ধর্ম সাধনার প্রধান দুই পথ: গ্রেট ও লিটল ট্রাডিশন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১২ ২০১৯, ১৬:১২

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত:: ধর্ম সাধনার পথ সাধারণত মোটা দাগে দুটি। একটি হল ওহি বা দিব্য প্রত্যাদেশ নির্ভর কিতাবী বা শাস্ত্রীয় পথ বা টেক্সট বেজড মেথড। যেমন মুসলমানদের ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিস ভিত্তিক উলামা নিয়ন্ত্রিত পথ। আবার হিন্দুদের ক্ষেত্রে বেদ, উপনিষদ ও পুরাণ ভিত্তিক ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত পথ। এই পথটি সাধারণত নগরের শিক্ষিত অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নদের মধ্যে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এই পথকে মার্কিন নৃতাত্ত্বিক এর্নস্ট গেলনার গ্রেট ট্রাডিশন আখ্যা দিয়েছেন।
আর দ্বিতীয় যে পথটি প্রায় সব ধর্ম সাধনাতেই দেখা যায় সেটি হল মৌখিক পরম্পরা বা শ্রুতি বা ওরাল ট্রাডিশন ভিত্তিক পথ। এই ধারাটি সাধারণত গ্রামের অশিক্ষিত, নিরক্ষর ও নিম্নবর্গের মধ্যে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এই ধারায় তত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতি গুরু থেকে শিষ্য সরাসরি শিখে নেয় চর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে কোন কিতাব বা শাস্ত্রের মধ্যস্থতা থাকে না। এই ধারাটিকে এর্নস্ট গেলনার বলেছেন লিটল ট্রাডিশন। বিভিন্ন ধরণের নাথপন্থা, সহজিয়া মরমিয়া সাধনা থেকে শুরু করে বৈষ্ণব ও বাউল পন্থা হল হিন্দু-বৌদ্ধ ধারার লিটল ট্রাডিশনের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে বিভিন্ন সুফি তরিকার সিলসিলাকে আমরা ইসলামের লিটল ট্রাডিশন হিসেবে গণ্য করতে পারি।
নৃতাত্ত্বিক ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ ইসলামের এই গ্রেট ও লিটল ট্রাডিশন কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করেছে তা ইন্দোনেশিয়াকে কেস স্টাডি হিশেবে নিয়ে বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন। আমাদের অঞ্চলে অনুরূপ গবেষণা করেছেন অসীম রায় তাঁর ‘ইসলামিক সিনক্রেটিসটিক ট্রাডিশন ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে। রিচার্ড ইটনও তাঁর ‘দ্য রাইজ অফ ইসলাম ইন বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ গ্রন্থে এই গ্রেট ও লিটল ট্রাডিশন কিভাবে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় তার একটি তাত্ত্বিক কাঠামো হাজির করেছেন।
কথা হল এই গ্রেট ট্রাডিশন ও লিটল ট্রাডিশন — এই দুয়ের মাঝে ইতিহাস জুড়ে একধরণের টেনশন দেখা গেছে। এই টেনশন যেমন গ্রামীন ও নাগরিক মেজাজের পার্থক্যকে উপস্থাপন করে তেমনি এর মধ্যে বিধৃত রয়েছে দীর্ঘকালের শ্রেণীগত ও বর্গগত বিরোধ ও ভিন্নতা।
সভ্যতার মানে হল মানুষের ক্রমাগত উৎকর্ষ অর্জন। কাজেই মানুষ উন্নতির সোপান বেয়ে কৃষিভিত্তিক গ্রামীন সভ্যতা থেকে আধুনিককালে শিল্পভিত্তিক ও হালে সেবা ও তথ্য ভিত্তিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাই সভ্যতার অবধারিত যাত্রা। ঠিক তেমনিভাবে ধর্ম সাধনার ক্রমোন্নতির ধারা হল লিটল ট্রাডিশনের আওতায় যারা আজ আছেন তারা ক্রমাগত উন্নতির সোপান বেয়ে গ্রেট ট্রাডিশনে গিয়ে ঠিকঠাক একদিন পৌঁছে যাবেন। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং পথপরিক্রমা। এর ব্যত্যয় যারা ঘটাতে চান অর্থাৎ লিটল ট্রাডিশনকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে টেনে এনে গ্রেট ট্রাডিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান বা গুলিয়ে ফেলতে চান তারা সভ্যতা ও ধর্মসাধনার স্বাভাবিক বিকাশে অহেতুক গোলযোগ সৃষ্টিকারী ও সাংস্কৃতিক প্রগতির প্রতিবন্ধক বলেই বিবেচিত হবেন।
কাজেই লিটল ট্রাডিশনকে তার জায়গায় থাকতে দিন এবং গ্রেট ট্রাডিশন যেন নাগরিক শিক্ষিত সুধী সমাজকে অতিক্রম করে আরো আরো অনালোকিত গ্রামীন ও অনুন্নত সমাজকে ক্রমাগত আলোকিত করতে পারে সেই দিকে আমরা সবাই যেন নজর দেই।