জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১৯ ২০২০, ২২:৫৭

।। আবুল কাসেম আদিল ।।

জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মোটেই আকস্মিক ছিল না। সেসময় দেশে এমন সাংবিধানিক সংকট বিরাজমান ছিল, যা থেকে দেশকে মুক্ত করা অনিবার্য ছিল। জিয়ার সুযোগ হয়েছিল সেই অনিবার্য ভূমিকাটা পালন করবার। তাঁর ভূমিকাপালন সবাই মেনে নিয়েছেন, বরং বলা যায় আশা করেছিলেন— যেহেতু তিনি সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয় ছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিচিত ছিলেন।

এটা সত্য যে, কর্নেল তাহেরের কারণে জিয়াউর রহমান ৭ই নভেম্বর বন্দিত্বমুক্ত হন। জিয়াকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাহেরের অনুগত জাসদের অঙ্গসংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে এটাও সত্য যে, জিয়াকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে কর্নেল তাহেরের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। জিয়াকে মুক্ত করে তাঁর মাধ্যমে জাসদ-কল্পিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. সাখাওয়াত হোসেন যেমনটা লিখেছেন, তাহের চেয়েছিলেন জিয়া রেডিওতে গিয়ে সৈনিকদের দাবী দাওয়া এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভবিষ্যৎ রূপ রেখার ঘোষণা দেয়ার জন্য যা হবে সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের। [বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়] একই প্রসঙ্গে কর্নেল শাফায়াত জামিল লেখেন, আসলে, তাহের এবং তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দ জিয়াকে সামনে রেখে, জিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে সুচতুরভাবে ক্ষমতা দখলের প্রয়াস নেন ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ররক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রের নভেম্বর] কিন্তু জিয়া কেন পুতুলনাচের পুতুল হবেন, কেন তিনি তাহের-কর্তৃক ব্যবহৃত হবেন! বলাবাহুল্য যে, তাহের-ইনুরা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য যা করেছেন, সবই অগণতান্ত্রিক পন্থায়। গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমাতার মৌ-ভোগের সুযোগ পাবেন না জেনেই সহজ-সংক্ষিপ্ত পথে তাঁরা হেঁটেছেন।

বলা হয়ে থাকে জিয়া তাহেরের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন। বেঈমানিটা আবার কী! তাহলে তাহের আরো বড় বেঈমান। তিনি দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলে দেন। জিয়া মুক্ত হয়েই সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তাহেরের চক্রান্ত নস্যাৎ করেন। জিয়া তাহেরের সঙ্গে বেঈমানি না করে তাঁর হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে তা দেশের সঙ্গে বেঈমানি হতো। ব্যক্তির সঙ্গে বেঈমানির চেয়ে দেশের সঙ্গে বেঈমানি করা জঘন্যতর।

আচ্ছা, জিয়া যদি তাহেরের মনোবাঞ্ছা অনুযায়ী তাঁর হাতে ক্ষমতা তুলে দিতেন, তো কী হতো? এ ব্যাপারে তৎকালীন সেনাকর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, তাহেরের প্ল্যান যদি কার্যকর হত তবে রাতে এবং পরের কয়েকদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ ভেঙ্গে দিয়ে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা হত। তাহের সাধারণ সৈনিকদের দলে টানে বিভিন্ন দাবী দাওয়ার উছিলায় এবং অফিসারদের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবহারের অপপ্রচারের মাধ্যমে প্ল্যান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর স্ট্রাকচার শেষ করার পর বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপরও একই ধরনের হামলা হত। তাতে দেশ চলে যেত এক বিশৃঙ্খল অবস্থায়। অবশেষে বিপন্ন হত দেশেন সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা। [বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়]

জিয়াউর রহমান নিয়মতান্ত্রিক ও বৈধ সেনাপ্রধান ছিলেন। তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ জিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটান। অনুগত বাহিনী দিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দি করেন। ফলে জিয়ার মুক্তি ঈপ্সিতই ছিল। ৭ই নভেম্বর জিয়া ঈপ্সিত ও ন্যায়সঙ্গত মুক্তি লাভ করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বভার পুনঃগ্রহণ করেন। তবে জিয়ার জন্য দুর্ভাগ্য যে, ঈপ্সিত ও ন্যায়সঙ্গত মুক্তি লাভের জন্য তাঁকে এক অগণতান্ত্রিক উচ্চাভিলাষী অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তার সহযোগিতা নিতে হয়েছে। জিয়ার জীবনে এই কলঙ্কচিহ্নটুকু ইতিহাস-স্বীকৃত। তবে মূলত এই কলঙ্ক সামগ্রিক বিচারে কলঙ্ক নয়, কৃতিত্ব। কেউ তার অসদুদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আপনাকে ব্যবহার করতে চাইলে আপনি যদি সদুদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য উল্টো তাকে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে এটা আপনার কৃতিত্ব বলেই বিবেচিত হবে। জিয়াউর রহমান তা-ই করেছিলেন।

৭ই নভেম্বর অনেক সেনাকর্মকর্তা বিদ্রোহী সিপাহিদের হাতে নিহত হন। সেসব সিপাহি ছিল তাহের-পরিচালিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। আর তাহের সাধারণ সেনাদের মধ্যে অফিসারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দিয়েছিলেন। সেনাদের বিরুদ্ধে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অতএব বলা যায়, তাহেরই মূলত এসব অফিসারের নেপথ্য হন্তারক।

জিয়া পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন— নিন্দুকের এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য। সামনের দরজা বন্ধ থাকলে পেছনের দরজা ব্যবহার করা গেরস্থের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। জিয়া এমন এক সময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন, যখন ক্ষমতার সামনের দরজা ছিল বন্ধ। তখন দেশে কোনো বৈধ বেসামরিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এজন্য সেনাপ্রধানকে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। বলা যায় জিয়াউর রহমান তাঁর ইতিহাস-নির্ধারিত ও ইতিহাস-অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জিয়া যা করেছিলেন, যে কোনো দেশপ্রেমিক সেনাপ্রধানের জন্যই তা কর্তব্য ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমনটাই প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসে সেই বাকশালকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে দেশে তখন কোনো বৈধ রাজনৈতিক দলই অবশিষ্ট ছিল না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতার চাবিকাঠি হাতে নিয়ে দেশকে সাংবিধানিক সংকট থেকে মুক্ত করেন। পর্যায়ক্রমে সব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির সুযোগ দান করেন। এমনকি আজকের আওয়ামী লীগও জিয়াউর রহমানের বদান্যতার ফসল।

জিয়াউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের প্রতি কৃতজ্ঞতা, বীর উত্তম জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

কৃতজ্ঞ হও দেশবাসী, টলায়মান দেশের রক্ষাকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। কৃতজ্ঞ হও আওয়ামী লীগ, ত্রাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও; উদ্ধারকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও; ক্ষমতা ভোগ করছ যাঁর উসিলায়, সেই মহাত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হও!