মুক্তিসংগ্রামে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগান্তকারী নির্দেশনা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৬ ২০২১, ১৬:৪৪

মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া


১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয় দলীয় নেতা ও কর্মীদের প্রতি। এদিনই পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দলীয় প্যাডে নির্দেশনাটি পৌঁছে দেওয়া হয় জেলায় জেলায়। ৩, মাওলানা শওকত আলী রোড, ঢাকা-১ এর অফিস থেকে জারি করা হয় নির্দেশনাটি। পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমীর স্বহস্তে লিখিত ও স্বাক্ষরিত এ নির্দেশনাপত্র ছিল নিম্নরূপ।

জনাব,
বাদ সালাম আরজ এই যে, দেশের বর্তমান অবস্থায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভূমিকা সুস্পষ্ট। দেশের এই অঞ্চলের স্বাধীকার আদায়ের ব্যাপারে আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছি এবং শেষ পর্যন্ত চালাইয়া যাইব। তবে স্বাধীকার আদায় না হওয়ার নিশ্চয়তা পাইলে হয়তো আমরা চরমপন্থা অবলম্বন করিতে পারি। তবে দেশের যে অবস্থা, এ অবস্থায় আমরা নিরব বসিয়া থাকিতে পারি না। এইহেতু আশা করি নিম্নবর্ণিত কর্মসূচি বাস্তবায়িত করিবেন।
শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের সহিত নিজেদের বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখিয়া সহযোগিতা করিয়া যাইবেন।
নিজেদের আত্মরক্ষা ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য মাদ্রাসার ছাত্র ও স্ব স্ব এলাকার যুবকদেরকে মোজাহিদে আনসারুল ইসলামে ভর্তি করিয়া ট্রেনিং দিবার ব্যবস্থা করিবেন। এই ট্রেনিং যতটুকু পারেন তাড়াতাড়ি আরম্ভ করিবেন।
জমিয়তের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ করিতে থাকেন এবং যেই এলাকায় কমপক্ষে ২০ জন সদস্য সংগৃহীত হয় তথায় শাখা জমিয়ত গঠন করিয়া দেন।
নোটঃ এই প্রোগ্রামটি আপনার অধীনস্থ সকল শাখকে জানাইয়া বাস্তবায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাইয়া যান। পরিস্থিতি বুঝিয়া মুরব্বিদের সাথে পরামর্শ করিয়া পরে অন্য কর্মসূচি দেওয়া হইবে‌।
নিবেদক
শামসুদ্দিন কাছেমী

নির্দেশনার মানে পরিষ্কার। মোজাহিদে আনসারুল ইসলাম নামক বাহিনী আগেই তৈরি হয়েছিল। স্বাধিকার আদায়ে নিবেদিত জমিয়ত প্রস্তুত ছিল চরমপন্থা অবলম্বনে। যারা ইশারা ১৯৭০ এর পহেলা ফেব্রুয়ারীতে দিয়ে রাখা হয়‌। মোজাহিদে আনসারুল ইসলাম যে শুধু নামমাত্র কোন সংগঠন ছিল না, তার প্রমাণ ট্রেনিংয়ের নির্দেশনা। নিজেদের তথা বাঙ্গালীদের আত্মরক্ষা তখন জরুরী প্রসঙ্গ। যদিও হানাদাররা হামলা করেনি ২৪ তারিখে, কিন্তু হামলা মোকাবেলায় জমিয়তের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রক্ষার কথা। রাষ্ট্র তখনো পাকিস্তান। তখনো স্বাধীনতা ঘোষণা হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে এমন একটা নির্দেশনার ভাষায় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হয়েছিল। কোন অনুলিপি সরকারি লোকদের হাতে পড়লে কি ভয়াবহ অবস্থা হতো, ভাবাই কঠিন। অতএ ‘নিজেদের রক্ষা এবং দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য’ কথাটা ছিলো একটি আশ্রয়, যার ব্যাখ্যার অবকাশ আছে আইনের কাছে।
কিন্তু এর ভিতরে নিহিত ছিল আরেকটি প্রবল সত্য। সেটা হল পাকিস্তানের ও তার দোসরদের প্রচারের মোকাবেলা। তারা বলেছিল, তারাই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের রক্ষাকারী। মুক্তিসংগ্রামীরা বরং ধর্মদ্রোহী। জমিয়ত শুরু থেকে এ প্রোপাগণ্ডার বিরোধিতা করে আসছিল। এবং এতে জয়ী হয়েছিল। তার লড়াই আসলে শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। সেই রণাঙ্গন মূলত ছিল ধর্মীয় জায়গা থেকে পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডার মোকাবেলা‌। মুক্তিসংগ্রামকে ইসলামের জায়গা থেকে ন্যায্য ও যথার্থ হিসেবে গণস্তরে হাজির করা। যাতে মুসলিম প্রধান এই জনগোষ্ঠী আপন ধর্ম ও বিশ্বাসের দিক থেকে পাকিস্তানি অপপ্রচারের শিকার না হন। কারণ তারা ধর্মকে ব্যবহার করছিল কৌশল হিসেবে।

জমিয়তও কথা বলছিল ধর্মের জায়গায় দাঁড়িয়ে। এ নির্দেশনায় দেখা যাচ্ছে, দলটি স্বাধীনতা চায় এবং অস্ত্রহাতে ট্রেনিংয়ের বাহিনী তৈরি করেছে। মাদ্রাসার ছাত্র এবং যুবকদের ব্যাপকভাবে সেই বাহিনীতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্দেশনা দিচ্ছে। এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের কারণ হিসেবে নিজেদের আত্মরক্ষার পাশাপাশি বলছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার কথাও। অবশ্যই জনগণ নিজেকে, নিজেদেরকে ভালোবাসে এবং এরপর ভালোবাসে আপনাপন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে। তাঁরা অবশ্যই সাড়া দিয়ে থাকবে বিপুলভাবে।

মোজাহিদে আনসারুল ইসলামের কাজ সামরিকতা আর জমিয়ত নেতা কর্মীদের কাজ শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে সহযোগিতা। আর আনসারুল ইসলামের লোকদের ভর্তি করানো। ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। যদি সশস্ত্র শাখা খোলা হলো, তাহলে আর। জমিয়ত শান্তিপূর্ণ থাকলো কিভাবে? এটাই ছিল রাজনীতি। গোপন সামরিকতাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রকাশ্য রাজনীতির এই প্রশস্ত ও অনুমোদিত জায়গা ধরে রাখা খুবই জরুরী ছিল। সেখান থেকে জমিয়ত নিজের সকল সদস্যকে নির্দেশ দিচ্ছে, নিজেদের বৈশিষ্ট্য তথা ইসলামী চরিত্র অক্ষুন্ন রেখে স্বাধীকার সংগ্রামকে সহায়তা করে যাওয়ার জন্য। এবং নিজেদের দলে ব্যাপকভাবে লোকদের সদস্য বানানোর জন্য। যেখানে ২০ জন সদস্য হওয়া যাবে, একটি কমিটি গড়ে নেয়া হবে। যারা গোপনে মোজাহিদে আনসারুল ইসলামের সাথে কাজ করবে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীকার সংগ্রামকে সাহায্য করে চলবে।
(মুক্তিযুদ্ধ ও জমিয়তঃ জ্যোতির্ময় অধ্যায়)