মুসলিম দেশের গণমাধ্যম কীভাবে শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করে!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ০৪ ২০২০, ০০:৪৪

ব্যাপক অভিযোগ এটাই যে, ধর্মপ্রাণ মানুষের ইস্যুতে তারা যে কোনো পরিবেশনায় ইচ্ছাকৃত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে থাকে। কোনো ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তবুও দেখা যায় ঘটনাটি মন্দ হলে আর তার সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনসংখ্যার কোনো সম্পর্ক থাকলে সেটিকে ফলাও প্রচার দেওয়া হয়। বার বার ফলোআপ করা হয়। বিশাল-ব্যাপক ইস্যুতে পরিণত করা হয়। তর্ক-বিষোদ্গার, ঘৃণা এবং নেতিবাচক দাবি-দাওয়া পর্যন্ত গড়িয়ে তবে বিষয়টি সমাপ্ত করা হয়।

অপরদিকে ঘটনাটি ভালো ও কল্যাণকর হলে আর সেটি কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাজ হলে অতি ছোট্ট একটি ‘খবর’ দিয়েই সেরে ফেলা হয় দায়িত্ব। পক্ষান্তরে ঘটনার সঙ্গে ইসলামবিরোধী মহলের সম্পর্ক থাকলে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের যোগসূত্র পাওয়া গেলে কিংবা রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক পর্যায়ে ইসলামী বিধি-বিধানের উল্টোস্রোতের ব্যক্তিদের সম্বন্ধ থাকলে এরাই খবরের ট্রিটমেন্ট (পরিবেশনার ধরণ) সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। বড় করার মতো খবরটিকে ছোট করে ছাড়ে আর ছোট হওয়ার মতো খবরকে পাঁচ-সাত কলামে মাতিয়ে তুলে।

এখানে হয়তো স্পষ্ট ‘সত্য-মিথ্যার’ কোনো ব্যাপার থাকে না। কিন্তু ‘আকাশ-পাতালের’ ব্যাপার থাকে। ‘তিলকে তাল’ বানানো আর ‘তালকে তিল’ করে দেখানোর কসরতটা একদম প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। আর এভাবেই ভারসাম্যহীনতার একটি দুধারা চাবুক দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মানুষ ও মানসের বোধ ও স্বার্থকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়ে থাকে। গত দুই যুগে এই দেশে এ ব্যাপারটিই বিপুলভাবে ঘটেছে। কেবল সত্য কিংবা মিথ্যা নয়, সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণেও একটি ‘মিশ্রমত’ গড়ে তোলার কাজটি করেছে প্রবাভশালী গণমাধ্যম। যে কারণে গণমাধ্যমের ন্যায়ানুগ ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যে কারণে গণমাধ্যমের প্রতি অবিচারের অভিযোগ কোটি কোটি হৃদয়ে জেগে ওঠেছে। ইসলামী শিক্ষা, অনুশাসন ও আদর্শ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা প্রশ্ন উঠানো হলেও দেখা যায়, অন্য কোনো কোনো ধর্ম-গোত্র ও মহলের কুসংস্কার ও প্রকাশ্য দুরাচারের প্রতিও সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে থাকছে একশ্রেণীর গণমাধ্যম। এ জন্যই অবিচার ও ন্যায়হীনতার অনুযোগ-অভিযোগের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছে চারদিকে।

খবর ছোট-বড় করা ছাড়া গণমাধ্যমের অবিচারের আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে পরবর্তী দিনগুলোতে খবরটির ফলোআপ (আরো জের) প্রকাশ বা সম্প্রচার করা বা না-করা। এক্ষেত্রেও ‘তিলকে তাল’ বা ‘তালকে তিল’ বানানোর ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকে। এটিও দায়িত্বের দিক থেকে কোনো গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় জুলুম। এর বাইরে আরেকটি বিষয় যেটি ঘটে, সেটি হচ্ছে সম্পাদকীয় মতামতের ক্ষেত্রে, কলামধর্মী লেখায় এবং বিভিন্ন ফিচার ও অনুষ্ঠানে ওই বিষয়টিকেই টেনে নিয়ে আসা বা না-আসার একটি ‘গেম’ তৈরি করা। একটি ছোট্ট বিতর্কমূলক ঘটনা, (ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মাঝের) যেটি একদিনই ঘটেছে, সেটির প্রচার-বিশ্লেষণে মাসখানেক বরাদ্দ করা এবং পরিবেশ বিষিয়ে তোলা। গণমাধ্যমের এরকম আচরণের নজির বহু।

