ভোলার রাজনীতি : আওয়ামী লীগ বনাম বিজেপি, পার্থ বনাম শান্ত

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

নভেম্বর ১০ ২০১৮, ০৭:০৪

আবুল কাসেম আদিল: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকী দুই ভাইয়ের মধ্যে যেভাবে রাজনৈতিক বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে, ভোলায় ইদানীং মরহুম নাজিউর রহমান মঞ্জুরের সন্তানদের মধ্যে এমন ব্যাপার ঘটছে। যা দিনদিন আরো স্পষ্ট হবে। নাজিউর রহমানের বড় ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ, মেজ ছেলে আশিকুর রহমান শান্ত। দুজনেরই রাজনীতি তাদের পিতার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) দিয়ে শুরু হলেও শেষমেশ দুজন দুই রাস্তার পথিক হয়েছেন। একজন বিজেপি, আরেকজন আওয়ামী লীগ।

মূলত দলগতভাবে ভোলায় বিজেপির তেমন কোনো অবস্থান নেই। তবে ভোলায় ব্যক্তিগতভাবে নাজিউর রহমান মঞ্জুরের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। জনশ্রুতি আছে, এরশাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ এই নেতা জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালীন ভোলায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তাছাড়া দানশীল ও উদার হিসেবেও তার প্রসিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাকি বিএনপির সঙ্গে, কার সঙ্গে জোট করবে জাতীয় পার্টি— এই বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে দল ছাড়েন নাজিউর রহমান মঞ্জুর। এরপর গঠন করেন বিজেপি। বিজেপিকে নিয়ে তিনি যুক্ত হন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে। এক-এগারোর আগে জোটগতভাবে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নও পান। কিন্তু নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেন নি। ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বিজেপির চেয়ারম্যান মনোনীত হন তাঁর বড় ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ। পার্থ পিতার আসন থেকে ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোয়ারের মধ্যেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। সন্দেহ নেই, বিএনপির ভোট ও নাজিউর রহমানের ব্যক্তিগত ভোট পার্থের জয়ে ভূমিকা রাখে।

আন্দালিভ রহমান পার্থের রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে মজার একটা বিষয় আছে। পার্থ বিএনপি সরকারের মাঝামাঝি সময়ে ভোলার রাজনীতিতে সরব হন। কিন্তু তিনি পিতার দল বিজেপির হয়ে নয়, সরাসরি বিএনপির রাজনীতি দিয়ে শুরু করেন। তিনি ভোলা-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে পোস্টারে পোস্টারে পুরো ভোলা ছেয়ে ফেলেন। নিজেকে পরিচয় দেন তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে। সেসময় তারেক রহমানের সঙ্গে তার ছবি সম্বলিত পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে শোভা পায়। তিনি বিজেপির রাজনীতি দিয়ে শুরু না করে বিএনপি দিয়ে শুরু করার করার কারণ হলো, বিজেপির জন্য চারদলীয় জোট থেকে একটা আসনই বরাদ্দ ছিল, ভোলা-১। সেখানে পার্থের পিতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর নির্বাচন করবেন। সেজন্য পার্থের জন্য সরাসরি বিএনপি থেকে চেষ্টা করাই ভালো ছিল। ভোলা-৪ আসনে চেষ্টা করার কারণ হলো, ভোলা-২ ও ভোলা-৩ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী ছিল। ২-এ তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বড় ভাই হাফিজ ইব্রাহীম; ৩-এ বিএনপি থেকে বারবার নির্বাচিত এমপি, তৎকালীন মন্ত্রী মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। অন্যদিকে ভোলা-৪ থেকে তুলনামূলক দুর্বল, ওই আসনের বাসিন্দা নন এমন একজন এমপি ছিলেন— নাজিমউদ্দিন আলম। পার্থ বিএনপির দুর্বল জায়গায় হানা দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক-এগারোর আগে পার্থ আর বিএনপির মনোনয়ন পান নি। ভোলা-৪ আসনে সাবেক ছাত্রনেতা নাজিমউদ্দিন আলমই মনোনয়ন পান। বলা যায়, পার্থ শুরুটা বিএনপি দিয়ে করতে চেষ্টা করেন। করা আর হয়ে ওঠে না। শুরু করেন বিজেপি দিয়ে।

