নতুন একটি স্লোগান, একটি নতুন সকালের সূর্য

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ২০ ২০১৮, ১২:৪৬

রশীদ জামীলবড় জলদি তুষ্ট হয়ে যাওয়া একটি জাতি আমরা। আমরা মানে বাঙালি। বিগড়ে যেতেও সময় লাগে না। ইমোশনের স্টিয়ারিং পলকের সাথে ঘুরাতে পারি। হাইওয়ে ক্লিয়ার হলেও আলস্যে খোড়াতে পারি। চোখের সামনে পরিস্কার বর্গক্ষেত্র লেপ্টে থাকা সত্বেও জ্যামিতির জারি গাই__ ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি দুই সমকোন!

গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে কওমি সনদের স্বীকৃতি বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছে। বিলটি এখন বঙ্গভবনে যাবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরক্রমে সংসদ সচিবালয় থেকে গেজেট আকারে প্রকাশ হলেই আইনে পরিণত হবে। এর মাধ্যদিয়ে বাংলাদেশের কওমি প্রজন্মের সামনে এখন সম্ভাবনার দরোজাটি উন্মুক্ত হবে। আমরা এখন এটাকে কীভাবে কাজে লাগাব, কথাহল সেখানে। আমরা কি আমাদের সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব, যেটার কারণে আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলাম; সময়ই বলে দেবে। তবে, যথাযোগ্যতার ট্র্যাক যখন খুঁজে পাওয়া গেছে সুতরাং, আমরা আশাবাদী। তবে, ইমোশনকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে কাজ শেষ নয়, মাত্র শুরু হলো।

 ধন্যবাদ বার্তা
অনেকের মতো আমিও সন্দিহান ছিলাম। কওমি সনদের স্বীকৃতি নিয়ে শেখ হাসিনা নির্বাচিনী গেইম খেলেন কিনা। আগামী মেয়াদের জন্য বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখে দেন কিনা। কিন্তু সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিলটি পাশ করাহল। শেখ হাসিনা তাঁর কথা রাখলেন এবং আন্তরিকভাবেই রাখলেন। আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরামকে গণভবনে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়ে আলেমদের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করলেন তিনি। ধন্যবাদটা তাঁর অবশ্যই পাওনা।

বিলটি যখন জাতীয় সংসদে পাশ হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে হাসি ছিল। হাসিটিকে আমার কাছে কৃত্রিম মনে হয়নি। হাসিতে আন্তরিকতা ছিল। আত্মতৃপ্তি ছিল। মনে হয়েছে কাজটি করতে পেরে তিনি খুশি।

অনেকে বলছেন এবং হতেও পারে; আপকামিং ইলেকশনের ব্যাপার-সেপার তাঁর মাথায় ছিল। থাকতেই পারে। একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ তাঁর রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব মাথায় রেখেই চলবেন। সেটা আমাদের দেখবার বিষয় না। আমরা দেখব আমাদের অধিকার। আমরা দেখব আমাদের লাভ-ক্ষতি।

কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনা এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছেন। অস্বীকার করবার দরকার নাই। কিন্তু এই সুযোগ তো এর আগে তাদের সামনেও ছিল। কিন্তু তাঁরা যেখানে অনুকুল আবহাওয়া পেয়েও কাজটি করে যেতে পারেননি অথবা পারতে চাননি, সেখানে শেখ হাসিনা আপন স্রোতের বিপরিত দাঁড়িয়ে এবং বলতে গেলে একক সিদ্ধান্তে বিলটি তিনি পাশ করিয়ে দিলেন। এখানেই অন্যদের সাথে শেখ হাসিনার ব্যবধান।

টাল-বাহানা করবার সুযোগ ছিল। সুযোগগুলো আমরাই তৈরি করে দিয়েছিলাম। আমরা এক ব্যানারে জড়ো হতে পারিনি। আমরা অভিন্ন মতামত নিয়ে এককাতারে দাড়াতে পারিনি। তবুও তিনি কাজটি করে দিলেন। সিক্স ইন ওয়ান ফর্মুলায়।

সুতরাং, কোনো রকম যদি-কিন্তু ছাড়াই আমরাও তাকে কংগ্রাচুলেট করতে চাই। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি বাংলাদেশের তিনকোটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা পড়তে পেরেছেন। আপনি এখন অনেকদিন বেঁচে থাকবে। আমৃত্যু তো অবশ্যই। মরণের পরেও।

 বসন্তের পেঁচা
কেউ কেউ বলছেন… সুনির্দিষ্ট করে বলি। বিএনপি এবং জামাতের ভাইবন্ধুগণ বলছেন, আহারে কওমি হেফাজতি মুল্লারা! শাপলায় লাইট নিভাইয়া মাইর দিলো। সব ভুলে গেছে। এখন শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বীকৃতি নিচ্ছে আর তাকে মাথায় তুলে নাচছে..

