বৃটিশ নাগরিক শামীমাদের আইএস’এ যোগদান: নেপথ্যে কী?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ১৫ ২০১৯, ১৫:২২

মুফতি আহমদ যাকারিয়া
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় যে,  শামীমা বেগম (১৫) মিস আবাসী (১৫) এবং খাদীজা সুলতানা (১৬) নামে লন্ডনের বেথনাল গ্রীন একাডেমির ৩ ছাত্রী সিরিয়ার “আইএস”র সাথে এক  সারিতে যুদ্ধ করার জন্য লন্ডন থেকে সিরিয়ায় চলে গেছেন।

তাদের এমন অনাকাঙিক্ষত বিপর্যয়ের মাশুল গুণতে হয় ইউরোপে বসবাসরত লাখো মুসলমান। “আইএস”র পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করাকে এই ৩ মেয়ে ফরয মনে করেছিলো, এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা পুরুষের মতোই নারীদেরও বের হওয়া ফরয মনে করত।

মানুষ মনে করে মাদ্রাসায় পড়লে দ্বীন সম্পর্কে বুঝার কারণে সবাই জিহাদিস্ট হয়, এবং এসব সন্ত্রাসী কাজে অংশ গ্রহন করে। কারণ মাদ্রাসায় প্রান্তিকতা শিক্ষা দেওয়া হয়। অথচ ইউরোপের কোন মাদরাসার ছাত্রই “আইএস”র সাথে যোগ দিতে সিরিয়ায় যায়নি। মাদ্রাসা পড়ুয়া কোন ছাত্র এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়নি। অথচ অংশগ্রহন করেছে “বেথনাল গ্রীন একাডেমি” নামক একটা নামকরা প্রতিষ্ঠিত সেক্যুলার ও সরকারী স্কুল এর ছাত্রীরা।

এই প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্টদের অংশগ্রহণে বৃটিশ মিডিয়া প্রথমে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। এসব মেয়েদের ঘর থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে।

কিন্তু তারা খোঁজ করে কী পেয়েছে জানি না কারণ রিপোর্ট জনগনের সামনে এখনো পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি। তবে সচেতন মহলের কাছে  মনে হয়েছে যে, “দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকাই ছিলো তাদের সন্ত্রাসী হবার বড় কারণ”।

“আরব বসন্তে” ইসলামপন্থীদের ইতিবাচক অবস্থান দেখা দেয়। মিশরে ইখওয়ান ও সালাফিদের সরকার বিরোধী হওয়া, তিউনিসিয়ার নাহদাহ’র সাহসী ভূমিকা, মরক্কোতে ইখওয়ানের উত্থান; এসবই তখন ইসলামিস্টদের মনে ধারণা তৈরি করে যে, মুসলিম দেশগুলোতে জেঁকে থাকা জালিম সরকার উৎখাতে অংশগ্রহন করা ইসলামি জিহাদের অংশ।

আসলেই কি এসবে অংশগ্রহণ করা ফরয? এক কথায় উত্তর দিলে বলব না ফরয নয়।

ফরয না হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে।

১- ইসলামি জিহাদে সশস্ত্র যুদ্ধ কখনো কোন বেসরকারী সংস্থা আহ্বান জানালে অংশগ্রহন করা যায় না। কোন মুসলিম রাস্ট্রপ্রধান ডাক দিলে তবেই অংশগ্রহন করা যায়। তবে প্রধান শর্ত হতে হবে মুসলিম বনাম অমুসলিমদের যুদ্ধ। এবং তা হতে হবে যে সরকার ডাক দিয়েছে তারই দেশের মুসলিম। অন্য দেশের মুসলিমদের উপর ঐ সরকারের ডাকে যাওয়া ফরয নয়। তবে সকল মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানরা একযোগে জিহাদের ডাক দিলে সেসব দেশের মুসলিমরা অংশগ্রহণ  করলে তখন করতে পারে। তাও যুদ্ধে যাওয়ার বাছাই কার্যক্রম হতে হবে সরকারী সংস্থার মাধ্যমে। আরো মনে রাখতে হবে যে, সকলের উপরই ঐ অবস্থায়ও যুদ্ধ করা ফরয নয়।

২- “আরব বসন্ত” নামে যে গণজাগরণ আরব বিশ্বে আমরা দেখেছি তা ছিলো “সিভিল ওয়ার”, বা মুসলমানের সাথে মুসলমানের যুদ্ধ। সেই অর্থে সিরিয়ার যুদ্ধ আসলেই কনফিউজিং এবং এর ব্যাপ্তি ও সীমা খুবই মারাত্মক। এখানে আসাদকে উৎখাত করতে তখনকার সাঊদী ও মিসরীয় কিছু উলামায়ে কিরাম জিহাদের ডাক দিলেও অনেক আলিম এটাকে মুসলিমদের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ মনে করেন।

