ডিজিটাল মাদক:ফেসবুক!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ০৬ ২০১৮, ১১:৪৬

অরূপ। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। চুল বড় রাখায় লম্বাটে মুখটা ছোট হয়ে এসেছে। মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুখজুড়ে বসেছে। ঢাকার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে সে। তার সঙ্গে দেখা হয় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। মায়ের সঙ্গে এসেছে। কী সমস্যায় ভুগছে ও?

জানতে চাইলে মা জানান, সারাক্ষণ কেমন একঘরে হয়ে থাকে। স্কুল আর বাসা ছাড়া কোথাও বের হয় না। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খেলা বা ঘুরে বেড়ানোর বয়সে অরূপের এমন একাকিত্বকে অস্বাভাবিক আচরণ বলে মনে করছেন মা। তাই দারস্থ হয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের।

গল্পে গল্পে জানালেন, বছর তিনেক আগে তার মামা একটা মোবাইল ফোন গিফট করেছিলেন ভাগনেকে। ফোনটা হাতে পাওয়ার পর থেকে ওর মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়। আগে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় পছন্দ করলেও আস্তে আস্তে কেমন একা হয়ে যেতে থাকে। সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। একটা সময় চোখেও সমস্যা দেখা দেয়। ছয় মাস আগে চশমা দিয়েছেন চিকিৎসক।

মোবাইলে কী করে সারাক্ষণ? লুৎফুন্নাহার জানালেন, ফেসবুক। চ্যাটিং। এসব। তার ধারণা এই বয়সেই ছেলে তার মানসিক হতাশাজনিত সমস্যায় ভুগছে। ইদানীং ঘরে কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছে না। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। ঘুমাচ্ছে অনেক রাতে। সকালে উঠতে না পাড়ায় মাঝেমধ্যে স্কুলেও যেতে পারছে না। স্বাস্থ্যও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শরীরের চেয়ে ওর সমস্যা বেশি মনে। তারই পরামর্শে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে এনেছেন ছেলেকে।
ফেসবুকে কী এত ব্যস্ততা তোমার? অরূপ জানায়, ‘সবার সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালো লাগে।’
এই সবাই কারা?
‘অনেকেই তো আছে। ইয়াং বয়েজ গ্রুপ। স্কুল বয়েজ গ্রুপ। উই আর ফ্রেন্ডস গ্রুপ।’

কী কথা হয় এসব গ্রুপে?

‘এই তো, কে কী করছে। কে কি খেয়েছে? বিএফ/জিএফ- নিয়েও নানা গসিপ হয়। কেউ হ্যাংগ আউট করলে তা বলে। মজা হয়।’

গল্পের এক পর্যায়ে অরূপ জানায়, বেশিক্ষণ ফেসবুক থেকে দূরে থাকলে তার খারাপ লাগে। কেমন একা একা মনে হয়। ঘনিষ্ঠ ছেলে বা মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হলে হতাশা বোধ হয়। খারাপ লাগে।

অরূপের মতো এই বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে এখন এ ধরনের সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রতিটি পরিবারেই অরূপের মতো কাউকে না কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা ফেসবুক আসক্তিতে ভুগছে। এদের মধ্যে স্কুল-কলেজ পড়–য়াদের সংখ্যা বেশি। অ্যাকচুয়াল জগতের চেয়ে তারা ভার্চুয়াল জগতে বেশি জড়িয়ে গেছে। মনোবিদরা বলছেন, ফেসবুকের প্রতি অতি আসক্তি ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সুস্থ ও শারীরিক বিনোদন অর্থাৎ খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কম বয়সে মুটিয়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানান শারীরিক জটিল রোগব্যাধি।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ও বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকানের মতে, ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যত বেশি সময় কাটায়, সে তত বেশি হতাশায় ভোগে। একাকিত্ব, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও বিষণœতা তাকে পেয়ে বসে।
কদিন আগে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বললেন, ফেসবুক আসক্তি নেশা। এটি ‘ডিজিটাল কোকেন’ অ্যাডিকশনের মতো হয়ে গেছে। আজকাল ইয়ংগার জেনারেশন একবার ফেসবুকের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজেদের সৃজনশীলতা আরও বাড়াবে। নতুন নতুন বিষয় জানবে। বিশ^কে জানাবে। তা না করে এখন বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় হচ্ছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেখানে তাদের আলোচনা বা আড্ডার বিষয় মোটেও জ্ঞানার্জন নয়।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান বললেন সে কথাও, ‘এটা অনস্বীকার্য যে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। দুঃখের বিষয় হলো, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ঘাঁটায় (ব্রাউজ) প্র্যাকট্রিক্যালি ইয়ংগার জেনারেশন খুব একটা ক্রিয়েটিভ হচ্ছে না। আজকে আমি দেখেছি ইয়ংগার জেনারেশনের ভেতরে ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করে ফেসবুক চ্যাটিং করার জন্য। এটি কিন্তু ক্রিয়েটিভ ইউজ না।’

গত বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ আর কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান হুটস্যুইট-এর জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে যে সব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে আছে। ফেসবুকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই শহরে ফেসবুক ব্যবহার করে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ। তবে গোটা দেশে এই সংখ্যাটা আরও ২০ লাখ বেশি।

মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধও বাড়ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও ছড়াচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। এছাড়া বিভ্রান্তিকর, অসত্য ও বানোয়াট তথ্যনির্ভর প্রচারণার কারণে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতাও ঘটেছে সময় সময়।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ ফেসবুকে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, স্বাভাবিক জীবনাচরণ বদলে গেছে তাদের। সামাজিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের