রমজানের জরুরি কিছু মাসাইল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৬ ২০২০, ২১:৫৮

হুসাইন আহমদ মিসবাহ:

অধিকাংশ সৎ কাজের সাওয়াব আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হিসেবের খাতায় সাওয়াব লিখার দায়িত্বও দিয়েছেন নির্দিষ্ট ফেরেস্তাকে। তবে রোজার কোন সাওয়াব আল্লাহ নির্ধারণ করে দেননি। কারণ রোজার সাওয়াব অসীম। বিশ্বনবী সা. বলেন, “আল্লাহ বলেছেন, বান্দা আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য রোজা রাখে, তাই আমি আল্লাহ নিজেই তার রোজার প্রতিদান”। অন্য কোন আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজেকে প্রতিদান হিসেবে ঘোষণা করেন নি। সুতরাং রোজা মুমিনদের জন্য খোদাপ্রদত্ত অতুলনীয় নেয়ামত। অথচ রোজার অনেক বিধি-বিধান পুরোপুরী জানা না থাকায় আমাদের অনেকের রোজা নষ্ট হয়, হালকা হয়, আমরা বুঝতেই পারিনা। তাই রোজা বা রমযানের ফযিলত, গুরুত্ব, তাৎপর্য, শিক্ষা, ইতিহাস, ইত্যাদির দিকে আজ যাবনা। আমাদের রোজাকে আরো প্রাণবন্ত এবং মাকবুল হওয়ার প্রয়াসে, রোজার মাসাইল ও আনুসাঙ্গিক কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই।

এক. রোজা:-

রোজার নিয়তে, সোবহে সাদিক (সকাল) থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বপ্রকারের পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পুরণ হতে বিরত থাকার নাম হল রোজা।

দুই. রোজার প্রকারভেদ:-

রোজা মোট ৭ প্রকার। ১. ফরজ, ২. ওয়াজিব, ৩. সুন্নত, ৪. মুস্তাহাব, ৫. মাকরুহ, ৬.হারাম, ৭. নফল।

১. ফরজ রোজা :

রজমাজান শরীফের রোজা ফরজ। সেটা নিয়মিত হোক অথবা কাযা হোক।

২. ওয়াজিব রোজা :

মান্নতের রোজা ওয়াজিব। কোন নফল রোজা ভেঙ্গে ফেললে সেটাও পরে রাখা ওয়াজিব।

৩. সুন্নত রোজা :

মুহাররামের ১০ তারিখের রোজা সুন্নত। তবে শুধূ ১০ তারিখ রাখলে হবে না, একসাথে ২টি রাখতে হবে, হয় ৯, ১০ তারিখ নতুবা ১০, ১১ তারিখ।

৪. মোস্তাহাব রোজা :

প্রত্যেক আরবী মাসের মধ্যের ৩দিন অর্থাৎ ১৩, ১৪, ১৫, তারিখ রোজা রাখা মোস্তাহাব, এটাকে ‘আইয়াম বীযে’র রোজা বলে। প্রতি সোমবার রোজা রাখা মোস্তাহাব। শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। সাওমে দাউদ মোস্তাহাব। আর সাওমে দাউদ হল, বছরের নিষিদ্ধ ৫দিন ব্যতিত পুরো বছর ১দিন রোজা রাখা এবং পরের দিন রোজা না রাখা।

৫. মাকরুহ রোজা :

লাগাতার রোজা রাখা মাকরুহ। লাগাতার রোজা হলো ইফতার না করে একসাথে ২টি রোজা রাখা, অথবা রমজান ব্যতিত ধারাবাহিক ভাবে দীর্ঘদিন এক সাথে রোজা রাখা। মোহাররামে শুধু ১টি রোজা রাখা মাকরুহে তাহরীমী।

৬. হারাম রোজা :

বছরের ৫দিন রোজা রাখা হারাম। ঐদিন কেউ রোজা রাখলে সেটাই হবে হারাম রোজা। আর সেই ৫দিন হল ২ ঈদের ২দিন এবং আইয়ামে তাশরীকের ৩দিন।

৭. নফল রোজা :

উল্লেখিত রোজা ব্যতিত বাকী কোন দিন রোজা রাখা নফল।

তিন. রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত:-

নিম্ন বর্ণিত শর্তাবলী যার মাঝে একসাথে পাওয়া যাবে তার উপর রোজা ফরজ। ১. রমজান মাস পেলে, ২. মুসলমান হলে, ৩. প্রাপ্ত বয়স্ক হলে, ৪. সুস্থ্য জ্ঞান সম্পন্ন হলে, ৫, মুকিম হলে, ৬. রোজা রাখা নিষিদ্ধ হয় এমন রোগ থেকে মুক্ত থাকলে।

চার. রোজা বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত:

রোজা বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত ৩টি।

১। রোজার নিয়ত করা।

২। রোজা আদায়ে অন্তরায় সমূহ থেকে মুক্ত থাকা, যেমন মহিলাদের ঋতুস্রাব ও প্রসবোত্তর স্রাব।

৩. রোজা বিনষ্টকারী বস্তুসমুহ থেকে মুক্ত থাকা।

পাঁচ. রোজার নিয়ত:-

মনে রাখতে হবে, কোন রোজায় নিয়ত পড়া ফরজ নয় বরং নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত হল মনে সংকল্প। রোজা রাখার ইচ্ছা। আর নিয়ত পড়া হল নিয়তের নিম্ন বর্ণিত বাক্যগুলো মুখে উচ্চারন করা।

নিয়তবাক্য :

নাওয়াইতু আন্ আসুমা গাদাম মিন শাহরি রামাযানাল মুবারাকি, ফারযাল্লাকা ইয়া আল্লাহ, ফাতাকাব্বাল মিন্নী, ইন্নাকা আন্তাছ ছামীউল আলীম।

ছয়. যে সব কারণে রোজার কাযা ও কাফ্ফারা উভয় ওয়াজিব হয়:-

১. গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যতিত ইচ্ছাকৃত ভাবে পানাহার করলে। হোক সেটা খাদ্যদ্রব্য বা অন্য কিছু।

২. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত ভাবে সহবাস করলে।

৩. রোজা অবস্থায় মুখে কিছু পড়ার পর তা ইচ্ছাকৃত ভাবে গিলে ফেললে।

সাত. রোজার কাফ্ফারা:-

রোজার কাফ্ফারা হল-

১. একজন কৃতদাসকে মুক্ত করে দিতে হবে।

২. যদি কৃতদাসকে মুক্তকরা সম্ভব না হয় তাহলে ধারাবাহিক ভাবে ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে। মধ্যখানে কোন দিন বাদ পড়লে পরদিন থেকে আবার নতুন করে ৬০টি রোজা রাখতে হবে।

৩. আর ধারাবাহিক ৬০টি রোজা রাখতে না পারলে ৬০ জন মিসকিনকে ২ বেলা পেঠভরে খাবার দিতে হবে।

৪. ৬০ জন মিসকিনকে খানা খাবাতে না পারলে, ৬০ জনের প্রত্যেককে ১টি ফিতরা পরিমাণ খাবার অথবা তার মূল্য দিতে হবে। ফিতার পরিমান মানে- গম, আটা, ছাতু হলে পোণে দুই কেজি। খেজুর, যব, কিচমিচ হলে সাড়ে তিন কেজি।

আট. যে সব কারণে রোজার শুধু কাযা ওয়াজিব হয়:-

১. ভুল বশত কোন কিছু খাবার পর রোজা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত ভাবে খেলে।

২. ভুল বশত সহবাস করার পর রোজা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত ভাবে সহবাস করলে।

৩. নাকে বা কানে এমন ভাবে ঔষধ দেওয়া, যা ভেতরে প্রবেশ করে।

৪. কোন ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগানো, যা ভেতরে প্রবেশ করে।

৫. অনিচ্ছায় মুখের ভেতর দিয়ে কোন দ্রব্য পেটে চলে গেলে।

৬. কোন মহিলা জোরপুর্বক সহবাসের শিকার হলে।

৭. মুকিম ব্যক্তি মুসাফির হয়ে রোজা ভেঙ্গে ফেললে।

৮. সোবহে সাদিক হয়নি মনে করে সোবহে সাদিকের পর সাহরী খেলে কিংবা সহবাস করলে।

৯. ইফতারের সময় হয়ে গেছে ভেবে সুর্যযাস্তের পূর্বে ইফতার করলে।

১০. মৃত ব্যক্তি কিংবা কোন চতুস্পদ জন্তুর সাথে জৈবিক চাহিদা পুরণ করলে।

১১. গলার ভেতরে কোন ধোঁয়া প্রবেশ করালে।

১২. মুখ ভরে বমি করলে।

১৩. অল্প বমি মুখে আসার পর তা আবার খেয়ে ফেললে।

১৪. দাতের ফাকে আটকে থাকা দ্রব্য খেয়ে ফেললে।

১৫. পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে গেলে।

১৬. পাগল হয়ে গেলে।

নয়. যে সব কারণে রোজা নষ্ট হয় না:-

১. ভুলবশত পানাহার কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে।

২. শুধু দর্শন অথবা চিন্তার দ্বারা শারীরিক স্পর্শ ব্যতিত বীর্যপাত হলে।

৩. তৈল, সুরমা, আতর, শিংগা লাগালে।

৪. রোজা ভেঙ্গে ফেলার নিয়ত করে রোজা না ভাঙ্গলে।

৫. অনিচ্ছাকৃত ভাবে গলায় ধোয়া প্রবেশ করলে।

৬. গলার ভেতর ধুলাবালু প্রবেশ করলে।

৭. মুখের ভেতর দিয়ে মাছি প্রবেশ করে পেটে চলে গেলে।

৮. গলায় ঔষধের স্বাধ অনুভব করলে।

৯. অপবিত্র অবস্থায় সোবহে সাদিক হলে।

১০. পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দিয়ে পানি প্রবেশ করলে।

১১. গোছলের সময় কানে দিয়ে পানি ঢুকলে।

১২. নাকে শ্লেষ্মা আসার পর তা ভেতরে টেনে নিলে।

১৩. হালকা বমি অসার পর তা অনিচ্ছায় ভেতরে চলে গেলে।

দশ. যেসব কারণে রোজা ভেঙ্গে ফেলা জায়েয:-

১. জটিল বা কঠিন রোগ বৃদ্ধি পাওয়া বা দীর্ঘায়িত হবার প্রবল আশংকা হলে।

২. রোগে বা অন্য কোন কারণে প্রাণ চলে যাবার আশংকা হলে।

৩. গ্রহণযোগ্য চিকিৎসকের মতামত অনুযায়ী দুগ্ধপোষ্য সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি হবার আশংকা থাকলে।

৪. মারা যাবার উপক্রম প্রবল পিপাসার্ত হলে।

৫. শরীয়ত নির্ধারিত মুসাফির হলে।

৬. একেবারে বার্ধক্যে উপনিত হলে, যার চলা-চলেই সমস্য হয়।

৭. নফল রোজা বিনা কারণে ভেঙ্গে ফেলা জায়েয, তবে পরে কাযা করতে হবে।

এগারো. রোজাদারের জন্য যা মাকরুহ:-

১. কোন প্রকারের বাধ্যবাধকতা ব্যতিত কোন কিছুর স্বাদ আস্বাদন করা।

২. বাধ্যবাধকতা ব্যতিত কোন কিছু চর্বন করা।

৩. মুখের ভেতর থু থু জমা করে গিলে ফেললে।

৪. এমন কাজ করা, যা রোজাদারকে দুর্বল করে দেয়।

৫. গিবত করলে, চোগলখোরী বা গালিগালাজ করলে।

৬। রোজা অবস্থায় টুথপেষ্ট, মাজন, কয়লা ব্যবহার করা।

৭। গোছল ফরজ অবস্থায় গোছল না করলে।

৮। শরীর থেকে এই পরিমাণ রক্ত দেওয়া, যাতে শরীর দুর্বল হয়।

৯। নিজেকে নিয়ন্ত্রনের আশংকা থাকা সত্ত্বে স্ত্রীকে চুম্বন করলে।

১০। দাতের ফাকে আটকে থাকা ছোলা থেকে ছোট কোন বস্তু গিলে ফেললে।

বারো. রোজাদারের জন্য যা মাকরুহ নয়:-

১। স্ত্রীকে চুম্বন অথবা আলিঙ্গন করলে, যদি বীর্যপাতে নিরাপদ থাকে।

২। তেল, সুরমা, আতর লাগালে।

৩। দেহ থেকে রক্ত বের করলে, যদি শরীর দুর্বল না হয়।

৪. ঠাণ্ডার জন্য গোছল করলে বা ভিজে কাপড় শরীরে পেছিয়ে রাখলে।

তেরো. রোজাদারের জন্য যা মোস্তাহাব:-

১। সাহরী খাওয়া।

২. যথা সম্ভব সময়ের শেষ ভাগে সাহরী খাওয়া।

৩. সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা।

চৌদ্দ. ইফতার:-

ইফতারের অনেক ফজিলত হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। রোজাদারকে ইফতার করানো সাওয়াবের কাজ, এতে আমার কোন দ্বিমত নেই। তবে রোজা রেখে কাউকে ইফতার করাতে বাধ্য করা ঠিক নয়।

বিশেষত ইফতারের নামে যৌতুককে বৈধতা দেওয়া যায়না। অর্থাৎ কনেপক্ষ্য বাধ্যতামূলক ভাবে বরপক্ষকে যে ইফতার দেয়, সেটাই ইফতারের নামে যৌতুক।

হ্যা, কনেপক্ষ্য কোন প্রকারের চাপ ব্যতিত বরপক্ষকে যা ইচ্ছে ইফতার প্রদান করে, তাতে কোন সমস্যা নেই। আর যদি কনের বাড়ী ইফতার না দিলে, সমালোচনা, লোকলজ্জা কিংবা কনের তিক্তকথা শুনার সম্ভাবনা থাকে এবং এই কারণে কনেপক্ষ ইফতার প্রদান করে, তাহলে তাতে ইফতারের কোন সাওয়াব হবে না, বরং যৌতুক হিসেবে অপরাধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাই রোজাদার হিসেবে নিজ সামর্থে যা সম্ভব হয়, তা দিয়েই ইফতার করা উচি, অন্যকে বাধ্য করে ইফতার এনে ইফতার করা লজ্জাজনক।

পনেরো. ইতিকাফ:-

সংজ্ঞা : সাওয়াবের নিয়তে নির্দিষ্ট পরিমান সময়, যথাযথ পদ্ধতিতে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। মহিলারা যে গৃহে নামাজ আদায় করেন, সেটাই তাদের জন্য মসজিদ হিসেবে গণ্য।

ষোল. ইতিকাফের প্রকারভেদ:-

ইতিকাফ ৩ প্রকার।

১. ওয়াজিব, ২. সুন্নত, ৩. মোস্তাহাব।

১. ওয়াজিব ইতিকাফ : মান্নতের ইতিকাফ হল ওয়াজিব। হোক সেটা নির্দিষ্ট কিংবা অনির্দিষ্ট।

২. সুন্নত ইতিকাফ : পবিত্র রমজান মাসের শেষের দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নত ইতিকাফ।

৩. নফল ইতিকাফ : বর্নিত ইতিকাফদ্বয় ব্যতিত বাকী সকল ইতিকাফ হল নফল ইতিকাফ।

সতেরো. ইতিকাফের সময়:-

ওয়াজিব ইতিকাফের বেলায় যত সময়ের মান্নত করা হয়েছে, তত সময় ইতিকাফ করতে হবে।

সুন্নত ইতিকাফের ক্ষেত্রে ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে এবং শাওয়ালে চাদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হতে হবে।

আর নফর ইতিকাফের বেলায় কোন নির্ধারিত সময়সীমা নেই।

আটারো. যে সব কারণে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন:-

১. শরয়ী কারণ, যেমন অজু করা, জুমুআর নামাজ আদায় করা, যদি মসজিদটি জামে মসজিদ না হয়।

২. প্রাকৃতিক কারণ, যেমন প্রশ্রাব করা, প্রকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া বা পবিত্র হওয়ার জন্য।

৩. জরুরী কারণে, যেমন মসজিদ ভেঙ্গে গেলে।

৪. বাধ্যতামূলক কারণে, যেমন কোন অত্যাচারি জোরপূর্বক মসজিদ থেকে বের করে দিলে।

৫. আশংকা জনক কারণে, যেমন ইতিকাফকারীরা বিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে প্রাণ যাবার আশংকা থাকলে। তবে উল্লেখিত কারণে মসজিদ থেকে বের হলে আবার সাথে সাথে অন্য মসজিদে ঢুকে যেতে হবে।

ঊনিশ. ইতিকাফকারী যা করতে পারবেন:-

১. ইতিকাফকারী মসজিদে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন।

২. নিদ্রা যেতে পারবেন।

৩. মসজিদে থেকে নিজ পরিবারের খুজ খবর নিতে পারবেন।

৪. পরিবারবর্গের জন্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন, তবে মসজিদে মালামাল নিয়ে আসা মাকরুহ।