৩- যে দেশের নাগরিক হিসেবে থাকা হবে, ঐ দেশের সাধারণ আইন মেনে চলা নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। কেবল ঐ আইনের ক্ষেত্রে শারীয়াহ অপশন নেয়া যাবে, যা মানতে গেলে মারাত্মক ‘কুফরি’ হবে। আমাদের বাংলাদেশের আইনে একজন মুসলিম ইসলাম মেনে চলার গ্যারান্টি নিয়ে জীবন যাপন করতে পারে। কাজেই এই দেশের কোন আইন ভাঙা কোন নাগরিকের উচিৎ হবে না। সরকার যেহেতু তার নাগরিকদের সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যেতে দিচ্ছে না, সেহেতু এখানে আইন ভাঙা যাবেনা।

বৃটেনের এই মেয়েগুলো ঘর থেকে বাবা মাকে না জানিয়ে পালিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়া কতটুকু আশঙ্কাজনক তা বলে বোঝানো যাবে না। এর ক্ষতিকর অনেক দিক রয়েছে, তবে দুইটা মারাত্মক দিক খুবই স্পর্শকাতর!!

১- এসব মেয়েরা ইসলামী জ্ঞানের দিক থেকে হয়ে থাকে শূন্য। তারা এখনো এসএসসিও পাশ করেনি, এরূপ টিন এইজের কোন মেয়ে একা একা ঘর হতে কোথাও মাহরাম ছাড়া বের হতে পারে না।  মা, বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেও জানবেনা, অথচ এই বয়সের একটা মেয়ে জিহাদের জন্য বের হবে, এটা ইসলামের মৌলিক আইন বিরোধী।

২- ইসলামী যুদ্ধে মেয়েদের অংশগ্রহন ছিলো রাস্ট্রপ্রধানের অনুমতির সাথে শর্তযুক্ত, এবং যুদ্ধের ময়দানে তাদের ক্ষেত্র ছিলো একেবারেই সীমিত। যেমনঃ সেনা বাহিনীর পানি সরবরাহ, চিকিৎসা সেবা, খাদ্য সরবরাহ ইত্যাদি। হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা মহিলাদের নাম ইতিহাস হাতড়ে মাত্র কয়েকজনের মেলে, তাও তারা ছিলেন মাহরামের সাথে।

এরই আলোকে বলা যায় যে, সব মেয়েরা পালিয়ে গেছে তাদের সাথে ইসলামী শরীয়ার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এরা বিভ্রান্ত। এরা বিকারগ্রস্ত।

মিডীয়ার কল্যানে “যৌন জিহাদ” নামে একটা কথার সাথে আমরা বেশ পরিচিত। অর্থাৎ কিছু মেয়েরা জিহাদ করা যোদ্ধাদের স্ত্রী হয়ে তাদের যৌন জীবনের সাথী হতে সিরিয়াতে যায়। মিডিয়ার এসব প্রোপাগান্ডা শুনে এতোদিন এসব বিশ্বাস হতো না। কিন্তু “বেথনাল গ্রীন”র ছাত্রী শামীমা মিডিয়ার সামনে যে তথ্য দিয়েছে তার দেয়া তথ্যে সে কথাই প্রমানিত হচ্ছে। যোদ্ধাদের যৌনতা সাপ্লাই দেয়ার জন্য মেয়েরা জিহাদে যাবে, এটা ইসলামি ইতিহাসে ঘটেনি কখনও। এবং এসব কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থনও করে না।

শামীমা “টাইমস পত্রিকাকে” দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছে; সে সিরিয়ায় গিয়ে দুই সপ্তাহ “আইএস” সেনাদের সাথে থাকে। পরে হলেন্ডের এক নৌ-মুসলিম জিহাদিস্টের সাথে তার বিয়ে হয়। প্রথম দুইটা সন্তান মারা যায়। এখন সে সন্তান সম্ভবা। চাচ্ছে তার সন্তানকে জিহাদের চেয়ে প্রাধান্য দিতে। ফিরে আসতে চায় স্বভূমি বৃটেনে। সে নাকি বলেছে “আইএস” এর সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়ায় সে এখনো অনুশোচনা করে না। এমনকি রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া মুসলিমদের কাটা মাথা দেখেও তার খারাপ লাগেনি। তবে সে মনে করে খেলাফত কায়েমের চিন্তা শেষ। এখন সর্বত্রই অপরাধ প্রবনতা। কাজেই সিরিয়াতে সে আর থাকতে চায় না।

তার এই সরল স্বীকারোক্তির কারণেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এরা আসলে দাবার ঘুটি। এদেরকে ব্যবহার করেছে সংঘবদ্ধ কোন আন্তর্জাতিক গ্রুপ। যারা এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে চেয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মুসলিমদের ব্যাপারে বৃটেনে নেতিবাচক ধারণা। আর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো যে, পুরো ইউরোপ জোরে ক্রমশ মুসলিম বৃদ্ধির যে হিড়িক পড়েছে তা স্তিমিত করা। অথচ ইসলামের শুরুলগ্ন থেকেই ইসলামকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন বিতর্কিত চক্রান্ত করে আসতেছে বিভিন্ন গোষ্ঠী তথাপি ইসলামের জয়যাত্রা কেউ থামাতে পারেনি; আগামীতেও পারবে না ইনশাআল্লাহ!!