নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলায় বিশ্ববিকেক বাকরুদ্ধ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১৭ ২০১৯, ০৩:০৭

শান্ত ছবির মতো সুন্দর শহর ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘাতক ব্রেনটন হ্যারিসন ট্যারেন্টক জঙ্গীর নির্বিচার গুলি বর্ষণে ৪৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণহারীয়ে শহীদের রক্তে লাল হয় পবিত্র মসজিদ। এতে পুরো শহর যেন মনে হয় শোকের কালো স্কার্ফে ঢাকা। শোক প্রকাশের ভাষাও অনেকের জানা নেই। নীরবতাই যেন হয়ে উঠেছে সেই শোকের সর্বজনীন শহীদ স্বরণীয় অনুচ্চারিত কান্না।

শান্ত শহরের হঠাৎ এই বিপর্যয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন দেশের মানুষ। শোক প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তাঁরা। ঘাতকের ব্যাথা বোঝানোর ভাষা হারিয়ে সবাই হয়েগেছেন বাকরুদ্ধ। অধিক শোকে মানুষের হৃদয় হয়েগেছে পাথর। বিশেষ করে মুসলিম ভাই বোনের শোকের মাত্তমে চেহেরায় নেমে এসেছে কালো অন্ধকার, দেখলেই বোঝা যায় কতটা অসহায়।

মসজিদের যেখানে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি ঘটেছে তা থেকে অল্প কয়েক মিটার দূরে দেয়ালের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। একজন একজন করে সেখানে তাঁরা শহীদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছেন। শোকাহত মানুষের চোখে বিন্দু বিন্দু জল। বেশিরভাগ মানুষ সেখানে গিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে শহীদ স্বরণে।

তাঁদের মধ্যে একজন মার্ক ইসাক। তার বন্ধুও সেই মসজিদে হামলার শিকার। তবে প্রাণে বেঁচে গেলেও হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ইসাক বন্ধুকে এখনও দেখতে পারেননি। তাকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তবে বন্ধু যেখানে হামলা শিকার হয়েছেন সেখানে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন।

মার্ক ইসাক বলছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাই এখন আমরা অপেক্ষা করছি যে তার সাথে কি ঘটে। আমি অনুভব করছি আমার কিছু করার নেই কিন্তু এখানে এসে তাকে ভালোবাসার সুযোগ তো পাচ্ছি।’

দাউদ নামের একজন আফগান অধিবাসী মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমানো দাউদ সেখানকার একজন কমিউনিটি নেতা ছিলেন। তাঁর ছেলে ইয়ামা আল নবী সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোলাগুলির সময় আরেকজনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তিনি (আমার বাবা) প্রাণ হারিয়েছেন।

আল নুর মসজিদে হামলার খবর শুনে দ্রুত সেখানে ছুটে যান আল নবী। তবে তিনি দেরি করে ফেলেন। হামলাস্থলে পৌঁছানোর পর তাকে একজন এসে বলে, ‘তোমার বাবা আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। পরে তাঁর ভাই ওমর তাঁকে নিশ্চিত করেন এবং হামলাকারীর ধারণ করা ভিডিওতে তিনি তাঁর বাবার মৃত্যু দেখেছেন।

নিউজিল্যান্ডের হাজারো মানুষ শনিবার গণহত্যার শিকার ওই মসজিদ ও হামলাস্থলে যান। হামলার ঘটনায় নিহতদের বন্ধু ও পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন তাঁরা। আর যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে কিছু শিশু ছিল বলে জানা যায়।

অনেকেই হাসপাতালে যাচ্ছেন প্রিয়জনের খবর নেওয়ার জন্য। তাছাড়া এখনো অনেক ভাই বোন নিখোঁজ রয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে নিউজিল্যান্ডে আসা শরিফুল্লাহ নাজিব হাসপাতালের আশেপাশে তার এক বন্ধুকে দেখার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরও লিনউড মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ থাকায় যেতে পারেননি।

নাজিব গার্ডিয়ানের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা মানুষের অবস্থা দেখার জন্য এসেছি। আমরা অনেককে হারিয়েছি। আমাদের অনেক বন্ধুর নিহত হয়েছে এই হামলায়। আমরা জানি না কারা বেঁচে আছে আর কারা হাসপাতালে আছে। আমার তিনজন বন্ধু আছে ভেতরে। তারা বুলেটবিদ্ধ। আমরা এখন একটি স্কুলে যাচ্ছি যেখানে মরদহের তালিকা আছে।’

নিখোঁজদের মধ্যে তিন বছর বয়সের একটি শিশু আছে। শেষবার তাকে তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে আল নূর মসজিদে দেখা যায়। ১৪ বছর বয়সী আরও এক কিশোর নিখোঁজ। যার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ফুটবলার হবে। শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর পরিবার জানতে পারে যে সে আর নেই। আল নূর মসজিদে ঢোকার পর থেকেই নিখোঁজ, সে স্থানীয় ক্যাশমেরে স্কুলের ১০ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী ছিল।

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা কিশোরের বাবা বলছিলেন, ‘আমি আমার ছোট ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলেছি। তাঁর বয়স মাত্র ১৪ তে পড়েছে। আমি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মৃত্যুর খবর পাইনি। তবে সে যে আর নেই এটা আমার জানা হয়েছে গেছে।’ এমন কথা বলতে বলতে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেন নি শোকাহত পিতা।

তবে যারা ওই নৃশংস হামলা থেকে বেঁচে ফিরেছেন, তাদেরও হয়েছে ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা। আদিম সামি নামের ৫২ বছর বয়সী এক বাবা নাটকীয়ভাবে তার দুই ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। মসজিদে হামলাকারী যখন নির্বিচারে গুলি করা শুরু করেন তখন তিনি তার ২৯ ও ২৩ বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ আর আলির উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। তবে ঘাতকের বুলেটের আঘাত থেকে আর বাঁচতে পারেনি তিনি হয়ে যান শহীদ।

হামলায় বুলেটবিদ্ধ আদিব এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার মেয়ে বলছিলেন, ‘আমার বাবা একজন প্রকৃত নায়ক। তিনি আমার ভাইদের বাঁচাতে নিজের পিঠ বুলেটের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

এমন অসংখ্য ঘটনা আর প্রিয়জন হারানোর নির্মম গল্প তৈরি হয়েছে আল নূর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায়। কেউ ভাই হারিয়েছেন, কেউ সন্তান, কেউ বা বাবা। আবার অনেকেই স্বামী সন্তান সবই হারিয়েছেন। কট্টর খ্রিষ্টীয় ধর্মালম্বী অস্ট্রেলিয়ান ব্রেনটন হ্যারিসন ট্যারেন্টকের এই হামলা এবং সে সুস্পস্ট একজন সন্ত্রাসী। আর তার পেছনে যারা মদদ দিয়েছে তারা সবাই জঙ্গিবাদী।
ইসলামের নামে অপব্যাখ্যা করে যে সব মিডিয়া সন্ত্রাস কে প্রচার প্রসার করে তা থেকে বেরিয়ে এসে মানবতা রক্ষার স্বার্থে শান্তির পক্ষে কাজ করা প্রয়োজন।