যে কারণে হত্যা করা হলো প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুরসীকে — ফিরোজ মাহবুব কামাল

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ২০ ২০১৯, ০৮:১৪

মিশরে এবার ফিরাউনের দিন
অতীতের ফিরাউন যদি মিশরের শাসন ক্ষমতায় আবার ফিরে আসতো তবে ইসলামের বিজয় নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখে তাদের উপর অনিবার্য হতো এক অসহনীয় দুর্দিন। যে ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছিল হযরত মূসা (সাঃ) ও তার ক্‌ওম বনি ইসরাইলের উপর –সেরূপ বিপদের মুখে পড়তে হতো তাদেরও। নির্মম ভাবে তাদের নির্মূল করা হতো এবং বাঁচিয়ে রাখা হতো কেবল নির্যাতনে নির্যাতনে তাদের বাঁকি জীবনকে অতিষ্ট করার লক্ষ্যে। তবে ফিরাউন যেটি করতো সেটি নিখুঁত ভাবে করছে মিশরের স্বৈরাচারি শাসক জেনারেল আব্দুল ফাতাহ আল-সিসি। বরং সে আদিম বর্বরতায় যোগ হয়েছে আধুনিক নৃশংসতা। তার সরকারের হাতেই জেল খানায় নিহত হলো মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্বাচিত সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহম্মদ মুরসী। উল্লেখ্য হলো, সরকারের পক্ষ থেকে সাঁজানো একটি মামলায় বহু আগেই প্রেসিডেন্ট মুরসীকে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে প্রাণদন্ড কার্যকর করতে জেনারেল সিসির সরকার ভয় পাচ্ছিল। ভয় ছিল, প্রাণদন্ড পরিকল্পিত হত্যাকান্ড রূপে চিত্রিত হওয়ার। অবশেষে তাঁকে অন্যপথে বিদায় দেয়া হলো। সেটি হার্ট এ্যাটাকের লেবেল এঁটে দিয়ে।
স্বৈরাচারি শাসকদের হাতে এমন পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বিরল নয়, বরং অতি স্বাভাবিক। শুধু মিশরে নয়, মুসলিম বিশ্বের যেসব দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কাফেরদের হাতে অধিকৃত হয়েছিল তাব সবগুলিতে একই রূপ বীভৎসতা। এ দেশগুলিতে ইসলামে সবচেয়ে নৃশংস দুষমনেরা কোন পতিতা পল্লিতে জন্ম নেয়নি, বরং তারা বেড়ে উঠেছে সামরিক বাহিনীর ছাউনীতে বা সেক্যুলারিস্টদের ঘরে। ইসলামের বিজয় বা গৌরববৃদ্ধি তাদের ধাতে সয় না। এসব দেশের সামরিক বাহিনীর যারা রোল মডেল বা তারকা-চরিত্র তাদের সামরিক জীবন শুরু হয়েছিল দেশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় নয়, বরং সেটি ছিল কাফেরদের শাসনকে মুসলিম দেশে বলবান ও দীর্ঘায়ীত করার লক্ষ্যে। যেমন পাকিস্তানের জেনারেল আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, নিয়াজীর ন্যায় ব্যক্তিগণ। একই উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো অবিভক্ত ভারতের নানাভাষী মুসলিমদের প্যান-ইসলামিক পাকিস্তান প্রজেক্টকে ব্যর্থ করে দেয়ায়। এমন কি তারা বার বার বাধাগ্রস্ত করেছে পাকিস্তানে এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারার শাসন প্রক্রিয়া।

নৃশংস নাশকতাটি সেক্যুলারিস্টদের
মুসলিম দেশে সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টগুলো হলো ইউরোপীয় কাফের সংস্কৃতির অতি সুরক্ষিত দ্বীপ। নিজদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ইসলামী সংস্কৃতির সেখানে প্রবেশাধীকার নাই – বিশেষ করে সেদেশগুলিতে যেগুলি ইউরোপীয় কাফেরদের কলোনী ছিল। এ সেক্যুলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা অফিসারগণ ইসলাম থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে মসজিদ-মাদ্রাসার উপর বোমা ফেলতেও এরা ইতস্ততঃ করে না -যেমনটি হয়েছে ইসলামাবাদের লাল মসজিদ ও হাফসা মাদ্রাসার উপর। এদের প্রাণ কাঁপে না নৃশংস গণহত্যাতেও। সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহজাগতিকতা। অতি ইহজাগতিকতার কারণেই সেক্যুলারিস্টদের মাঝে বিলুপ্ত হয় আখেরাতের ভয়। দেশের প্রতিরক্ষা কি দিবে, তারা বরং ইহজাগতিক সম্ভোগ বাড়াতে দখলে নেয় নিজ দেশের অতি মূল্যবান আবাসিক এলাকাগুলি। একই রোগ পাকিস্তান আর্মির ভগ্নাংশ ও সে অভিন্ন সেক্যুলার সংস্কৃতির ধারক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও।

যে কোন মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গাই কবিরা গুনাহ তথা হারাম। তাতে কুফরি তথা অবাধ্যতা হয় মহান আল্লাহতায়ালার সে অলংঘনীয় কোরাআনী নির্দেশের যাতে বলা হয়েছে তোমরা বিভক্ত হয়ো না। বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরে শেষ হয়নি। বহুশত পরও মুসলিম দেশ ভাঙ্গার ন্যায় হারাম কাজের বিচার ইসলামপ্রেমী মহলে বার বার বসবে। তখন সে বিচার রুখতে সেক্যুলারিস্ট সন্ত্রাসীরা থাকবে না। তবে সবচেয়ে চুড়ান্ত ও ভয়ানক বিচারটি হবে আখেরাতে। মুসলিম দেশের প্রতিইঞ্চি ভূগোল বাড়াতে অতীতে বহুরক্ত ব্যয় হয়েছে। এবং সে মুসলিম ভূগোলকে খন্ডিত করার কাজটি নিজ খরচে করে দিতে রাজী কাফেরগণ। ভারত তাই পাকিস্তান ভেঙ্গে দিতে ১৯৪৭ থেকেই দু’পায়ে খাড়া ছিল। তারা শুধু কলাবোরেটরদের অপেক্ষায় ছিল। সেটি জোটে ১৯৭১’য়ে। সে কাজে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে সামরিক ও অসামরিক অঙ্গণের বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ। তাই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে, ভারতের ন্যায় কাফের দেশের কোলে গিয়ে উঠতে এবং কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধ করতে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মাঝে কোন ইতস্ততা দেখা যায়নি। ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলার সেনাসদস্যগণই ২০১৩ সালের ৬ই মে শাপলা চত্ত্বরে বীরদর্পে হিফাজতে ইসলামের শত শত মুসল্লিদের নিষ্ঠুর ভাবে হ্ত্যা করেছে এবং জানাজা ছাড়াই তাদের লাশ ময়লা ফেলার গাড়িতে তুলে গায়েব করে দিয়েছে। অতীতে এ সেক্যুলার সেনাবাহিনী যেমন অতি বর্বর স্বৈরাশাসকদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বর্তমানে কাজ করছে ভোট-ডাকাত স্বৈরশাসকের বিশ্বস্ত পাহারাদার রূপে।
মুসলিম বিশ্বে সামরিক সরকারগুলির ইসলাম বিরোধী নির্মম নিষ্ঠুরতাগুলি বুঝতে হলে সামরিক বাহিনীর অতি রেডিক্যাল সেক্যুলার আদর্শিক প্রেক্ষাপটকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। ম্যালেরিয়া সবদেশে একই রূপ সিম্পটম নিয়ে হাজির হয়। তেমনি অবস্থা চেতনার রোগেরও। ফলে ইসলামী চেতনা শূণ্য সেক্যুলারিস্টদের চরিত্র সবদেশে একই রূপ নৃশংস হয়। সে গভীর রোগই আজ প্রকট ভাবে পাচ্ছে মিশরে। মিশরের ইতিহাসে অতি কট্টোর ইসলাম বিরোধী সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিল কর্নেল জামাল আব্দুন নাসের। ইনিও বন্দুকের জোরে সিসির ন্যায় মিশরের প্রেসিডেন্ট হন। আর সব সেক্যুলারিস্টদেরই মূল দুষমনিটি ইসলামের বিরুদ্ধে। ইবলিস কোথাও ক্ষমতা হাতে পেলে যা করে -এরাও অবিকল তাই করে। ইসলামের বিরুদ্ধে জামাল আব্দুন নাসেরের দুষমনি এতটাই প্রকট ছিল যে, সাইয়েদ কুতুবের ন্যায় বিশ্ববিখ্যাত মোফাচ্ছের এবং “ফি জালালিল কোর’আন’এর ন্যায় প্রসিদ্ধ তাফসিরের রচিয়েতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছে আব্দুল কাদের আওদাসহ আরো অনেক বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদকে। আব্দুন নাসেরের পথ ধরেছে মিশরের বর্তমান স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আবুল ফাতাহ আল-সিসি। আব্দুন নাসেরের পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া। স্বৈরাচারি সিসিকে সমর্থন দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় শাসকগণ ও ইসরা্‌ইল।

মিশরের সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ এতটাই কট্টোর ইসলামবিরোধী যে ইসলাপন্থিদের সরকারে স্থান দেয়া দূরে থাক, তাদেরকে কোনরূপ মানবিক অধীকার দিতেও রাজী নয়। সেটিই প্রকট ভাবে প্রকাশ পেল ডক্টর মুরসীর হত্যার মধ্য দিয়ে। তাদের কাছে অসহ্য ছিল ডক্টর মুহম্মদ মুরসীর ন্যায় অতি ইসলামী ব্যক্তির নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়া। ফলে তাঁর নির্বচনি বিজয়ের পরই ষড়যন্ত্র শুরু হয় অপসারণের। ক্ষেত্র তৈরী করে থাকে রাজপথে এবং রাজপথের বাইরে। অর্থ বিতরণ হয় রাজপথের বিক্ষোভে লোক বাড়াতে। বিজিনেস সিন্ডকেটকে উসকানো হয় দ্রব্যমূল্য বাড়াতে। তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় মিশরের সেক্যুলার মিডিয়াকে। সে কাজে বিপুল অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসে মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্রের ঘোরতর শত্রু সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলির সরকারগুলিকে প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্রিয় হয় ইসরাইল। কারণ, মুরসী একাত্মতা ঘোষণা করেন গাজার অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনীদের সাথে। ইসরাইলের কাছে সেটি ছিল অসহ্য।

নিরস্ত্র প্রতিবাদ এবং পবিত্র জিহাদ যেখানে সন্ত্রাস
ইসলামের শত্রুপক্ষ সন্ত্রাসের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তাদের মিত্র পক্ষ সন্ত্রাসের যে সংজ্ঞা দিয়েছে সেটিই গ্রহণ করেছে মুসলিম দেশগুলির সেক্যুলারিস্টগণ। সে সংজ্ঞা মতে ইসলামের বিজয় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠার লক্ষে খাড়া হওয়াটিই সন্ত্রাস। সন্ত্রাস রূপে চিত্রিত হয় মার্কিনী বা ইসরাইলী অধিকৃতির বিরুদ্ধে কথা বলা। এমন কি সন্ত্রাস হলো মিশরের সিসি, বাংলাদেশের হাসিনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজাদের ফ্যাসিবাদী অধিকৃতির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের কথা বলাও। সে বিকৃত সংজ্ঞার প্রয়োগ হয়েছে প্রেসিডেন্ট মুরসী এবং তার দল ইখওয়ানুল মুসলিমের বিরুদ্ধে।
গাজা বা অধিকৃত ফিলিস্তিনের যে কোন অংশকে উম্মুক্ত জেলখানার চেয়ে অধীক মর্যাদা দিতে ইসরাইল ও তার মনিব মার্কিন যুক্তরাষ্ট কখনোই রাজী নয়। সে অবস্থা পরিবর্তনের যে কোন উদ্যোগই চিহ্নিত হয় সন্ত্রাস রূপে। প্রেসিডেন্ট মুরসীর আগে গাজাকে উম্মুক্ত জেল খানায় পরিণত করার কাজে ইসরাইলকে পূর্ণ সহায়তা দিয়েছে মিশরের হোসনী মোবারকের স্বৈরাচারি সরকার। ইসরাইলের এজেন্ডা পূরণে গাজার দক্ষিণ সীমান্ত পাহারা দিত মিশরের সেনাবাহিনী। ইসরাইলের পক্ষ থেকে আরোপিত বিধানটি ছিল, মরতে হলে জেলখানার মধ্যেই মরতে হবে; পালানোর রাস্তা দেয়া যাবে না। তেমনি এক করুণ অবস্থা ছিল গাজাবাসীর। তাই গাজার উপর অতীতে যখন অবিরাম বোমা বর্ষণ হয়েছে তখন আহত গাজাবাসীদেরও মিশরীয় সেনাবাহিনী মিশরে ঢুকতে দেয়নি। এরূপ কঠোর পাহারাদারি কাজে হোসনী মোবারকের সরকার অর্থ পেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কিন্তু মুহম্মদ মুরসীর প্রেসিডেন্ট হওয়াতে চিত্রই পাল্টে যায়। তিনি খুলে দেন মিশরের সাথে গাজার সীমান্ত। মিশরের এমন স্বাধীন নীতি ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল অতি অসহ্য। ইসরাইল এটিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মনে করে। ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়াটিই বড় কথা নয়, নির্বাচিত হলেও সন্ত্রাসী রূপে গণ্য হতে হয় যদি অবস্থান তাদের স্বার্থের পক্ষে না হয়। তাদের বিচারে সন্ত্রাসী হওয়ার জন্য অস্ত্র হাতে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না, ইসলাম ও ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলাই যথেষ্ট। ইখওয়ানুল মুসলিমুন এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন রূপে গণ্য হয়। সন্ত্রাসী গণ্য হয়েছে খোদ প্রেসিডেন্ট মুরসী। ফলে জেনারেল সিসি যখন মিশরের ইতিহাসের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসীকে সামরিক শক্তির জোরে সরিয়ে দেয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রগণ সেটিকে সমর্থণ করে। এবং তাতে উল্লাস জাহির করে ইসরাইল।
সিসির সে অবৈধ ও অন্যায় সামরিক ক্যু’র বিরুদ্ধে রাজপথে অবস্থান নিয়েছিল মিশরের লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু সামরিক সরকারের কাছে নিরস্ত্র মানুষের শান্তিপূর্ণ সে বিক্ষোভও সহ্য হয়নি –যেমন হাসিনার কাছে সহ্য হয়নি শাপলা চত্ত্বরে মুসল্লীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান। বিক্ষোভ থামাতে সামরিক বাহিনী রক্তাত্ব করেছিল মিশরের রাজপথ। ২০১৩ সালে ১৪ই আগষ্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া স্কোয়ারে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার নিরস্ত্র নারীপুরুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে মেশিন গান ও কামান দেগে হত্যা করেছিল জেনারেল আবুল ফাতাহ সিসির সামরিক সরকার। এতবড় গণহত্যায় সাথে জড়িতদের কারোই কোন বিচার হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের মহলেও সে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিন্দিত হয়নি। যেন ইসলামপন্থি হলে তাদেরকে হত্যা করা কোন অপরাধই নয়। ফলে যে নৃশংস দমন প্রক্রিয়া ও হত্যাকান্ড চলছে সৌদি আরব, সিরিয়া ও আরব আমিরাতে, অবিকল সেটিই চলছে মিশরে।

অসহনীয় হলো ইসলামপন্থিদের বেঁচে থাকাটি
কারারুদ্ধ প্রেসিডেন্ট মুরসিকে হত্যা করায় শুধু মিশরের ইসলাম বিরোধী সেক্যুলার স্বৈরাচারি চক্রই খুশি হয়নি, খুশি হয়েছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের শাসক মহলও। খুশি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের ন্যায় পাশ্চত্য দেশগুলোর সরকারগুলিও। