বন্দিজীবনের ঈদ 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৩ ২০২২, ২২:২৭

আলী হাসান উসামা: গতবছর ইদুল ফিতরের দিনটা ছিল আমার রিমান্ডের সর্বশেষ দিন। ইদের আগের দিন আসর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। পিঠমোড়া করে দু-হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো। দুচোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। এভাবে আড়াই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। প্রথমে যদিও বেশ অপমানবোধ কাজ করেছিল; কিন্তু প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা.-এর কষ্টগুলো স্মরণ করে অনেক হালকা লেগেছিল। তিনি আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও যত আঘাত সয়েছিলেন, তার তুলনায় এ আর কী! আমি যেহেতু তাদের হাতে বন্দি, তারা আমার সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করতেই পারে। এরপরও যে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভব্যতা প্রদর্শন করেছে, এ-ই বা কম কীসে! আম্মার, সোহাইব বা বেলাল রা.-দের কপালে তো তা-ও জোটেনি। আর বয়স্কা নারী সাহাবি সুমাইয়া রা.-এর কথা তো বলাই বাহুল্য।

এরপর ইদের দিন আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদ হয়নি। তবে সেদিন অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠে সময় কাটানো ছিল চরম কষ্টের। বহুবার অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেহেতু সবাই নামাজ আদায় করবে, তাহলে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়েই যেন অন্তত নামাজটা শুধু আদায় করতে দেয়া হয়। ইদের নামাজ তো আর একা একা আদায় করা যায় না। কিন্তু সে আবেদন মঞ্জুর হয়নি। ইদের দিন ও তার পরের দিন কোনো মুসলমানকেও ডিউটিতে দেখিনি। যার কারণে কেউ এসে নামমাত্র শুভেচ্ছাও জানায়নি। কোনো খোঁজখবরও নেয়নি। চারদিকে সবাই অমুসলিম; নিজেও ইদের নামাজ পড়তে পারছিলাম না। সবমিলিয়ে নিজেকেই কেমন যেন মুসলমান ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। যদিও পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তির জন্য ইসলামে ছাড় রয়েছে; কিন্তু মন কি আর বাধা মানে! এতকালের রুটিনের ব্যত্যয় অন্তর খুব সহজে কবুল করে!

রিমান্ডের শুরু থেকেই ইফতার, সাহরি বা রাতের খাবার কিছুই তেমন খেতে পারছিলাম না। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দু-এক মুঠ খালি ভাত খেয়েছিলাম। অনেকবার খাবারের সমস্যার কথা জানিয়েছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। উলটো প্রতি ওয়াক্তে আমার বাটিভরা খাবার কেন থেকে যায়, এ নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে। এমনকি এ ধারাবাহিকতা জারি থাকলে অন্য সব আসামির বাটিতেও খাবার একেবারে কমিয়ে দেয়া হবে বলে বাবুর্চির পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। না খেয়ে খেয়ে গ্যাস্ট্রিকের খুব সমস্যা হচ্ছিল। মাঝে দুদিন স্বর্ণের মামলায় ফেঁসে যাওয়া বিমানে কর্মরত এক অচেনা ভাই তার খাবারের অর্ধেকটা আমার সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন। কীভাবে যেন হোটেল থেকে সে খাবারগুলো তিনি আনিয়েছিলেন।

এরপর যখন ইদের দিন আসল, তখন সে দিনের দুপুর আর রাতের খাবারের মান তুলনামূলক ভালো ছিল। এ দুইবেলা পেট পুরে খেয়েছি। অবাক হয়ে ভেবেছি, একটা সময় মানুষ একবেলা খাওয়ানোর জন্য কত চেষ্টা-অনুরোধ করত। দস্তরখানে বসলে হরেক রকম সুস্বাদু খাবার সামনে হাজির করা হতো। আর এখন একটা বেলা পেট পুরে খাওয়ার জন্য কীভাবে মুখিয়ে থাকতে হয়। গ্যাস্ট্রিকের যন্ত্রণায় ইবাদত করাও দায় হয়ে যায়। এর নামই জীবন!

