পার্বত্য চট্টগ্রামের কাঠ ও গাছের ডালের অ্যাম্বুলেন্স

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ১৯ ২০২০, ১৮:০৮

জিবলু রহমান

লিখলেও গালি খাওয়া, না লিখলে মানবিকতার সাথে উপহাস করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য সেবা যে করুণ তা উপলব্ধি করা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঁশের অ্যাম্বুলেন্সের চিত্রটি অবলোকন করলে। চিত্রটিতে দেখা যায় দুটি কাঠ ও গাছের বড়ো ডাল বেঁধে একজন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন দুইজন লোক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশের সব জেলার মতো নয়। সেখানে ঠিকমতো রাস্তা নেই, নৌকার রাস্তা পৌঁছানোর মতো সুযোগ নেই, পর্যাপ্ত চিকিৎসা কেন্দ্র নেই, সোজা কথা মানুষের অসুখ হলে ত্বরৎ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশের সরকারি কর্মকতারা ৬০০০ হাজার টাকার একটি বালিশেও ঘুমান।

নিকট অতীতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে যা টাকার অংকে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা এবং সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।

ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেংকারী, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রেস্ট জালিয়াতি, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি এবং ব্যাংকের ভল্ট থেকে সোনা জালিয়াতির নায়কেরা কিন্তু ঘুরেফিরেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিচরণ করে। এদের কালোহাত কখনো থামে না।

শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউর কেলেংকারীর তথ্যতো খুব বেশিদিন পুরানো নয়। রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোয় সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করতেন পাপিয়া। এসব হোটেলে প্রায়ই আসর জমাতেন তিনি। পাপিয়ার ‘ককটেল পার্টি’ নামে ওই নাচগানার আসরে মউজ মাস্তিতে মেতে ওঠতেন বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী, আমলা, প্রশাসনের বড়ো বড়ো ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদেরা। অর্থ ছড়াতেন লাগামহীণভাবে। ওই অশ্লীল নাচ-গানের ভিডিও করে রাখা হত সুকৌশলে। পরবর্তীতে ওই ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা হত প্রভাবশালীদের। এভাবে তাদের কাছ থেকে বড়ো বড়ো কাজ বাগিয়ে আনতেন পাপিয়া। তাহলে বুঝেল আমাদের দেশের সভ্যনামধারী কিছু মানুষ দুনীতির মাধ্যমে টাকা অর্জন না করলে কীভাবে পায়?

কয়েকবছর আগে সংবাদপত্রে এসেছিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ দুই হাজার টাকার বৈধ ঋণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ৬০ বছরের কৃষককে কোমড়ে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। অথচ ঋণের নামে ২ হাজার ৬শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লোপাট করে দিয়েও তানভীর আহমদরা প্রায় কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে হম্বি তম্বি করেন।

৯ মে ২০১২ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন অভিযোগ করে-সাভারের হেমায়েতপুরে জনতা হাউজিং আবাসিক এলাকায় হলমার্ক গ্রুপ অবৈধভাবে পুকুর, লেক ও চলাচলের রাস্তা দখল-ভরাট করে শিল্প কারখানা স্থাপন করছে। সাভারে জনতা হাউজিং’র মালিক আবদুল কবিরের সঙ্গে যোগসাজসে প্লটগ্রহীতাদের কয়েকশ’ বিঘা জমি জোর করে দখল করেছে হলমার্ক। প্লটগ্রহীতাদের জমি আব্দুল কবির নিজের বলে দেখিয়ে তা হলমার্ককে হস্তান্তর দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ হলমার্ক পদে পদে জালিয়াতি করেছে। এর বাইরে আরো জমি জবরদখল করেছে হলমার্ক। ঢাকার ছবি কার হাসি কে হাসে’র আদলে তাই প্রশ্ন ওঠে ‘কার জমি কে বন্ধক দেয়?’

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ফরিদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলায় আসামি করা হয় ঠিকাদার মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুল্লাহ আল মামুন, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মুন্সী ফররুখ আহমেদ, জাতীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. গণপতি বিশ্বাস শুভ, হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. মিনাক্ষী চাকমা এবং সাবেক প্যাথলজিস্ট ডা. এ এইচ এম নুরুল ইসলামকে। মামলাটি দায়ের করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আলোচিত পর্দা কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত তিন চিকিৎসক ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. গণপতি বিশ্বাস শুভ, হাসপাতালের সাবেক কনসালটেন্ট ডা. মিনাক্ষী চাকমা, হাসপাতালের সাবেক প্যাথলজিস্ট ডা. এ এইচ এম নুরুল ইসলামকে জামিন বাতিল করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’র দায়ের করা মামলায় ১২ জানুয়ারি ফরিদপুরের জেলা ও দায়রা জজ ১ম আদালতের বিচারক নুরুননাহারের আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন তারা। শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বিচারক।

২০ মার্চ ২০১৭ ছোট ঋণে বড় দুর্নীতি-শিরোনামের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল দৈনিক যুগান্তর। জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) গণহারে ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১১ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে ব্যাংকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ শাখা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে অনেক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানও ঋণ পেয়েছে। বর্তমানে শাখাটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৭৮ শতাংশই খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো নিয়ম অনুসরণ করেননি। উল্টো গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়াতি করা হয়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে শাখাটি হুমকিতে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিতোষণ নীতির কারণে বিডিবিএলের আজকের এ পরিণতি। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এর দায়ভার নিতে হবে। পাশাপাশি জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শেয়ারবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেংকারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতিসহ বিগত ১০ বছরে সরকারি ব্যাংকে যত কেলেংকারি হয়েছে, তার একটিরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। সে কারণে এসব অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

প্রধনমন্ত্রীর অফিস থেকেতো দেশের উন্নয়নের জন্য সবই নির্দেশনা দেওয়া হয়, মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত ও একনেকের বৈঠকে পাস হওয়া প্রজেক্টে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সংসদে জোর করে দাবি জানিয়ে আবারও বরাদ্দ বিশেষ বরাদ্দ আনা হয়। তারপরও এ অর্থগুলো যায় কোথায়?

আমার জানা মতে, পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রতিটি সরকারই বিশেষ পদক্ষেপ ও অর্থ বরাদ্দ করেছে এবং করে যাচ্ছে, তাহলে সেখানকার মানুষের বাঁশের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে হয় কেন? টাকাগুলো সঠিক জায়গায় ব্যবহার হয় না, ভাগবাটোয়ারা করে শেষ করে দেওয়া হয়। অজুহাত দেখানো হয়-টাকা বরাদ্দ হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা কাজ করতে দিচ্ছে না, বিশাল অংকের টাকা দিয়ে কাজ করতে হয় ইত্যাদি। আসলে এগুলো অজুহাত মাত্র। প্রবাদ আছে, বাঙালির তিন হাত-ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত।

আমাদের নৈতিকতা যতদিন ঠিক হবে না ততদিন দেশের উন্নয়নতো দূরের কথা, ব্যক্তিপর্যায়ই উন্নয়ন ঘটবে না। বড়ো বড়ো দুর্নীতির জন্য যারা দায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় না আনতে পারলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বাড়তেই থাকবে।