দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট:

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ০৩ ২০২০, ০২:২৪

বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, হযরত মাও. হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর সহচর, মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ, গলমুকাপন দারুসসুন্নাহ মাদরাসা ও মোবারকপুর মহিউসসুন্নাহ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডা. মর্তুজা চৌধুরীর সংগ্রাম-মুখর জীবনের উপর তদীয় পুত্র মাও. যুবায়ের আহমদ চৌধুরী (রহ.) রচিত— ‘ডা. মর্তুজা চৌধুরীঃ জীবন ও সংগ্রাম’ গ্রন্থে গলমুকাপন মাদরাসা প্রতিষ্ঠালগ্নের ইতিহাস বিস্তৃত ভাবে আলোচিত হয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলোঃ

▪ গলমুকাপন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটঃ

ডা. মর্তুজা চৌধুরী ছিলেন অখন্ড ভারতের পক্ষে, পক্ষান্তরে গলমুকাপনবাসী ছিলেন খন্ড ভারত বা ভারত বিভাগের পক্ষে। এদিকে পার্শ্ববর্তী কিয়ামপুরবাসী ও ছিলেন অখন্ড ভারতের পক্ষে। বিধায় কিয়ামপুর ও গলমুকাপনবাসীদের মধ্যে প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দ্ব লেগে থাকতো।

ভারত বিভক্তির দু বৎসর পর, সাদীপুর ফেরীঘাটে গলমুকাপন নিবাসী বিশিষ্ট মুরব্বী জনাব আবদুল মান্নান সাহেবের সাথে হঠাৎ ডাক্তার সাহেবের দেখা হয়। মান্নান সাহেব ডাক্তার সাহেব কে চাচা বলে সম্বোধন করতেন। বললেন– চাচা, আপনি তো আমাদেরকে একেবারেই ভুলে গেলেন। আমাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেন না। আমাদের জামে মসজিদ ইমামশুন্য। দু’তিন মাসের বেশি ইমাম রাখা সম্ভব হয় না। আপনি যেভাবেই হোক আমাদের হেদায়ত ও মসজিদের দিকে খেয়াল করে আমাদের মসজিদে একজন ইমাম রাখার ব্যবস্থা করে দিন। জবাবে ডাক্তার সাহেব বললেন— আমি কিভাবে আসবো, তোমরা তো আমাকে দেখতেই পারো না! প্রতি উত্তরে মান্নান সাহেব বললেন, জী-না চাচা, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আসলে আপনিই সঠিক ছিলেন।
তখন ডাক্তার সাহেব বললেন, আগামী শুক্রবার তোমাদের মসজিদে আসবো।

কথামত ডাক্তার সাহেব নির্দিষ্ট দিনে গলমুকাপন পৌঁছে জনাব আবদুল মান্নান মিয়া ও মুনশি আফতাব উদ্দিন সাহেবকে সাথে করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে জুম্মার নামাজের দাওয়াত দিয়ে আসলেন।

নামাজ বাদ ডাক্তার সাহেব সমবেত মুসল্লিদের সামনে এক সংক্ষিপ্ত বয়ান পেশ করার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালেন। ঠিক তখনি অত্র গ্রামের বিশিষ্ট মুরব্বী জনাব ইসমাইল মিয়া বললেন, আপনার ওয়াজ শুনতে শুনতে আমাদের কান তালাবন্ধ হয়ে গেছে! উক্ত মুরব্বীর কথা শুনে ডাক্তার সাহেব বললেন আমি আগেই বলেছিলাম, আপনারা আমাকে পছন্দ করেন না। তখন ইসমাইল সাহেব বললেন, আসলে আমরা সবাই আপনাকে পছন্দ করি এবং আপনার সত্যতা আমরা খুঁজে পেয়েছি। যাইহোক, এখন যদি আপনি আমাদের মসজিদের মুতাওয়াল্লীর দায়ীত্ব নিতে পারেন তাহলে আমরা অত্যন্ত খুশি হবো। উত্তরে ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনারা যদি একটা মাদ্রাসার ওয়াদা দিতে পারেন, তাহলে আমি মসজিদের দায়ীত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। ডাক্তারের কথা শুনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এটা কীভাবে আমাদের দ্বারা সম্ভব! যেখানে গ্রামবাসী দুবেলা খেতে পারছি না, মসজিদ পরিচালনা করতে পারছি না, সেখানে আবার মাদ্রাসা!
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনারা তিনটা কাজ করতে পারলে মাদ্রাসা দেয়া খুব সহজ। সে তিনটা কাজ হলোঃ

১. সাপ্তাহে ঘরপ্রতি এক মুঠো চাল।
২. কেদার প্রতি এক সের ধান।
৩. বহিরাগত ছাত্রদের লজিং প্রদান।

ডাক্তার সাহেবের পরিকল্পনা শুনে সবাই বললেন, আমরা আপনার তিনটা শর্ত মেনে নিলাম। ডাক্তার বললেন আমিও মসজিদ এবং মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লীর দায়ীত্ব গ্রহণ করে নিলাম।
অতঃপর ১৯৫০ সালে গলমুকাপন মসজিদের বারান্দায়, হাফিজ মাহমুদুল হাসান (ওরফে অন্ধ হাফিজ) ও মুনশি আফতাব উদ্দিন সাহেবকে দিয়ে দারুসসুন্নাহ মাদ্রাসার প্রথম সবক শুরু হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে মাদ্রাসা ও মসজিদের কাজ চলতে থাকে। এর কিছুদিন পর মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেব কে, গহরপুর দেওয়ানবাড়ী মসজিদের ইমামতির দায়ীত্ব থেকে এনে মাদ্রাসার মুহতামীমের দায়ীত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডাক্তার সাহেব মসজিদের মুতাওয়াল্লীর দায়ীত্ব পালন করে যান।

© সূত্রঃ ডাঃ মর্তুজা চৌধুরীঃ জীবন ও সংগ্রাম। পৃষ্টা ৫৫-৫৬।