তারাবীর নামাজ কত রাকাত?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৪ ২০২০, ০৫:৩০

হুসাইন আহমদ মিসবাহ :

তারাবীর নামাজ কী? কত রাকাত পড়তে হবে? তানিয়েও আমাদের মাঝে কিছু মতানৈক্য আছে। আমরা আর কিছু করতে পারি বা নাই পারি, যেকোন বিষয়ে মতানৈক্য করতে বেশ পটু। অধিকাংশের মতে তারাবী ২০ রাকাত হলেও, কেউ বলেন তারাবী ৮ রাকাত। ১০ রাকাত, ১২ রাকাতের প্রবক্তাও আছেন। কেউ আবার বলেন, এই তারাবী রাসুল রা. এর সুন্নত নয় বরং এটা উমর রা. সুন্নত। তাই এই বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করতেই আজকের প্রয়াস।

তারাবী কি?

তারাবীহ’র নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ওয়াজিবের কাছাকাছি। গ্রহণযোগ্য অসুবিধা ব্যতিত ছাড়া যাবে না।

হযরত উবাই ইবনে কাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুল সা. পবিত্র রমজানে নিজে তারাবীহ’র নামাজ পড়িয়েছেন”।

হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুল সা. নিজে পবিত্র রমজানে ৩ দিন তারাবীহ’র নামাজ পড়িয়েছেন”। (তাবরানী, বায়হাকী, ইবনে খুজাইমা)

৩দিন পর ৪র্থ দিন যখন রাসুল সা. তারাবীহ’র সময় মসজিদে নববী জাননি, তখন হযরত আয়শা রা. রাসুল সা. কে বলেন, ” ইয়া রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কেরাম তারাবীহ’র নামাজ পড়তে মসজিদে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন! জবাবে রাসুল সা. বলেন, “হে আয়শা! যেভাবে সাহাবীরা তারাবীহতে আসছেন, আমার ভয় হচ্ছে, যদি আমি পুরো রমজান মাস এভাবে তারাবীহ পড়াই, তাহলে আল্লাহ ‘তারাবীহকে’ ফরজ করে দিতে পারেন, যা আমার উম্মতের জন্য কষ্ট হবে। তাই আমি আর তারাবীহ পড়াবোনা। আমি ছাড়াই তারা পড়ে নিক”।

তাই বুঝা গেল, রাসুল সা. এর জামানায় তারাবীহ ছিল। রাসুল সা. নিজে তারাবীহ পড়েছেন, পড়িয়েছন। আমাদের উপর ফরজ হওয়ার আশংকায় রাসুল সা. পুরো মাস তারাবীহ পড়ান নি, নতুবা পুরো মাসই পড়াতেন। এজন্যেই তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

 

তারাবীহ কত রাকাত?

হযরত উবাই ইবনে কাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন. “৩ দিন তারাবীর নামাজ পড়ানোর পর ৪র্থ দিন যখন নবীজী সা. আসেননি, সেদিন আমরা তারাবির নামাজ পড়েছি ২০ রাকাত”।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসুল সা. তারাবীহ কত রাকাত পড়তেন? এর জবাব পাওয়া যায় অন্য হাদীসে। রইসুল মুফাসসীরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ” আমি রাসুল সা. কে ২০ রাকাত তারাবীহ’র নামাজ পড়তে দেখেছি”। (মিশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাত, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং১১৯৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৫ম খন্ড পৃষ্ঠা নং ২২৫; হাদীস নং ৭৭৭৪)।

তাহলে বুঝা গেল, রাসুল সা. এর জামানায় তারাবীহ ২০ রাকাত ছিল।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে:

এবার দেখা যাক, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর জামানায় তারাবীহ কত রাকাত ছিল?

হযরত উমর রা. এর শাসনামলে, খলিফা উমর রা. হযরত উবাই ইবনে কাব রা. কে ইমাম বানিয়ে, নিজে উপস্থিত থেকে, সাহাবায়ে কেরাম রা. কে নিয়ে মসজিদে নববীতে ২০ রাকাত তারাবীহ’র নামাজ পড়েছেন। এবং মুসলিম বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারাবীহ হবে ২০ রাকাত। (বায়হাকী ২য় খন্ড, হাদীস নং ৪৯৬, তাবরানী হাদীস নং ৬১৫)।

জান্নাতি যুবকদের নেতা হযরত হাসান রা. বলেন, “হযরত উমর রা. এর শাসনামনে, মসজিদে নববী হযরত উবাই ইবনে কাব এর ইমামতিতে আমরা ২০ রাকাত তারাবীহ’র নামাজ পড়েছি। সে নামাজে উপস্থিত ছিলেন খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত উমর রা., হযরত উসমান রা., আব্বাজান হযরত আলী রা., সহ শীর্ষ সাহাবায়ে কেরাম। (সুনানে আবু দাউদ, ১মখন্ড, হাদীস নং ২০২)

যুক্তি:

এবার দেখা যাক আমাদের বিবেক বা যুক্তি কি বলে। ‘তারাবীহ’ শব্দটি বহু বচন, যার এক বচন “তারবীহাতুন”। আরবী “তারবিহাতুন” শব্দের বাংলা অর্থ ‘বিশ্রাম’। এর জন্যই তারাবীহ’র নামাজে প্রতি ৪ রাকাত পর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হয়। আর এটা সবারই জানা যে আরবীতে বহু বচন হতে হলে নুন্যতম ৩টি সংখ্যা লাগে। তাই তারাবীহ হতে হতে নুন্যতম ৩টি বিশ্রাম নিতে হবে। ৮ রাকাত, ১০ রাকাত বা ১২ রাকাতে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, ১ম ৪রাকাত পর একটি বিশ্রাম, ২য় ৪রাকাত পর আরেকটি বিশ্রাম এবং ৩য় ৪রাকাত পর আরেকটি বিশ্রাম নিয়ে পরের ৪রাকাত পড়লেই ১৬ রাকাত হয়ে যাবে। তাই যারা ৮ রাকাতের প্রবক্তা, তারা বিধানমতে এই নামাজকে ‘তারাবীহ’ বলতেই পারবেন না। তাদেরকে বলতে হবে ‘তারবিহাতুনের নামাজ’।

৮ রাকাতের উৎস:

এবার দেখা যাক ৮ রাকাতের উৎস কোথায়। যারা তারাবীহ ৮ রাকাত বলেন, আমাদের জানা মতে তারা একটি হাদীস বুঝতে ভুল করেছেন। আসুন হাদীসটি জানি। হাদীসটি বোখারী শরীফের ১ম খন্ড ১১৪৭ নং পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফের ১ম খন্ড ৭৩৮ নং পৃষ্ঠা, নাসাঈ শরীফের ১৬৯৭ নং হাদীস ও আবু দাউদ শরীফে ১৩৩৫ নং হাদীস হিসেবে বর্ণিত। হাদীসটি হল- “সাহাবায়ে কেরাম আম্মাজান হযরত আয়শা রা. কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, রাসুল সা. তারাবীহ কত রাকাত পড়তেন? জবাবে হযরত আয়শা রা. বলেছিলে যে, রাসুল সা. রমজানে ও রমজানের পরে অর্থাৎ সারা বছর রাতে ১১ রাকাত নামাজ পড়তেন।” হযরত আয়শা সাথে বলেছিলেন, “তোমরা জানতে চেওনা, রাসুল সা. এর নামাজ কেমন ছিল? তোমরা সে রকম পারবেনা। রাসুল সা. নামাজ এত লম্বা হত যে, দাড়িয়ে থাকতে থাকতে কখনো পা মোবারক ফুলে যেত। এত লম্বা সেজদা দিতেন, আমার কখনো আশংকা হত যে, রাসুল সা. এর ইন্তেকাল হয়ে গেল নাকি”?!

এই হাদীসের মাধ্যমে আম্মাজান আয়শা রা. রাসুল সা. এর তাহাজ্জুদের নামাজের বিবরণ দিয়েছেন। কারণ তারাবীহ নিয়ে প্রশ্ন করলেও হযরত আয়শা রাসুলের এমন নামাজের বিবরণ দিয়েছেন, যা রাসুল সা. রমজানে পড়তেন এবং রমজানের বাইরেও পড়তেন। আর রমজানের বাইতে কখনো তারাবীহ হয় না। তাই এই নামাজটি অবশ্যই তাহাজ্জুদই হবে। প্রায়ই রাসুল সা. ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ ও ৩ রাকাত বিতির পড়তেন। এই ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ ও ৩ রাকার বিতির মিলিয়েই ১১ রাকাত নামাজ পড়তেন।

সুতরাং যারা তারাবীহ ৮ রাকাত বলেন, তারা তাহাজ্জুদের সাথে তারাবীহকে তালগুল পাকিয়ে ফেলেন। তাই স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা যে, তারাবীহ এর নামার ২০ রাকাত। আপনি পড়বেন কি না সেটা আপনার বিষয়, কিন্তু দয়া করা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার তাওফিক দিন। আমীন।