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে এ কথা ভেবে, শত্রু বিদায় হলো। প্রেসিডেন্ট মুরসী ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জাগরণের আদি সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমের নেতা। যুদ্ধাংদেহী কাফের দেশগুলির কোনটিই চায়না কোন দেশে কোন ইসলামী সংগঠন ক্ষমতায় বসুক –তা যত সংখ্যাগরিষ্ট ভোটেই হোক। এমন কি জেলের মধ্যে তাদের বেঁচে থাকাটিও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। জেনারেল আবুল ফাতাহ আল সিসি, শেখ হাসিনা, কিং সালমানের ন্যায় প্রচণ্ড স্বৈরাচারি ফ্যাসিষ্টদের শাসনকে তারা সমর্থন দিতে রাজী, কিন্তু কোন ইসলামী দলের গণতান্ত্রিক বিজয়কে নয়। তাই নব্বইয়ের দশকে আলজিরিয়ায় ইসলামপন্থিদের বিজয় রুখতে তারা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাদখলকে সমর্থন দিয়েছে। এবং তারা মেনে নেয়নি ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাসের বিশাল নির্বাচনি বিজয়কে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইসলামপন্থিদের বিজয় দূরে থাক করারুদ্ধ অবস্থায় তাদের বেঁচে থাকাও যে তারা মেনে নিতে রাজী নয় –প্রেসিডেন্ট মুরসীর অপসারন এবং বন্দী অবস্থায় তার হত্যা সেটিই নতুন করে প্রমাণ করলো।
আরব বিশ্বে স্বৈরাচারি জালেম শাসকদের মূল সাহায্যদাতা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংলান্ড, জার্মান মত পাশ্চত্য দেশগুলি। এরাই মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের মূল শত্রু। তারা জানে স্বৈরাচারি শাসন বিলুপ্ত হলে রাজৈনতিক ক্ষমতা যাবে ইসলামপন্থিদের হাতে। তাতে বিশ্বব্যাপী উত্থান হবে ইসলামের। পাশ্চাত্য সেটি হতে দিতে রাজী নয়। আরব বিশ্বকে ২০ টুকরোর অধীক খণ্ডে বিভক্ত করেছে সে উত্থানকে রুখতে। ইসলামের উত্থান রুখার লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের কাফের শক্তিবর্গের নির্ভরযোগ্য সাহায্যকারি হলো এসব স্বৈরাচারি শাসকগণ। তাদের প্রতিশ্রুতি পেয়েই স্বৈরাচারি শাসকগণ অতি নৃশংস হত্যাকান্ড করতেও পিছপা হয়না। এদের হাতেই নিহত হতে হলো সৌদি আরবের প্রখ্যাত লেখক ও কলামিস্ট জামাল খাসোগীকে। তাঁর দেহকে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে অ্যাসিডে গুলিয়ে ড্রেনে মধ্যে গায়েব করা হয়েছিল। তাঁর অপরাধ, তিনি ছিলেন সৌদি সরকারের সমলোচক। তাঁর সে হত্যাকান্ড মার্কিনী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছে অপরাধ গণ্য হয়নি। বরং ইসলামের উত্থান রুখতে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডে দক্ষতা ও নৃশংসতা দেখাতে পারলে ইসলামের এ আন্তর্জাতিক শত্রুপক্ষ প্রয়োজনীয় অস্ত্র এবং অর্থ দিতেও রাজী। তারই নমুনা, ইয়েমেনে সেরূপ এক নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে বিপুল অস্ত্র পাচ্ছে সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক মহলে সে নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোরও উপায় নেই। তাদের অধিকৃতি সেসব মহলেও। মিশর থেকে ইসলামপন্থিদের নির্মূলে জেনারেল আল-সিসির সরকার যেরূপ লাগামহীন যুদ্ধে নেমেছে তাতেও তারা সর্বপ্রকার সাহায্য দিচ্ছে। এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গলা টিপে হত্যায় হাত বাড়িয়েছে লিবিয়া এবং সুদানে। সে কাজে তাকে সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ গণতন্ত্রবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্র। বস্তুতঃ প্রেসিডেন্ট মুরসী হত্যাকান্ডটি স্রেফ কোন ব্যক্তি বিশেষের হত্যা নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র হত্যার একটি সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য মুসলিম বিশ্বে ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করা। তাই এর সাথে শুধু জেনারেল সিসির সরকার জড়িত নয়, জড়িত তার আন্তর্জাতিক মিত্রগণও।