মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা জরুরি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ২৮ ২০২০, ১৫:৫৫

•এহসান বিন মুজাহির•

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছে এবং সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। সময়োপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশে বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের আনুমানিক পরিসংখ্যান ৬৫ হাজার। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশিও হতে পারে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, দেশে অর্ধ লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করছে দেড় কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী। সেই সাথে নিজ উদ্যোগে ত্রিশ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে আবার ১ কোটিরও বেশি শিশু-কিশোররা শিক্ষার আওতায় এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মাত্র ৬১৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (কেজি স্কুল) সরকারি নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ অধিদফতর দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে শুমারি করেছিল, সে অনুযায়ী সারা দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩১৮। অন্যদিকে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ (বিকপ) বলছে, এমন স্কুল আছে প্রায় ৬৫ হাজার। ১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ২০১১ সালে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হয়। তবে সরকার এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকসহ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে আসছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-ফাইভ, ট্যালেন্টপুল বৃত্তিসহ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে মেধাবী, কর্মঠ ও আত্মবিশ্বাসী শিক্ষকদের নিয়েস্বল্প বেতনে পাঠদান অব্যাহত রেখে চলেছে। শিক্ষা সেক্টরে কিন্ডারগার্টেনগুলো স্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। এসব স্কুলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে এবং সরকারের নির্দেশ মতো পরিচালিত।

করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী গত ১৭ মাচ থেকেদেশের অর্ধলক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ রয়েছে। করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে ‘লকডাউন’ চলছে। অফিস, আদালত, সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুর ছুটির মেয়াদ তৃতীয় বারের মতো বৃদ্ধি করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরও দীর্ঘ মেয়াদী ছুটির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সোমবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীরা বাসায় বসেই পড়াশোনা করতে পারবে। তাদের সিলেবাস হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট করে দিবে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর কি হবে? সরকার নিবন্ধিত স্কুল কলেজ, মাদরাসাগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও যথাসময় তারা বেতন-ভাতা পাবেন। কিন্তু অর্ধলক্ষাধিক কিন্ডারগার্টের স্কুলগুলোর সাথে যারা জড়িত তাদের বেতন কে পরিশোধ করবে? এসব প্রতিষ্ঠান এর আয়ের একমাত্র উৎস হলো শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক ফি বন্ধ। এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো, বিশেষ করে শহরের যেসব স্কুলের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, ভাড়া বাসা-বাড়িতে চলে সেসব স্কুল এতদিন ঠিকবে কিভাবে? একদিকে নিজেদের বেতনের উৎস বন্ধ, অপরদিকে ভাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছেন প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল/পরিচালকরা। এই অবস্থায় প্রতষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত ৩০ লাখ শিক্ষক এবং কর্মচারির অবস্থা কি হতে পারে তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না!

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো অর্থনৈতিক মহাসংকটে পড়েছে বাংলাদেশের অর্ধলক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ৯৯ শতাংশ ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোর মাসিক সম্পূর্ণ আয়ের ৪০ শতাংশ ঘর ভাড়া, ৪০ শতাংশ সম্মানিত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন ভাতা, বাকি ২০ শতাংশ বা তারও বেশি গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ভর্তুকি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের আয়ের একমাত্র উৎস মাসিক ফি আদায় করা সম্ভব হয়নি। যার দরুণ অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষকদের মাসিক বেতন পরিশোধ করা হয়নি। স্কুল বন্ধ থাকলেও স্কুল ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই বিশাল ব্যয়ভার কিভাবে বহন করবো স্কুল কর্তৃপক্ষ? যেখানে কোনও বাণিজ্যিক ব্যাংক কিন্ডারগার্টের স্কুলগুলোকে লোন পর্যন্ত দেয় না।

১৭ মার্চ স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে এসব স্কুলের শিক্ষকরা না পাচ্ছেন স্কুল থেকে বেতন, না পারছেন পারছেন প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং করাতে। টিউশনি করাতে পারলে হয়তো এখান থেকে কিছুই সম্মানি পেতেন তারা। কিন্তু এটাও বন্ধ! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৩০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারি পরিবার-পরিজন নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা আজ বর্ণনাতীত উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত অবস্থায় দিন অতিবাহিত করছেন। এই দুর্দিনে সঙ্কটে পড়া কেজি স্কুলগুলোর শিক্ষককের পাশে কেউ নেই! কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কল্যাণে গঠিত অর্ধশত সংগঠন থাকলেও এসময় তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশে কিন্ডার গার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন সমিতি, বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক সমিতি, ন্যাশনাল কিন্ডারগার্টেন ফোরাম, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন সমিতি ফেডারেশন, টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন আসোসিয়েশন, কিন্ডারগার্টেন এডুকেশন এসোসিয়েশন, প্রাইভেট স্কুল এসোসিয়েশনসহ প্রায় অর্ধশত সংগঠন রয়েছে। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে কিন্ডারগার্টেন সংগঠনের সংখ্যাও অনেক। বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর দুর্দিন চলছে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং শিক্ষকদের সঙ্কট নিরসনে এসব সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ৩/৪টি সংগঠন পৃথক পৃথকভাবে বিবৃতি, প্রেসরিলিজ, স্মারকলিপিসসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে তৎপর হলে কী লাভ হবে? কঠিন দুর্দিনে কিন্ডারগার্টেন সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ এক হওয়া জরুরি? অর্ধলক্ষ স্কুল টিকিয়ে রাখতে এবং ৩০ লাখ শিক্ষক কর্মচারির আর্থিক সঙ্কট নিরসনে সরকারের সহায়তা ছাড়া বিকল্প নেই।

করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা ইতোমধ্যে মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ঘোষিত প্রণোদনার প্যাকেজে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৩০ লাখ শিক্ষক কর্মচারির জন্য কোনো সুখবর নেই। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা দিয়ে সেই টাকা যদি শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের পিছনে ব্যয় করা হয়, তাহলে মানুষ গড়ার কারিগর এসব শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ কি হবে? আর শিক্ষকরা যদি নিঃস্ব হয়ে যান, স্বল্পপুজির এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎই বা কী হবে? সম্মানিত এসব মানুষ না পারছেন কারো কাছে হাত পাততে, না পারছেন খেয়ে পরে বাঁচতে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই ভাবতে হবে। সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার সাথে জড়িত এসব মানুষ গড়ার কারিগরদের খেয়ে পরে বাঁচার জন্য বিনাশর্তে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার