বাংলাদেশের জাতিবাদ বিতর্ক

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ২৩ ২০১৯, ১৭:০৭

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত: বাংলাদেশের জাতিবাদ বিতর্ককে বুঝতে হলে আমাদেরকে মধ্যযুগের স্বাধীন সুলতানি বাংলার ইতিহাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে আজকের বাংলাদেশ পর্যন্ত পর্যালোচনা করতে হবে।

উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ও জনপদ দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বাধীন ভৌগোলিক সত্তা ও স্বতন্ত্র জাতি ও কৃষ্টির পরিচর্যা করে আসছে। বিশেষ করে মধ্যযুগে চৌদ্দ-পনের ও ষোল শতকের প্রথমার্ধে স্বাধীন সুলতানী শাহী বাঙ্গালা যেদিন থেকে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে সেদিন থেকে এই স্বাধীন স্বতন্ত্র সাধনা একটি লক্ষ্যণীয় মাইলফলক অতিক্রম করেছে। গৌড়, লাখনাউতি, পান্ডুয়া, সোনারগাঁও এবং সাতগাঁও — মধ্যযুগের বাংলার এই নগরগুলিকে কেন্দ্র করে ইলিয়াস শাহ ও হোসেন শাহের মত স্বাধীন সুলতানেরা তাঁদের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহান সুফি সাধক যেমন হজরত শাহ জালাল, নূর কুতব ই আলম, বাবা আদম শাহ, শাহ আলি বাগদাদী, শাহ মখদুম, মখদুম শাহ, খান জাহান আলী প্রমুখেরা দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলাভাষীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের বাহক হিসাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করে এই রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছিলেন।

ষোল শতকের শেষে ও সতের শতকের শুরুতে মুঘল আমলে যদিও এই স্বাধীন স্বতন্ত্র বাংলা দিল্লীকেন্দ্রিক মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল এবং ঢাকা এর প্রাদেশিক রাজধানী হয়েছিল, তবুও এরপরে আঠার শতকের মধ্য অবধি মুঘল নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদকে রাজধানী করে বাংলা আবার একটি প্রায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামোর অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

বাংলাভাষীদের এই স্বাধীন ও প্রায়-স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামোতে বড়ধরণের পরিবর্তন আসতে শুরু করে ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের যোগসূত্রের মধ্য দিয়ে যে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার ফলে। এই গাটছড়ার মধ্য দিয়ে যে শোষণমূলক আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত নামে তা এই অঞ্চলের বাংলাভাষী প্রধানতঃ মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনে বিরাট বিপর্যয় নিয়ে আসে।

এই বিশাল বিপর্যয়কে মোকাবেলা করে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের মহান সব উদ্যোগ শুরু হয়েছিল উনিশ শতক থেকেই। উত্তর-পশ্চিম উপমহাদেশে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি সূচিত জিহাদি আন্দোলনের প্রভাবে এই বঙ্গেও উদ্ভূত হয়েছিল তিতুমীরের নেতৃত্বে তরিকা-ই-মুহাম্মাদিয়া আন্দোলন এবং হাজী শরিয়তউল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন।

এরপরে বিশ শতকে উপমহাদেশের আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিম নেতৃত্ব প্রথমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যৌথভাবে আজাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে; কিন্তু পরবর্তীকালে সেই পুরনো ইংরেজ-হিন্দু আঁতাতের মুখোমুখি হয়ে বাধার সম্মুখীন হয়ে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃত্ব স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি ও রাষ্ট্রকাঠামো অনুসরণের পথকেই বেছে নিয়েছে। বাংলাভাষী মুসলিম নেতৃত্বও এই পথ পরিক্রমাকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করেছে ও স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র জাতি ও রাষ্ট্র হিসাবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে গ্রহণ করে নিয়েছে।

উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকে আধুনিক কালে যে মুসলিম ব্যক্তিত্বেরা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী বিপর্যয় থেকে মুসলিমদের আজাদী ও পুনর্জাগরণী আন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমীর আলী, আল্লামা শিবলী নুমানী, মওলানা মুহম্মদ আলী জওহর, মওলানা আকরম খাঁ, আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আবুল আলা মওদূদী, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ, ফররুখ আহমদ, মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম প্রমুখ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে একই সময়ে একইভাবে পশ্চিমা আধুনিকতাকে মোকাবেলা করেছেন জামালউদ্দিন আফগানি, মুফতি মুহম্মদ আবদুহু, রশিদ রিদা, হাসান আল বান্না, সাইয়িদ কুতুব, সৈয়দ বদিউজ্জামান নূরসি, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী, আলী শরিয়তী প্রমুখ।

১৯৪৭ সালে আজাদী আন্দোলন একটি মাইলফলকে পৌঁছার পরপরই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ঐক্যে ভাঙন দেখা দেয়। ভাষা প্রশ্নের এই দূরত্ব থেকে শুরু করে ক্রমাগত দুই অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে হাইলাইট করে সামনে নিয়ে আসা হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি লৌকিক সংস্কৃতির প্রশ্নে এই বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেইসাথে দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও হাইলাইট করা হয়। গণতান্ত্রিক চর্চায় ঘাটতি দেখা দিলে এইসব বিভক্তি রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করে প্রথমে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও পরে রাষ্ট্রীয় বিচ্ছিন্নতার দিকে মোড় নেয়।

দুই অঞ্চলের মুসলিমদের এই বিভক্তির জায়গাটি টের পেয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত শুরু থেকেই এতে ইন্ধন যোগাতে থাকে। তাদের বিভিন্ন রকমের এজেন্ট এই কাজে গোপনে তৎপর ছিল বরাবর। ষাটের দশকের শুরু থেকে ভারতীয় পেশাদার বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগ এই কাজে মনোনিবেশ করেছিল। এর পরিণতিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধের চরম মুহূর্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ভারত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালায় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি জাতিবাদীদের সহায়তায় “বাংলাদেশ” রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এতে করে এই অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠির স্বাতন্ত্র্যচেতনা পুনরায় জাগ্রত হলে ভারতবান্ধব বাঙালি জাতিবাদের বিপ্রতীপে সত্তর দশকের শেষার্ধে বাংলাদেশি জাতিবাদের উত্থান হয়। লেখক আবুল মনসুর আহমদ ও সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদের মাধ্যমে এই বাংলাদেশি জাতিবাদের মতাদর্শ গঠিত হয়। জিয়াউর রহমান এই মতাদর্শকে রাজনৈতিকভাবে প্রচার ও প্রসার করে ব্যাপকভাবে জনমানুষের চেতনাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হন।

কিন্তু জিয়াউর রহমানের অকাল মৃত্যুর ফলে যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুন্যতা দেখা দেয় সেই সুযোগে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সর্বাত্মক সহায়তায় পুনরায় বাঙালি জাতিবাদী অংশটি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করে ফেলে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে। এর চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পুনর্জাগরিত বাঙালি জাতিবাদ যখন ভারতীয় ইন্ধনে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়।

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালি সংস্কৃতির আড়ালে এই ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ এতটাই শিকড় গেড়ে বসেছে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে যে কেবলমাত্র ভৌগোলিক আত্মপরিচয়ভিত্তিক বাংলাদেশি জাতিবাদ দিয়ে এর মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। ভারতবান্ধব বাঙালি জাতিবাদের এই ফ্যাসিবাদী রূপান্তরকে সম্যকভাবে মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজন বাংলাদেশি জাতিবাদকে ভাষা, সংস্কৃতি, ভূগোল, ধর্ম ইত্যাদি সব মাত্রায় স্বতন্ত্র ও স্বাধীন করে পরিণতভাবে বিকশিত করা। একমাত্র তাহলেই ভারতবান্ধব বাঙালি জাতিবাদের ফ্যাসিবাদী প্রকাশকে যোগ্যতার সাথে মোকাবেলা করে স্বাধীন সার্বভৌম স্বতন্ত্রধারার বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে। অন্যথায় নয়।