বিশ. যে সমস্ত কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়:-

১. উল্লেখিত কারণ ব্যতিত মসজিদের বাইরে বের হলে বা বাইরে থাকলে।

২. ইতিকাফ অবস্থায় সহবাস করলে।

৩. এমন কাজ করা, যা স্ত্রী সহবাসের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং বীর্যপাত ঘটে।

একুশ. তারাবীহ:-

তারাবীহ’র সময় :

তারাবীহ’র নামাজের সময় হল, ইশার নামাজ আদায় করার পর হতে সোবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত। কোন অবস্থাতেই ইশার নামাজের পূর্বে তারাবীহ’র নামাজ পড়া যাবেনা।

বাইশ. তারাবীহ’র প্রকারভেদ:-

তারাবীহ’র নামাজ দুভাবে পড়া হয়- ১. খতম তারাবীহ. ২. সুরা তারাবীহ।

১. খতম তারাবীহ: শুধু তারাবীহ’র নামাজে পবিত্র কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খতম করা হয়, এটাই খতম তারাবীহ।

২. সুরা তারাবীহ : প্রতিদিন তারাবীহ পড়া হয়, কিন্তু সমস্ত কুরআন মজিদ খতম করা হয়না, এটাই সুরা তারাবীহ।

তেইশ. তারাবীহ’র বিধান:-

তারাবীহ’র নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তারাবীহ’র নামাজ ইশার নামাজের তাবে (অনুগত)। সম্মিলিত ভাবে ইশার নামাজ জামাতে না পড়ে শুধু তারাবীহ’র নামাজ জামাতে পড়া যাবে না। যদি ইশার নামাজ জামাতে আদায় করার পর জামাতে তারাবীহ পড়া অবস্থায় কেউ আসে, তাহলে সে, একা ইশার নামাজ আদায় করে তারাবীহ’র জামাতে শামীল হতে পারবে। তারাবীহ’র নামাজে প্রতি ৪ রাকাত পর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম বা বিরতি নেওয়া মুস্তাহাব। এই বিরতির সময় একেবারে নিরব থাকা যায়, তবে মনে মনে নফল দোয়া পড়া উত্তম। এই বিরতিতে “সুবহানা যিল মুলকী…” পড়া যাবে, কিন্তু সেটা কুরআন-হাদীস নির্ধারিত নয়।

চব্বিশ. তারাবীহ’র রাকাত:-

বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য ফাতাওয়া অনুযায়ী তারাবীহ’র নামাজ ২০ রাকাত। কারণ-

এক. রাসুল সা. এর জামানায় তারাবীহ ২০ রাকাত পড়া হয়েছে। রাসুল সা. নিজে ২০ রাকাত পড়েছেন।

দুই. দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রা. এর জামানায় রাষ্ট্রীয় ভাবে ২০ রাকাত তারাবীহ ঘোষণা করা হয়েছে। হযরত উমর রা. কুরুনে ছালাছার অন্তর্ভূক্ত, তাঁর অনুমোদনও ইসলামি শরীয়তে হাদীস।

তিন. পরবর্তীতে প্রায় আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিন ও উলামায়ে কেরামগণের ২০ রাকাত অনুযায়ী তারাবীহ’র নামাজ আদায় করেছেন। তাই ২০ রাকাতের উপর ইজমা হয়ে গেছে। আর মুসলমানদের ইজমাও ইসলামি শরীয়তে দলিল।

চার. যুক্তিরও দাবী তারাবীহ ২০ রাকাত হবে। কারণ, ‘তারাবীহ’ শব্দ বহুবচন, যার একবচন হল ‘তারবীহাতুন’। আরবীতে বহুবচন শুরু হয় সর্ব নিম্ন ৩ সংখ্যা থেকে। ‘তারবীহাতুন’ শব্দের অর্থ বিশ্রাম বা বিরতি। তারবীর নামাজে প্রতি ৪ রাকাত পর পর যে কিছুক্ষর বিশ্রাম বা বিরতি নেওয়া হয়, তাকেই তারবীহাতুন বলে। তাই তারাবীহ হতে হলে কমপক্ষে ৩ টি বিরতি নিতে হবে। যেহেতু তারাবীহ’র রাকাত সংখ্যা ৮ হবে না ২০ হবে তা নিয়েই মতানৈক্য, তাই ৩ বার বিরতি নিলে কখনো ৮ রাকাত হবে না। সুতরাং এই নামাজকে তারাবীহ বললে ৮ রাকাত পড়া যাবেনা, ২০ রাকাত পড়তে হবে। নতুবা তারাবীহ না বলে এই নামাজকে তারবীহাতুন বলতে হবে।

পঁচিশ. তারাবীর হাদিয়া:-

খতম তারাবীহ’র হাদিয়া নিয়েও কিছুটা মাতনৈক্য রয়েছে। তাই নির্ভরযোগ্য ফাতাওয়াহ হল- কন্টাক্ট, প্রত্যোক্ষ-পরোক্ষ দাবী ব্যতিত হাফিজ সাহেব তারাবীহ পড়ালে মুসল্লিরা তাকে হাদিয়া হিসেবে টাকা দিলে সেটা বৈধ। অন্তরে টাকার প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। শুধু তারাবীহ নয়, কোন দ্বীনী কাজেই অন্তরে টাকার প্রত্যাশা অনুচিত।

ছাব্বিশ. তারাবীহ নিয়ে বিভ্রান্তি:-

তারাবীহ’র নামাজ নিয়ে আমাদের সামাজে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে-

ক. অনেকের ধারণা, তারাবীহ’র নামাজ না পড়লে রোজা আদায় হবেনা অথবা রোজা হালকা হয়ে যাবে, এই ধারণাটি ঠিক নয়। তারবীহ’র নামাজ না পড়া সেটা সতন্ত্র অপরাধ। রোজার মাসআলায় ত্রুটি না হলে রোজার সমস্যা হবেনা।

খ. প্রতি ৪ রাকাত পর পর বিরতিতে “সুবহানা যিল মুলকী…” পড়তে হবে, নতুবা তারাবী হবে না বা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, এই ধারণাটিও ঠিক নয়। বিরতিতে নফর দোয়া পড়া উত্তম হলেও “সুবহানা যিল মুলকী…” তারাবীহ’তে কবে থেকে যুক্ত হয়েছে, তার ইতিহাস পাওয়া যায় না।

গ. কারো ধারণা, তারবীহ’র প্রতি দ্বিতীয় রাকাতে ‘সুরা এখলাস’ পড়তে হবে, এই ধারণাটিও ঠিক নয়। সুরা এখলাস পড়া যাবে, তবে একই নামাজে কোন সুরা পুনরাবৃত্তি করা অনুত্তম।

সাতাশ. শবে কদর:-

শবে কদর ফার্সী বাক্য। ‘শব’ অর্থ রাত বা রজনী আর ‘কদর’ অর্থ মর্যাদাশীল, মহিমান্বিত বা দামী। তাই ‘শবে কদর’ অর্থ মহিমান্বিত রজনী। এর আরবী প্রতিবাক্য “লাইলাতুল ক্বাদ্র”।

মাহাত্মা : এই রাত ত্রিশ হাজার (৩০,০০০) দিনরাত থেকেও উত্তম। কতটুকু উত্তম তাও অনির্ধারিত। অর্থাৎ ত্রিশ হাজার দিনরাত ইবাদত করলে যে পরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যাবে, এই একটি রাতের ইবাদতে তার থেকেও বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে।

কারণ : মাহাত্মের কারণ হল এই রাতেই সম্পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হয়। যা পরবর্তী ২৩ বছরে পৃথিবীবে এসেছে।

আটাশ. শবে কদর কোন রাত:-

শবে কদর কোন রাত, সেটা অনির্ধারিত বা গোপন। হাদীসে রাসুল সা. এর ইঙ্গিত এর আলোকে মুজতাহিদগণ এই রাত নির্ধারণের ব্যাপারে অনেক মত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে কয়েকটি মত পেশ করা হল-

এক. বছরের যে কোন রাত শবে কদর হতে পারে।

দুই. পবিত্র রমজানের মধ্যে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তিন. পবিত্র রমজানের শেষের ১০ দিন শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি।

চার. পবিত্র রমজানের শেষের ১০ দিনের বেজোড় রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

পাঁচ. অধিকাংশ সাধারণ মুসলমানের ধারণায় ২৭ রমজান শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা। মূলত, এই ২৭ তারিখের ধারণা এসেছে ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর একটি যুক্তি থেকে। ইমাম আবু হানিফা রাহ. বলেছেন, “লাইলাতুল ক্বাদ্র বাক্য কুরআনে এসেছে মোট ৩ বার। আর আরবী “লাইলাতুল ক্বাদ্র” বাক্যে মোট ৯টি অক্ষর রয়েছে। তিন গুণ নয় সমান সাতাশ। হয়তো এটাই আল্লাহর একটি ইশারা।