এরপর আসে এক-এগারো। এক-এগারো তছনছ করে দেয় বিএনপিকে। ভোলার বিএনপিতেও এর প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে নাজিউর রহমান মঞ্জুরও মারা যান। তরুণ রাজনীতিক আন্দালিব রহমান পার্থ পিতার মৃত্যু ও বিএনপির দুর্বলতা — দুয়ের ফায়দাই আদায় করেন। পিতার মৃত্যুর কারণে শূন্য হওয়া দলের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। যিনি পিতার মৃত্যুর একদিন আগেও বিজেপির সাধারণ সদস্যও ছিলেন না, তিনি দলের চেয়ারম্যান হয়ে যান। পিতার জন্য বরাদ্দকৃত ভোলা-১ আসনে নিজে প্রার্থী হন। ভোলা-২ আসনের জননন্দিত বিএনপিনেতা হাফিজ ইবরাহীম কারাগারে থাকায় সেই আসনে জোট থেকে ছোটভাই আশিকুর রহমান শান্তকে মনোনয়ন আদায় করে দেন। সেই নির্বাচনে মাত্র পঁচিশ বছরের যুবক শান্ত আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছে অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে হারেন। মূলত তোফায়েল আহমেদ ভোলা-১ আসনের ভোটার। ভোলায় জনশ্রুতি আছে যে, আন্দালিব রহমান পার্থের সঙ্গে হেরে যাওয়ার ভয়ে তোফায়েল আহমেদ নিজের এলাকায় প্রার্থী না হয়ে ভোলা-২ আসনে প্রার্থী হন। আওয়মী লীগের জোয়ারের সময়ও ভোলা-২ আসনে তোফায়েল আহমেদ পার্থের ছোটভাইয়ের কাছে হারতে হারতে জিতে যান।

আন্দালিব রহমান পার্থ ও আশিকুর রহমান শান্ত, দুই ভাইয়ের রাজনীতি একসঙ্গে পিতার দল বিজেপি দিয়ে শুরু হলেও মাঝপথে এসে পৃথক হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের মাঝামাঝি সময়ে শান্ত বিজেপি থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরব হন। পার্থ বিশদলীয় জোটের অন্যতম দল বিজেপি আঁকড়ে থাকেন। পার্থ-শান্তের মা শেখ রেবা রহমান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়। সেদিক দিয়ে এঁদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাক্রমে নাজিউর রহমান বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। পার্থ পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে সেই ধারা অব্যাহত রাখেন, শান্ত মায়ের সূত্রে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এভাবেই কাদের সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকীর মতো পার্থ-শান্তের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিদৃষ্ট হয়। দুই ভাইয়ের কারো বর্তমান রাজনীতি যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে বলা যায় তাদের দ্বন্দ্ব ক্রমে আরো প্রকট হবে।

বৈবাহিক সূত্রে শেখ পরিবারের আত্মীয় নাজিউর রহমান মঞ্জুর কেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হন? ধারণা করি, এক্ষেত্রে ভোলার স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব ছিল। নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও তোফায়েল আহমেদ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ভোলায় এই দুজনের একদলে বা একজোটে থাকা সম্ভবপর ছিল না। নাজিউর রহমান মারা যাওয়ার পর আলাদা আলাদা সময়ে চার জায়গায় চারটি জানাযা হয়। তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক রীতি ও রেওয়াজ হিসেবেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর একটি জানাযায়ও শরিক হন নি। তিনি তখন বিদেশে নয়, দেশেই ছিলেন। এ থেকে দ্বন্দ্বের মাত্রা আন্দাজ করা সম্ভব।

