বাবা হারানোর এক বছর

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ১৮ ২০২১, ১৮:২০

মুহাম্মদ মাহবুবুল হক: মানুষের জীবনে বাবা এক অমূল্য সম্পদ।বাবার অনুপস্থিতি অন্য কোন ভাবেই পূরণ হয় না। সন্তানের প্রতি বাবার আদর-আহ্লাদ ও শাসন অতুলনীয়।পরম মমতায় সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এক অবিকল্প নাম বাবা।

আমার বাবা মাওলানা মুজ্জাম্মিল আলী।আমার আদর্শ,আমার অস্তিত্বের প্রতীক।গত বছরের এই দিনে আমার অস্তিত্বের এই সূর্যটি ডুবে যায়,এই এক বছর আমার জগতটা আলোহীন মনে হয়েছে।আমার জীবনের প্রদীপটা হারিয়ে ফেলেছি।বাবার ছায়াহীন জীবন যেন রোদেলা দুপুর।গতবছর ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।আজ বাবা হারানোর এক বছর।

বাবার স্বপ্ন ছিলো তাঁর সন্তানরা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়,ইসলামের প্রকৃত আদর্শ ধারণ করে চলে।তাই তিনি সন্তানদের ইসলামি শিক্ষায় গড়ে গেছেন।বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা পাঁচ ভাই কওমী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস কমপ্লিট করে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি।

আমরা যেন সবাই আলেম হয়ে ইসলামের কাজে নিয়োজিত থাকি,বাবার মনের বাসনা এরকমই ছিলো।

ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার মোহ আমার বাবাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।একদম সাদামাটা সহজ-সরল জীবন যাপন করে গেছেন তিনি।সারা জীবন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষ গড়ে গেছেন।তাঁর অসংখ্য ছাত্র সুনামের সাথে বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন।তিনি এমনভাবে ছাত্র গড়েছেন,যে সবাই তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসেন।আমার বাবার কর্ম জীবনের শুরু হয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে,শেষ হয় কওমী মাদ্রাসা দিয়ে।তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বুনিয়াদী ইসলাম শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাবাহী মক্তব।পরবর্তীতে সাবাহি মক্তবের পাশাপাশি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দৌলতপুর নোয়াপাড়া দারুল উলূম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি অত্যন্ত সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে আমৃত্যু পরিচালনা করে গেছেন।

আমি বাবার মধ্যে শিক্ষা ছাড়া অন্য কিছুর মধ্যে মনের টান দেখিনি।প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তাঁর নিরলস ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।একটি শিক্ষিত জাতী গঠনে তাঁর অবদান অপরিসীম।পরিবার ও সংসার জীবন থেকে তিনি মাদ্রাসাকে বেশি প্রধান্য দিতেন।মাদ্রাসা ও মসজিদ গড়ার কাজেই জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন।তিনি ছিলেন শিক্ষার বাতিঘর, মানুষ গড়ার কারিগর।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলেন।সততা ও আমানতদারিতার এক মূর্তপ্রতীক ছিলেন তিনি।হিংসা, নিন্দার স্থান ছিলো না তাঁর জীবনে।সারা জীবন তিনি পরোপকারী ছিলেন।তাঁর আমানতদারিতা এমন ছিলো যে,আমি ছোটবেলা দেখেছি এলাকার অনেক মানুষ তার সঞ্চিত অর্থ বাবার কাছে জমা রাখতেন।বাবার মাধ্যমে অনেকে জমি-জমা ক্রয় ও সম্পদ সঞ্চয় করতেন।এলাকায় তিনি যেন একটি ‘মিনি ব্যাংক’-এর সেবা দিতেন।বাবার আমানতদারিতা ও সততার গুণে তিনি মানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার পাত্র।

আমি বাবাকে দেখেছি ইসলামী শরীয়াহর জায়েজ-নাজায়েজ পালনের পাশাপাশি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকেও বিরত থাকতেন।কোন কোন মাসআলা এমন আছে,যে এটা জায়েজ কিন্তু তাকওয়ার দাবি হলো পরিহার করা।তিনি তাকওয়াকেই প্রধান্য দিতেন।

আমার সম্মানিত পিতা মাওলানা মুজ্জাম্মিল আলী রাহিমাহুল্লাহ নিভৃতচারী একজন বুজুর্গ আলেম ছিলেন।ছিলেন মুত্তাকী ও আল্লাহওয়ালা।

মাঝে-মধ্যে গভীর রাতে পাশের রুম থেকে আব্বার যিকিরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙতো।শেষরাতে তাঁর কান্নাভেজা মোনাজাতও শুনতে পেতাম।আহ! বাবার ভরাট কন্ঠের উচ্চ আওয়াজের কুরআন তেলাওয়াতও আর শুনা যায় না।একদম প্রচারবিমুখ ছিলেন।এজন্য তাঁর ব্যক্তিগত অনেক আমল অপ্রকাশিতই থাকতো।

ব্যক্তিগত জীবনে বাবা অত্যন্ত রুচিশীল ছিলেন।অপরিচ্ছন্নতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।পুষ্টিকর ও ভালো খাবার খেতেন।ছোটবেলা থেকেই দেখতাম ফলের মৌসুমে বাজার থেকে ব্যাগভর্তি ফল-মূল নিয়ে আসতেন।বাবা ভালো ও পুষ্টিকর খাবার খেতে উৎসাহ দিতেন আর বলতেন,ভালো খাবার না খেলে মেধা ভালো হয় না।

বাবার মতো চিকিৎসা সচেতন খুব কম মানুষই দেখেছি আমি।নিজে কোন সামান্যতম রোগাক্রান্ত হলে সাথে সাথেই উন্নত চিকিৎসা করাতেন।পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে এমনকি জ্বর হলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেই হবে।চিকিৎসার ব্যাপারে কোন অবহেলা তাঁর ভালো লাগতো না।মাঝে-মধ্যেই বাবার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে।ক্ষুদ্র এই স্মৃতিচারণে সবগুলো লেখা সম্ভব নয়।আল্লাহ তাআ’লা আমার বাবাকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌসের আ’লা মাকাম দান করুন-আমীন।