সে হিসেবে শুধু খবর (নিউজ) মাত্র নয়, প্রভাবশালী গণমাধ্যম তার মতামতধর্মী আয়োজনেও এক ধরনের অবিচারমূলক ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ চালিয়ে যাচ্ছে। এ যেন ‘মুসলিম-বৈরি’ গণমাধ্যম-চর্চার এক উন্মাদ মহড়া। এবং সেটি ঘটছে এ-দেশেই। নিজ দেশের বিনিয়োগ। নিজ দেশের সংবাদকর্মী। কিন্তু সুর উল্টোজনের। কথা ও ভাষা, দাবি ও শ্লোগান বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার। সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে। মুসলিম ধর্মাচার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, গ্যাস-বিদ্যুৎ, বন্দর এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আরাধনা-উৎসবে এদের ভূমিকা দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ বিষয়গুলো এখন অনেকটাই ওপেনসিক্রেট। জানে এবং বুঝে সবাই। বলতে চায় না। গণমাধ্যমের সংঘবদ্ধ কোরাসের ভয় সবার মধ্যেই কাজ করে।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, কৌশলী মিথ্যাচার। এটাও যে একদম ঘটে না, এমন নয়। শব্দের প্রয়োগে, তথ্যের মিশেলে এই অসত্যাচার প্রায়ই তৈরি করা হয়। খবরের সঙ্গে মতামত মিশিয়ে নির্দোষ বিষয়কেও জটিল অপরাধ কিংবা গ্লানি হিসেবে উপস্থিত করা হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ঢালাওকরন করা। যে কোনো নেতিবাচক বিষয় নিয়েই ইসলামপ্রিয় সব মানুষকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত ও অপরাধী সাব্যস্ত করার মহড়া শুরু করে দেওয়া হয়। এটিও মারাত্মক অন্যায়। এসব বিষয়ের ভেতর-বাইর প্রায় সময়ই দেশের সচেতন মানুষ পুরোটা অনুভব করেন। এবং বেদনাও বোধ করেন। কিন্তু কলম ও ক্ষেত্র হাতে না থাকায় কিছু করে দেখাতে পারেন না।

কেউ কেউ বলেন, মুসলিম বিরোধী আন্তর্জাতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রচার ও গণমাধ্যমের ভাষা এক সময় এরকম বৈপরিত্বপূর্ণ ছিল। এখন সেটিরই দেশীয়করণ করা হয়েছে। এ অর্থে মন-মগজ ও স্বার্থে পশ্চিমানুরক্ততা তৈরি হওয়ায় এদেশের গণমাধ্যমে স্বজাতি ও স্বধর্ম-বিরোধিতার এক স্বনিয়োজিত অধ্যায় চলছে বলা যায়। এতে নাকি এদেশের সংবাদকর্মীদের একটি ‘অবসরপ্রাপ্ত’ কম্যুনিস্ট ও সেক্যুলার অংশের মন ও পেশার মান রক্ষা হচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, পাশের দেশের সাংস্কৃতিক চেতনা ও গোয়েন্দাস্বার্থও এজাতীয় প্রবণতাকে উস্কে দিচ্ছে। প্রবল সাম্প্রদায়িক ও খুনে একটি শক্তির হাতে পাশের বড় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশের রাজত্ব। সে ‘রাজত্ব’ নিয়ে কোনো মোসাহেবী ‘নিন্দা’ করার সাহসও করে না এদেশের গণমাধ্যম। কিন্তু তারাই আবার এদেশের নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলিমের বোধ-জীবনাচার ও শিক্ষা নিয়ে বিষোদ্গারের বন্যা ছুটিয়ে দেয়।

এরা একই ইস্যুতে মুসলিমদের গালি দেয়। কিন্তু হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের পিঠে হাত রেখে পিঠচাপড়ানি দেয়। এরা সাম্প্রদায়িকতার কথা কাদের বিরুদ্ধে বলে? যারা উপমহাদেশজুড়ে অপর ধর্মীয়দের সাম্প্রদায়িক আক্রমনে প্রায়ই ‘নিহত’ হচ্ছেন। এরা ‘কুসংস্কার’ নিয়ে মুসলিম জীবনাচারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। কিন্তু ভিন্ন ধর্মীয় অমানবিক কুসংস্কারকেও মানবিক ও সাংস্কৃতিক একটি আবহ দিয়ে প্রচার করে। এটি গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে কোনো সুবিচারের নমুনা হতে পারে না। এবং এই অবিচার এখন আর উপেক্ষাযোগ্যও নয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে কথা! ব্যাপক প্রভাবক এই রাষ্ট্রীয় স্তম্ভের অবিচার ও ন্যায়-বিরুদ্ধতা এখন এদেশের সভ্যতা ও ইতিহাসকেই যেন ঘুরিয়ে দিতে শুরু করেছে।

[‘গণমাধ্যম না গোত্রমাধ্যম’
২০১৫’ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে]