বৃদ্ধাশ্রমের স্মৃতি। হাবীব আনওয়ার

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১০ ২০১৯, ১২:৩৭

‘মাস আগের কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হওয়া ক’জন বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম রাউজান থানার অন্তর্গত আমেনা-বশর বৃদ্ধাশ্রমে। হতভাগা সন্তানদের সম্মানিত বাবা-মা’র সাথে নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করে খাব বলে। মাঝারি ধরণের দু’টি ভবনে ৩০ জনের মত পিতা-মাতার দুর্বিষহ জীবন কাটছে। সবার বয়স ৬০ উর্ধ্বে।

মুসলিমদের পাশপাশি কয়েকজন হিন্দু পিতা-মাতাও আছেন। কেউ আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কাউকে রেখে যাওয়া হয়েছে।খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে কুশল বিনিময় করলাম। শুনলাম দুঃখভরা জীবনকাহিনী।

নোয়াখালি থেকে আসা নূর মুহাম্মদ চাচা জানালেন, “তিন ছেলে-মেয়ের সবাই শিক্ষিত ও সরকারী চাকুরীজীবী। ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন শহরে।কেউ কোন খোঁজ খবর নেয় না।নিজে নিজে চলবো এমন অর্থ সম্পদও নেয়। তাই…!”

তিনি আর বলতে পারলেন না। শিশুদের মত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমরা অশ্রুভেজা চোখে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

রিয়া নামের একজন বৃদ্ধা জানালেন, পুত্রবধুর নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় এসেছি আশ্রমে!

বাবা-মা। তিনটি অক্ষরের মধুমাখা ডাক। যে ডাকে কোন বিরক্তিকরভাব আসে না। একটি সন্তান পৃথিবীতে আসার পরে যে শব্দ বারবার উচ্চারিত হয় তা হলো, মা-বাবা।

আল্লাহ তায়ালার পরেই যাদের স্থান।কুরআনে কারিমে বহু আয়তে আল্লাহ তায়ালা নিজের হকের কথা উল্লেখ করার সাথে-সাথে পিতা-মাতার হকের কথা আলোচনা করেছেন।

আল্লাহ তাআলা পাক কালামে ইরশাদ করেন, “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদের সাথে উহ্ শব্দটিও বলো না। এবং তাদের ধমক দিও না। এবং বলো তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। (সূরা বনী ইসরাঈল :২৩)

পৃথিবীতে সন্তানের জন্য পিতা-মাতার সব থেকে বড় অবদান হচ্ছে, সন্তানকে দুনিয়াতে আনার মাধ্যম হওয়া। পিতা-মাতা না হলে আমরা দুনিয়াতে আসতে পারতাম না। তাদের আদর-যত্ন না থাকলে আমরা ভালোভাবে বাঁচতে পারতাম না। পিতা-মাতা সন্তানকে ভালোবাসে। দুনিয়াতে অনেক ভালোবাসা আছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর, ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা।তবে সব ভালোবাসার মাঝে একটা ‘কিন্তু’ রয়েছে। শুধু সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসায় নেই কোন ‘কিন্তু’। নেই কোন চাওয়া পাওয়া। তাদের ভালোবাসার মত অকৃত্রিম আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দুনিয়াতে নেই।

অথচ এই দরদী মা-বাবাকে আমরা কারণে-অকারণে কষ্ট দিই। অবহেলা করি। অথচ, এই পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মাঝেই যে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি নিহিত তা একটুও ভাবি না!

হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. বর্ণনা করেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বাবার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি রয়েছে।

(জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস : ১৮৯৯)

অন্য হাদীসে আছে, হযরত আবূ উমামাহ রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! সন্তানের উপর মাতা-পিতার কী অধিকার আছে? তিনি বলেন, তারা তোমার জান্নাত এবং তোমার জাহান্নাম।

(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৩৬৬২)

তাম্বিহুল গাফিলীনে ফকীহ আবুল লাইছ সমরকান্দী লেখেন, আল্লাহর নবীর যুগে এক ব্যক্তি ছিলেন। নাম আলকামা। মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে আসছে।কিন্তু মুখে কালেমা বের হচ্ছে না। স্ত্রী পেরেশান হয়ে গেলেন।আল্লাহর নবীর কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বললেন।আল্লাহর নবী হযরত বেলাল রা. কে পাঠালেন।হযরত বেলাল রা. হুজুর ছা.কে বললেন,কোন ভাবেই মুখ থেকে কালেমা বের হচ্ছে না।আল্লাহর রাসূল তার বৃদ্ধ মাতাকে ডাকলেন। আলকামা সম্পর্কে জানতে চাইলেন।তার মা বললো, আলকামা খুবই ধার্মিক। নামায,রোযাসহ সব ইবাদত করে।কিন্তু আমি তার উপর নারাজ! কারণ সে আমার খেদমত করে না।স্ত্রীর কথাকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহর রাসূল বললেন,এই যে মায়ের অসন্তুষ্টি, এ কারণে কালেমা বের হচ্ছে না।

পিতা-মাতা যদি কাফেরও হয় তবুও তাদের সেবা-যত্নের কথা হাদীসে আছে।

হযরত আসমার রা. একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। হযরত আসমা রা. হুজুর ছা. কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার জননী মুশরিকা! তিনি আমার সাথে দেখা করার জন্য আসেন।তাকে আদর-আপ্যায়ন করা জায়েজ হবে কিনা? হুজুর ছা. বলেন, তোমার জননীকে আদর আপ্যায়ন কর।

(তবে পিতা-মাতার নাজায়েজ আদেশ মান্য করতে হবে না।)

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা পিতা-মাতাকে তাদের হক অনুযায়ী খাতির-যত্ন করি না।অনেকে স্ত্রীর কান কথায় পিতা-মাতার সাথে অসদ্ব্যব্যবহার করে। এমনকি তাদেরকে প্রহার করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।তাদের বার্ধক্যের সময় তাদের ফেলে রেখে চলে যায়। এই তো গত ক’দিন আগেও কুঁড়িগ্রামে রাতের আঁধারে মাকে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে!

অথচ, হুজুর ছা. বৃদ্ধা পিতা-মাতাকে রেখে জিহাদে যেতেও নিষেধ করেছেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ‘আম্‌র রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে জিজ্ঞেস করল,  আমি কি জিহাদে যাব? তিনি বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? সে বললো, হাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাদের (সেবা করার মাধ্যমে) জিহাদ কর।

(সহিহ বুখারী, হাদিস ৫৯৭২)

আবার অনেক সন্তানকে দেখা যায়, পিতা-মাতার সাথে অভিমান করে, তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ রাখে। শশুর-শাশুড়িকে আব্বা-আম্মা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।নিজের পিতা-মাতার দিকে ভ্রুক্ষেপ কারে না।

হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার চেহারা দিকে মায়াবি দৃষ্টিতে তাকাবে সে হজ্বের ছাওয়াব পাবে।

হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হুজুর ছা. বলেন, যখন কোন সৎ সন্তান আপন পিতা-মাতার দিকে অনুগ্রহে দৃষ্টিতে তাকায় তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রতিবার দৃষ্টি বিনিময়ে একটি করে মকবুল হজ্বের ছাওয়াব লিখেন। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, যদি কেউ দিনে ১শতবার তাকায়? হুজুর ছা. বলেন তবুও। আল্লাহ মহান ও পবিত্র। (মিশকাত)

আমরা একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। সবার দুঃখ কথা শুনে আমাদেরও চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলো। এদিকে রাতের অন্ধকার নেমে এলো। আমরা নিজ গন্তব্যের দিকে ফিরে এলাম।

আমাদের আশেপাশে অনেক এমন হতভাগা সন্তান আছে যারা তাদের পিতা-মাতার সাথে হরহামেশায় অসাধাচরণ করে থাকে। পিতা-মাতাকে সহ্য করতে না পেরে রেখে আসে আশ্রমে। যেখানে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। অথচ, এই পিতা-মাতা আমাদের শিশুকালে আমাদের জন্য কত কষ্ট করেছেন। নিজে না খেয়ে, না পরে আমাদের দিকে খেয়াল রেখেছেন। কনকনে শীতের রাতগুলোতে তারা কখনো শান্তিতে ঘুমাতেন না। সারা রাত মা না ঘুমিয়ে কাটাতেন আর সারা দিন বাবা আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত বানাতেন। অথচ আজ আমরা…!

পরিশেষে রাব্বে কাবার দরবারে আরজ, আমাদের পিতা-মাতাকে ক্ষমা করে দাও! প্রত্যেক সন্তানকে বুঝ দাও!

রব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি ছগিরা। আমিন!

লেখক: শিক্ষার্থী,মেখল মাদরাসা হাটহাজারী চট্টগ্রাম।