অবশ্য আমার একটা দুর্বলতা ছিল। একাকিত্ব ও নির্জনতার সময়গুলো কীভাবে কাটাতে হয়, প্রথমে দীর্ঘদিন আমি তা বুঝতে পারিনি। এমনি একাকিত্ব আমার অনেক প্রিয়। কিন্তু চিরকালীন অভ্যাস ও রীতি ছিল, একাকিত্বের সময়গুলো আমি বই পড়ে ও লেখালেখি করে কাটাতাম। এত এত মাহফিল ও সামাজিক কাজ করেও মাত্র তিন বছরে ৩৫ এর অধিক বইয়ের কাজ করা এভাবেই সম্ভব হয়েছিল। বন্দিজীবনের শুরুর দিকে লেখালেখি না করতে পারার যাতনাই আমাকে সবচে বেশি জড়িয়ে ছিল। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস বই ও খাতা-কলম হতে দূরে থেকেও যে অনেক সুখ ও প্রশান্তি পাওয়া যায়; এ সময়গুলো যে অতি উত্তমভাবে সালাত, জিকির ও মুরাকাবায় কাটানো যায়, বিষয়গুলো তাত্ত্বিকভাবে জানলেও অনভ্যস্ততার কারণে আগে কখনো ভাবতে পারিনি৷ কারাগারে এক মহান আল্লাহওয়ালার সুদীর্ঘ সান্নিধ্য পাওয়া, সবগুলো তরিকার ওপর সুদীর্ঘ মেহনত করে প্রতিটাতে ইজাযত লাভ করা, বিশেষত মুরাকাবা ও মুশাহাদার অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে মাকামে ইহসানের কিছু মণিমুক্তা সংগ্রহ করা ছিল আমার জীবনের অন্যতম অর্জন। আরও খাস করে বললে, ভারতীয় উপমহাদেশের দুই অমূল্য রত্ন মুজাদ্দিদে আলফে সানি রাহ.-এর তাজদিদসমূহ এবং সায়্যিদ আহমাদ শহিদ রাহ.-এর তরিকায়ে বেলায়েতের সঙ্গে তরিকয়ে মুহাম্মাদিয়ার সংযোজন (দারুল হারব ফাতওয়াদাতা শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রাহ.-এর ভাষায় যার নাম ‘সুলুকে রাহে নবুওয়াত’) এর সঙ্গে পরিচিতি ও ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার জীবনে সম্পূর্ণ নতুন বিষয়। এ জন্য হাজারবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেও তার যথাযথ কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভব হবে না।

ইদের দিন ও তার পরের দিন সব বিধর্মী কর্মকর্তা-কর্মচারী ডিউটি করছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল পাহাড়ি। ইসলাম নিয়ে তার ছিল ব্যাপক এলার্জি। এমনকি বাহিনীর অন্যরাও তার এ বিষয়টা চরম অপছন্দ করত। কিন্তু বহু বলেকয়েও তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি৷ সুযোগ পেলেই সে বন্দিদের সঙ্গে ইসলাম নিয়ে তর্ক জুড়ে দিত। রামাদানের এক রাতে আমার পাশের সেলের জনৈক মাওলানা সাহেব তার নিকট গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ চেয়েছিল। অমনি বেচারা তার ভেতরের কদর্য উগড়ে দিতে শুরু করল। সে বলল, হাদিসে ওষুধ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিম শরিফের হাদিসের রেফারেন্স আমার কাছে আছে। অসুখ হলে আল্লাহর ওপর ভরসা করো। তার কাছে দুয়া করো। মানুষের কাছে সাহায্য চাও কেন? ওষুধ সেবন করলে মুশরিক হয়ে যাবে। এবার সে গুগল করে নাস্তিকদের সাইট থেকে বিভিন্ন দলিল ও যুক্তি দেখাতে লাগল। আমি চুপ থাকতে পারিনি। কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিলের আলোকে তার প্রতিটা পয়েন্টের জবাব দিলাম। এরপরও সে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। তখন উত্তেজিত হয়ে বলে ফেললাম, হাঁটু সমান জ্ঞান নিয়ে তর্ক করতে এসো না। গুগল করে সস্তা বানোয়াট রেফারেন্স হাজির না করে পারলে নিজে কিছু পুঁজি সংগ্রহ করো। সেল্ফ স্টাডি ও রিসার্চ করে কথা বলতে এসো। এরপর তার সংগৃহীত আর্টিকেলে কী কী অসারতা আছে, তা পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কোট করলাম। এবার সে বলল, কথা তো হুজুররাই পালটায়৷ একবার বলল, ইসলামে কোনো সংক্রামক ব্যাধি নেই। আবার দুদিন পর বলতে শুরু করল, করোনা সংক্রামক। জবাব দিলাম, হুজুরের কথা বুঝতেও সুস্থমস্তিষ্কের প্রয়োজন। অন্তরকে তালাবদ্ধ রেখে দিলে ভেতরে কখনোই আলো প্রবেশ করবে না। হুজুররা বলেন, কোনো রোগের নিজস্ব সংক্রমণক্ষমতা নেই; তবে আল্লাহ চাইলে কোনো রোগের জীবাণু অন্যের মধ্যে সংক্রমিত কর‍তে পারেন; এটা রোগের নিজস্ব শক্তি নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত প্রভাব। সেদিন বেচারা ফোঁসফোঁস করতে করতে চলে গেল।

এরপর যতবারই তার ডিউটি পড়েছে, আমার সামনে আর কারও সাথে কথা বলেনি। এমনকি শেষ দিন বিদায়ের সময় আমার প্রতি সমীহ প্রকাশ করেছে। আরেকজনের কাছে বলেছে, এই হুজুরটার পড়াশোনা আছে। রিমান্ড থেকে রিলিজ করে কোর্টে নেয়ার জন্য যখন আমাকে হাতকড়া পরানো হচ্ছে, তখন সে দুষ্টুমি করে বলল, কী হুজুর, বুকের ভেতর ধুকপুক করছে নাকি? আমি কিছু বলার আগেই টিমের এক সদস্যই জবাব দিলো, উনাকে চেনো? সে ডানে-বামে মাথা নাড়াল। তারা বলল, ইউটিউবে সার্চ করে উনার বয়ান শুনে দেখো; তোমার বুকের ভেতরই ভূমিকম্প শুরু হয়ে যাবে। সে তখন চোখ দুটো বড় বড় করে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থেকেছিল। আর অন্যরা তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেছিল।

রিমান্ডের নির্জন কক্ষের তুলনায় জেলের সম্মিলিত ইদ বেশ মজায়ই কাটে। তবে কোরবানির ইদের দিন ভোরবেলা উঠেই আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছিল। প্রথমে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ইদের দিনও বিল্ডিং খোলা হবে না। প্রত্যেক ব্লক লকআপ থাকবে। যে যার বারান্দায় ইদের নামাজ পড়ে নেবে৷ কিন্তু এভাবে কি ইদ হয়! তখন সবাই অনশন শুরু করল। সকালের নাশতা কেউ নিলো না৷ ইদের নাশতা পড়ে থাকল গেইটের বাহিরে। এবার কর্তৃপক্ষ আসল। হাজতিরা সবাই শুধু এ দিনটা বিকাল পর্যন্ত বিল্ডিং খোলা রাখার অনুরোধ করেছিল। প্রথমে গড়িমসি করলেও একপর্যায়ে তারা দাবি মেনে নিল। এরপর ইদের জামাআতের আয়োজন করা হলো। মোট দুটো জামাআত হলো; এক জামাআতের ইমামতি আমাকে করতে হলো। আরেক জামাআত পড়ালেন মুফতি আমিনি রাহ.-এর বড় জামাই প্রিয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা জোবায়ের হাফি.। সেদিন যেন লোকদের ঢল নেমেছিল। সকাল থেকে বিকালে লকআপ পর্যন্ত এক মুহূর্ত স্থির হতে পারিনি। মাঝে দুপুর গড়িয়ে বিকাল নিকটবর্তী হলে কয়েকজন ভাই অনেক কষ্ট করে আমার দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছিল।

কারাগারে দেখেছি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। সর্বস্তরের অপরাধী মানুষগুলোও সেখানে গেলে অনেকটা পালটে যায়৷ নিজেরাও সাধ্যমতো দীন পালন করে আর দীনদারদের (বিশেষত আলিমদের) মন খুলে ভালোবাসে৷ কারাগারে এত অধিকসংখ্যক লোক আমাকে চেনে, শুধু চেনেই না, মন ভরে ভালোবাসে, বিষয়টা কল্পনায়ও ছিল না। আমাকে চেনে না এমন লোক হাতেগোনা খুব কমই পেয়েছি। ঢাকা জেল বা কাশিমপুর সব জায়গায় বন্দিদের ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হয়েছি। আমাদের ছাত্ররা আর আমাদের কী খেদমত করে, কারাগারে এরচে বহুগুণ বেশি খেদমতের প্রতিযোগিতা দেখেছি। কার আগে কে খেদমত করবে, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। দুয়া ও কান্নার কথা তো বলাই বাহুল্য। একদিন এক ব্যক্তি এসে বলল, আমি দুয়া করেছি, আল্লাহ আমার হায়াতটা যেন আপনাকে দিয়ে দেন আর আমার সারাজীবনের বন্দিত্বের বিনিময়ে হলেও যেন আপনাকে মুক্ত করে দেন। পুরো সময়ে নিজের কাপড় পর্যন্ত একদিনও ধুতে পারিনি। খাবারের আগেপরে প্লেটবাটি পরিষ্কার করতে পারিনি। আর প্রতিটা জুমআ ছিল, যেন একেকটা ইদের দিন। জুমআর নামাজ পড়ানো শেষ করে যখন জায়নামাজ থেকে উঠতাম, তখন মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও নিবিড় আলিঙ্গনের সামনে সব কষ্ট একেবারেই ম্লান হয়ে যেত। কত লাইফ সাজার আসামি বলত, হুজুর, আপনাদের কষ্ট হলেও এই যে আমরা আপনাদের নেক নজর ও সোহবত পাচ্ছি, এটা আপনারা না এলে কী পেতাম! আপনারা তো সারাজীবন বাইরেই থাকবেন; কয়টা দিন না হয় অভাগাদের দিলেন। আল্লাহ আপনাদের পুষিয়ে দেবেন।

কারাগার ভিন্ন একটা জগত। যারা কারাগারে যায়নি, তারা কোনোদিনও এর হাকিকত বা মাহাত্ম্য বুঝবে না। রিমান্ড চলাকালে এক অফিসার যখন বলেছিল, আলিমরা যেহেতু জাতির কান্ডারি, তাই প্রত্যেক পাবলিক ফিগার আলিমের একবার হলেও কারাগারে কিছুদিন ঘুরে যাওয়া দরকার। ইতিহাসের সব বরেণ্য ব্যক্তিরাও এই ধাপ পাড়ি দিয়েই অমর হয়েছেন। কারাগারে না গেলে অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ হয় না, ভাবনার পরিসর প্রশস্ত হয় না। তখন এ কথার তাৎপর্য বুঝিনি। বিষয়টা আমার কাছে খানিকটা উপহাসই মনে হয়েছিল বটে। তবে সময় বাস্তবতার পর্দা উন্মোচিত করেছে। এখন দেখি আর ভাবি, বাইরের লোকগুলো কারাগারের ব্যাপারে কী ধারণাই না পোষণ করে! আবার কেউ কারাবন্দি হলে তার ব্যাপারেও কী জঘন্য মনোভাব লালন করে। একদিকে ভয় পেয়ে কারাবন্দিদের পাশে দাঁড়ায় না বা তাদের স্বজনদের সাহারা হয় না। আরেকদিকে কেউ কারামুক্ত হলে তাকে নিয়ে কত কানাঘুষা শুরু করে। বস্তুত মানুষ বড়ই জালিম ও নিতান্ত অজ্ঞ। এ কারণেই আরবিতে প্রবাদ আছে, ‘অভিজ্ঞকে জিজ্ঞেস করো; পণ্ডিতকে নয়।’