সারাংশ হল, শবে কদরের ব্যাপারে অনেক মতামত থাকলেও চতুর্থ মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। মূলত এই রাতকে পাবার জন্যই পবিত্র রমজানের শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করা হয়।

শবে কদর গোপন রাখার রহস্য :

এই রাতকে এই জন্যেই গোপন রাখা হয়েছে, যাতে এই রাতের আশায় বান্দাগণ ইবাদত বেশী করে।

ঊনত্রিশ. ফিতরা:-

যে সকল নর-নারীর কাছে ঈদুল ফিরের দিন সুবহে সাদিকের সময় প্রয়োজনাতিরিক্ত জাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে, তার উপর ‘সাদকায়ে ফিতর’ ওয়াজিব। অন্যান্য জাকাতের মত এই সম্পদ এক বছর মালিকানায় থাকা শর্ত নয়। ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পূর্বে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তারও ফিতরা আদায় করতে হবে। ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পরে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে কিংবা সুবহে সাদিকের পূর্বে কেউ মারা গেলে তার ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব নয়। সতর্কতা ও রোজার পরিপুরক হিসেবে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য ফিতরা দেওয়া উত্তম।

ত্রিশ. ফিতরার পরিমাণ:-

অধিকাংশ মানুষের ধারণা ফিতরার পরিমাণ শুধুমাত্র পৌণে দুই কেজি আটা বা তার সমমূল্য, মূলত এই ধারণাটি সঠিক নয়। হাদীসে ফিতরার ৫ঠি পরিমাণ বর্ণনা করা হয়েছে। ১. ‘যব’ হলে এক সা। ২. ‘খেজুর’ এক সা। ৩. ‘কিসমিস’ এক সা। ৪. ‘পনির’ এক সা। ৫, ‘গম’ বা ‘আটা’ আধা সা।

‘সা’র পরিমাণ : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হিসেবে এক ‘সা’ সমান ৩.৩০ কেজি এবং আধা সা পরিমাণ ১.৬৫ কেজি।

এবারের ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ ৭০/- টাকা আর সর্বোচ্চ পরিমাণ ২,২০০/- টাকা।

৩ কেজি ৩০০ গ্রাম (এক সা) ‘পনির’ হিসেবে একটি ফিতরা হবে ২,২০০/- টাকা।

৩ কেজি ৩০০ গ্রাম (এক সা) মধ্যমানের ‘খেজুর’ হিসেবে একটি ফিতরা হবে ১,৬৫০/- টাকা।

৩ কেজি ৩০০ গ্রাম (এক সা) ‘কিসমিস’ হিসেবে একটি ফিতরা হবে ১,৫০০/- টাকা।

৩ কেজি ৩০০ গ্রাম (এক সা) ‘যব’ হিসেবে একটি ফিতরা হবে ২৭০/- টাকা।

১ কেজি ৬৫০ গ্রাম (আধা সা) ‘আটা’র হিসেবে একটি ফিতরার হবে ৭০/- টাকা

একত্রিশ. ফিতরা আদায়ের সঠিক নিয়ম:-

যে যে মাপের ধনী, তার জন্য সে মাপের ফিতরা আদায় করা উচিৎ। তাই ৭০ টাকা বা আটা হিসেবে ফিতরা হল সর্ব নিম্ন শ্রেণীর ধনীর ফিতরা। যার সামন্য পরিমাণ সম্পদ কমে গেলে সে নিজেই ফিতরা গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে যাবে।

অত্রএব সর্বনিম্ন শেণীর ধনী আটা হিসেবে ৭০ টাকা করে ফিতরা দেবেন। তার থেকে কিছু উচু মানের ধনী হলে ‘যব’ হিসেবে ২৭০/- টাকা করে ফিতরা দেবেন। মধ্যমানের ধনী হলে ৩.৩০ কেজি খেজুর হিসেবে ১,৫০০ টাকা করে ফিতরা দেবেন। উচ্চ মানের ধনী হলে ৩.৩০ কেজি কিসমিস হিসেবে ২.২০০ টাকা করে ফিতরা দেবেন। এটাই ফিতরা প্রদানের যথাযথ বিধান।

আল্লাহ সবাইকে বুঝার ও মেনে চলার তাওফিক দিন। আমীন।