যারা এমন গদগদ দরদি সেজে নিজেদের আত্মপীড়া ঢেকে রাখবার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, যখন লাইট নিভাইয়া মাইর দিলো, তখন তো আপনাদের আশেপাশে দেখা গেল না! তখন তো একফোটা সমবেদনা জানাতেও ছুটে আসলেন না। আজ যখন ডেকে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, তখন আপনাদের এতো জ্বলছে কেন?

কওমি প্রজন্ম শেখ হাসিনাকে মাথায় তুলে নাচছে না। নাচবেও না। তবে, এরা অকৃতজ্ঞ জাতি নয়। শুকরিয়া আদায় করতে দ্বিধা করে না।

 ভাববার বিষয় ছিল
গতকাল বিলটি পাশ হওয়ার আগে কৌতূহল নিয়ে সংসদের অধিবেশন দেখছিলাম। সংসদের রুলস অব প্রসিজিউর অনুযায়ী যে কোনো বিলের উপর যে কোনো সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন। স্পিকার সেগুলোকে আমলে নিতে পারেন, আবার বাতিলও করে দিতে পারেন।

কওমি সনদের বিলের উপরও অনেকগুলো সংশোধনী প্রস্তাব জমা হয়েছিল। কয়েকটির উপর আলোচনাও হয়। যদিও সবগুলো প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে রুল অনুযায়ী সংশোধনী প্রস্তাবকারী মাননীয় সংসদ সদস্যগণ নিজ নিজ বক্তব্য এবং যুক্তি তুলে ধরে দু’মিনিট করে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পান। কালও পেয়েছিলেন। শুনছিলাম সেগুলো। সবগুলো যুক্তিকে আমার কাছে অযৌক্তিকও মনে হয়নি। ভাবনার খোরাক ছিল। সেগুলো নিয়ে আরেকদিন কথাবলা যাবে।

ওয়েট এন্ড সী
বিলটি পাশ হওয়ার পর গতকাল সারাদিন ব্যাপারটি ছিল লক্ষনীয়। আমরা সেই আগের অবস্থানেই আছি। ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রল করছি। স্বীকৃতি আদায়ের মূল কৃতিত্ব অথবা দায় কার, কে কখন কোথায় কী ভূমিকা রেখেছিলাম, কাসুন্দি ঘাটছি। দরকার ছিল না। গ্লোবালাইজেশনের যুগ এখন। সকলের সবকিছু সবার সামনেই পরিষ্কার। সুতরাং সময়ই বলে দেবে কে কখন কতটা কী করেছিলেন। এত উতলা হয়ে যাচ্ছি কেন?

স্বীকৃতির কৃতিত্ব কার, কথা ঠিকাছে। কিন্তু ‘দায় কার’, কথাটি অনেকের কাছেই একটু কেমন লাগতে পারে। দায় বললে একটি নেতিবাচক অবস্থা সামনে ভাসে। তাহলে ‘দায়’র প্রশ্ন কোথা থেকে আসলো…
… এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নাই। কারণ, ভবিষ্যতে চলে যাওয়ার টাইম মেশিন এখনো আবিস্কৃত হয়নি। টাইম উইল সে; হোয়াট শ্যুড হ্যাভ ডান এন্ড হোয়াট শ্যুড নট হ্যাভ ডান। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো।

 নতুন স্লোগান
বেঁচে তো দুনিয়াতেই থাকতে হবে। তাহলে দুনিয়ার শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার তো মানে হয় না। রাব্বানা আতিনা’র পরে এবং আখেরাতের কল্যান কামনার আগে আল্লাহপাক কিন্তু দুনিয়ার কল্যান কামনা করার শিক্ষাই দিয়েছেন? রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনইয়া হাসানাহ, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাহ… তাহলে কেনো আমরা দাবি ওঠাতে পারব না; মাদরাসাগুলেতে জাগতিক শিক্ষা আরো গুরুত্ব পাক?

একটি দেশের কল্যানে ডেফিনেটলি যোগ্যতার বিকল্প নাই। কিন্তু যোগ্যতা থাকলেই হয় না। চুরি-চামারি-দুর্নীতি বন্ধ হয় না। সততার দরকার হয়। ধর্মীয় শিক্ষা এবং অনুশাসনই একজন মানুষকে সৎ থাকতে বাধ্য করে। তাহলে আমরা কেনো দাবি ওঠাতে পারব না; স্কুল-কলেজগুলোত ধর্মীয় শিক্ষা আরো দুরুত্ব পাক?
.
সুতরাং,
এখন আমাদের নতুন দিনের স্লোগান হোক এমন,
কওমি মাদরাসাগুলোয় পর্যাপ্ত জাগতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। স্কুল-কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। আওয়াজ দুটো এখন একসাথে ওঠা দরকার। পাশাপাশি থাকা উচিত। তবেই গড়ে ওঠবে সেই বাংলাদেশ, যার স্বপ্ন দেখেছিল সাড়ে সাতকোটি মানুষ; ঊণিশশ’ একাত্তরে।

-রশীদ জামীল, লেখক, প্রাবন্ধিক।