ভারতের নাগরিকত্ব আইন কেন এত বিতর্কিত?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ২১ ২০১৯, ২৩:৩১

।। জোয়ানা স্ল্যাটার ।।

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনটি দেশজুড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ উসকে দিয়েছে। যে সিদ্ধান্তটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা সম্পর্কে যা আপনার জানা প্রয়োজন, তা-ই এখানে তুলে ধরা হলো।

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনটি কি?

১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুমোদন দেয় এবং এতে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য প্রথমবারের মতো ধর্মকে শর্ত বানানো হয়েছে। এতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান – এ তিন দেশ থেকে ২০১৪ সালের আগে আসা অভিবাসীদের জন্য ভারতের নাগরিকত্বের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করা হয়েছে, যারা ছয়টি ধর্মের অনুসারী। এই ধর্মগুলো হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিক, জৈন এবং জোরাসট্রিয়ান। উল্লেখ্য, এখানে ইসলাম ধর্মকে বাদ দেয়া হয়েছে, যে ধর্মের প্রায় ২০০ মিলিয়ন অনুসারী রয়েছে ভারতে।

কেন এই আইন বিতর্কিত?

বিভিন্ন পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে আইনটি। ভারত যখন ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়, তখন এর প্রতিষ্ঠাতারা একটা সেক্যুলার জাতি গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে সকল ধর্মের মানুষকে স্বাগত জানানো হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হিসেবে। নাগরিকত্ব আইনে নির্দিষ্ট কিছু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারত তাদের জন্মকালীন সেই নীতি থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।

ভারতের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একজন প্রতাপভানু মেহতা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ভারত যে “হিন্দুদের মাতৃভূমি, সেটা প্রকাশের পথে এটা প্রথম আইনি পদক্ষেপ”।

এই আইনের ফলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা মোদি যে নীতি বাস্তবায়ন করছেন, সেটা ভারতের মুসলিমদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করবে। আগস্ট মাসে সাত দশকের নীতি নির্মূল করে প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেন। নভেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৬ শতকের একটি মসজিদের স্থলে হিন্দু মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়, যে মসজিদটি হিন্দু উগ্রপন্থীরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।

কিছু সমালোচক বলছেন এই আইনটি বৈষম্যমূলক ও ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন নিয়ম নীতির পরিপন্থী, তবে বিরোধীতাকারীদের মধ্যে অন্যদের উদ্বেগের কারণ ভিন্ন। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য – যেগুলোর সাথে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে – এই রাজ্যগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসী নিয়ে উত্তেজনা চলে আসছে। সেখানকার নাগরিকদের উদ্বেগের কারণ হলো এই আইনের ফলে অভিবাসীদের জন্য নাগরিক হওয়াটা সহজ হয়ে যাবে, এবং এতে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার চেহারা ও ভাষা বদলে যাবে।

সরকার কেন বলছে যে এই আইনটি জরুরি?

মোদি সরকার বলছে যে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে যারা ভারতে প্রবেশ করেছে, তাদেরকে মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার অংশ এই আইন। এই সম্প্রদায়গুলো প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে এবং মাঝে মাঝে সহিংসতার শিকার হয়েছে। এই দেশগুলোর সবই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবং ভারত সরকার বলছে যে, তাদের সাহায্য করার একটা নৈতিক দায়িত্ব তাদের রয়েছে।

বিরোধীরা বলছে, সরকারের যুক্তিতে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে। প্রথমত, এই আইনটি অতীত নির্ভর: যারা ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করেছে তারা এই সুবিধা পাবে, এখন এই দেশগুলোতে যারা রয়েছে, তারা এই সুবিধা পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, সরকার তাদের উদ্বেগের বিষয়টি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে এবং অন্যান্য কারণে যারা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদেরকে এখানে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সরকার তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারতো যদি তারা সুনির্দিষ্টভাবে ইসলামকে বাদ দেয়ার কথা না বলতো।

আইনের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে?

এই পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মারাত্মক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বলেছে এই আইনটি একটা ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ এবং কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি তারা আহ্বান জানিয়েছে যাতে মোদির শক্তিধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, এই আইনটি ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ এবং ‘ভারতের সংবিধানে আইনের চোখে সবার সমান অধিকারের যে নীতি সংযুক্ত রয়েছে, সেটাকে এখানে লঙ্ঘন করা হয়েছে”।

ভারতে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে, সেটা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আইন পাসের পর ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে আসাম রাজ্যে টানা বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে চার বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। রাজধানী নয়াদিল্লীতেও বিক্ষোভ হয়েছে, যেখানে রোববার জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটিতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

এর পর কি?

এই আইনের বিরোধীরা এর বৈধতা নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়ে রায় আসতে বহু মাস বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।

মোদির ডান হাত শাহ নাগরিকত্ব আইনটিকে আরেকটি পদক্ষেপের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন – সেটা হলো সারা দেশে নাগরিকত্বের তালিকা তৈরি করা, যে জন্য প্রত্যেক ভারতীয়কে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দলিলপত্র পেশ করতে হবে। আসামে নাগরিকত্বের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তার আদলে এই নাগরিকত্ব তালিকা তৈরি হবে। আসামে ওই তালিকার ফলে দুই মিলিয়ন মানুষ এখন রাষ্ট্রহীন হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে।

শাহ বলেছেন যে, কোন ভারতীয়ের দেশব্যাপী নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, শুধু ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ এতে শঙ্কিত হবে। (অভিবাসীদের তিনি উঁইপোকাও আখ্যা দিয়েছেন)। কিন্তু ভারতের মুসলিমরা আশঙ্কা করছেন যে, তাদের নাগরিকত্বের দাবিকে টার্গেট করার জন্যেই এই চর্চা শুরু করা হচ্ছে। এবং অনেকেই সম্ভাব্য এই তালিকা তৈরির ঘোষণার আগেই অনেকেই তাদের পূর্বপুরুষের কাগজপত্র জমা করা শুরু করেছেন।

(সাউথ এশিয়ান মনিটর থেকে)