা:) আশুরার ( মুহাররম মাসের দশম ) দিনে স্বয়ং রোযা রেখেছেন এবং ঐ দিনে রোযা রাখতে আদেশ করেছেন । (বুখারী: ২০০৪ মুসলিম : ১১৩০ )

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, আগামী বছর যদি আমি বেঁচে থাকি,তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব । ( অর্থাৎ নবম ও দশম দুদিন ব্যাপী রোযা রখব । ( মুসলিম শরীফ: ১১৩৪ )

♢ সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা:

হযরত আবু কাতাদাহ(রা:)হতে বর্ণিত,তিনি রাসূলুল্লাহ(সা:) কে সোমবার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন ওটি এমন একটি দিন, যেদিন আমার জন্ম হয়েছে,যেদিন আমি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছে অথবা ঐ দিনে আমার প্রতি ( সর্বোত্তম ) অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে । ( মুসলিম শরীফ : ১১৬২ )

হযরত আবু হুরাইরা(রা:)হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,(মানুষের) আমলসমূহ সোম ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহ্‌র দরবারে ) পেশ করা হয় । তাই আমি ভালোবাসি যে,আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক যখন আমি রোযার অবস্থায় থাকি ।

ইমাম মুসলিমও এটি বর্ণনা করেছেন,তবে তাতে রোযার উল্লেখ নেই । (তিরমিযীর হাসান হাদীস : ৭৪৭ মুসলিম ২৫৬৫ )

হযরত আয়েশা(রা:)হতে বর্ণিত তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (সা:) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার জন্য সমধিক সচেষ্ট থাকতেন । ( তিরমিযীর হাসান হাদীস : ৭৪৫ )

♢ প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা রাখা মুস্তাহাব

আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাকে তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন,(১)প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা পালন করা।(২) চাশতের দু রাকাত নামায আদায় করা।

(৩) এবং নিদ্রা যাবার পূর্বে বিতির নামায পড়া । ( বুখারী ১১৭৮,মুসলিম ৭২১)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ(সা:)বলেছেন,প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখা সারা বছর ধরে রোযা রাখার সমান । ( বুখারী:১১৫৯)

হাদিসে বর্ণিত প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখার যে কথা বলা হয়েছে তা মাসের যেকোন দিন রাখা যাবে ।

হযরত মুআযাহ আদাভিয়্যাহ কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে হযরত আয়েশা (রা:) কে এব্যাপারে রাসূলের আমল জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন,রাসুল প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখতেন আর তা তিনি মাসের যেকোন দিন রোযা রাখতে পরোয়া করতেন না। ( মুসলিম হাদীস:১১৬০)

♢ প্রতি মাসে ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা :

আবু জর ( রা:) থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ(সা:) বলেন, প্রত্যেক মাসে নফল রোযা পালন করলে ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করো । ( তিরমিযীর হাসান হাদীস : ৭৬১)

উপরে বর্ণিত হাদীস সমূহে যেসমস্ত রোযার কথা বলা হয়েছে তা নফল ও মুস্তাহাব এবং অনেক ফজিলতপূর্ণ । এগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ ও ইহ-পরকালীন জীবনের পূর্ণ সফলতা অর্জন হবে । চলমান থাকবে রামাজানের শিক্ষা আমাদের বাস্তব জীবনে ।

আল্লাহ পাক সেসব আমলগুলো বিশুদ্ধভাবে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য সারা বছর যেন করার তাওফিক দান করেন । আমীন