আওয়ামী লীগে নবাগত, তোফায়েল আহমেদের প্রতিদ্বন্দ্বী নাজিউর রহমানের ছেলে শান্তকে দিয়ে শেখ হাসিনা ভালো একটা রাজনীতি করতে পারবেন। শান্তকে তোফায়েল আহমেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাবেন। শান্ত ভোলা-২ আসনের জন্য মনোনয়ন কিনেছেন। মনোনয়ন কিনেই তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ আশিকুর রহমান শান্ত তোফায়েল আহমেদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তোফায়েল আহমেদ ভোলা-১ থেকে প্রার্থী হবেন আর শান্ত ভোলা-২ থেকে। সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী না হওয়া সত্ত্বেও শান্ত তোফায়েলের বিরুদ্ধে এজন্য বক্তব্য দিচ্ছেন যে, ভোলা-২ আসনের বর্তমান এমপি শান্তের প্রতিদ্বন্দ্বী আলী আজম মুকুল তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। মুকুলের প্রার্থিতা টিকবে কি না নির্ভর করছে তোফায়েল আহমেদের ওপর। তোফায়েল ভাতিজার পক্ষাবলম্বন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং প্রকারান্তরে শান্তের প্রতিযোগিতাটা করতে হচ্ছে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে।

শেখ হাসিনা হয়ত শান্তের সঙ্গে তোফায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা উপভোগ করবেন। আওয়ামী লীগে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে ভোলায় প্রতিযোগিতা করার মতো কেউ কখনো ছিল না। তোফায়েল হতে দেন নি। এখন একজন তৈরি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার অবস্থান দুর্বল হলেও ভোলার সর্বকালের সবচে জনপ্রিয় নেতার ছেলে হিসেবে তার অবস্থান শক্তিশালী। এই লোক মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে একবার তোফায়েলের কপালে ভাঁজ পরিয়ে দিতে পেরেছিলেল। এবার তো তিনি আরো পরিণত। শেখ হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা উপভোগ করবেন বলছি এজন্য যে, বিগত সময়েও শেখ হাসিনা ভোলায় তোফায়েল আহমেদের বিকল্প সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। একবার তো তোফায়েল আহমেদকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ থেকে সরিয়ে রাজনীতিতে অখ্যাত ভোলার একজন আইনজীবীনেতাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য বানান। সেই আইনজীবীনেতা তোফায়েলের বিকল্প হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু পেরে ওঠেন না। কারণ ভোলার আওয়ামী লীগ তোফায়েলের হাতে গড়ে তোলা। শান্ত পিতার ইমেজ ব্যবহার করে বিকল্প হয়ে উঠলে উঠতেও পারেন। তবে এই নির্বাচনে শান্তকে হয়ত শেখ হাসিনা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনোনয়ন দেবেন না। কারণ এতে তোফায়েল আহমেদ রুষ্ট হবেন। শেখ হাসিনা তোফায়েলকে অপছন্দ করলেও হয়ত এই সময়ে রুষ্ট করতে চাইবেন না। কারণ তোফায়েলকে এখন তাঁর দরকার। ভারতের সহায়তায় আবার ক্ষমতাসীন হতে চেষ্টারত অবস্থায় ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট অন্যতম বাংলাদেশি রাজনীতিককে রুষ্ট করা শেখ হাসিনা হয়ত এই মুহূর্তে কল্যাণকর মনে করবেন না। তবে অনুমান করা যায়, শেখ হাসিনা যখনই তোফায়েল আহমেদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে মনে করবেন, ভোলায় তাঁর বিকল্প সৃষ্টি করবেন। সেই বিকল্পটা হতে পারেন তোফায়েলের আজীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছেলে আশিকুর রহমান শান্ত। সেই সম্ভাবনাই বেশি

আশিকুর রহমান শান্ত যদি আওয়ামী লীগে লেগে থাকেন, আর আওয়ামী লীগ যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকে— তাহলে আওয়ামী লীগে তার ভবিষ্যত ভালো। আন্দালিব রহমান পার্থ নিজের দল বিজেপিকে দ্বিদলীয় রাজনীতির দেশে খুব জনপ্রিয় করতে পারবেন, এমনটা মনে হয় না। তবে তাঁর ব্যক্তিগত ফেইস ভ্যালুর কারণে নিজে রাজনীতিতে সদর্পে টিকে থাকবেন, এটা অনুমান করা যায়। বিজেপি ছোট একটা দল হলেও জোটগত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পার্থের নেতৃত্বে গুরুত্ব ধরে রাখতে পারবে। সামনে আর কখনোই হয়ত কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, জোটগতভাবে যেতে হবে। এই বাস্তবতা পার্থ এবং তাঁর দল বিজেপির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

-আবুল কাসেম আদিল,
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।