জানাযায় বিশাল গণজমায়েত: মূল দায় রাষ্ট্রযন্ত্রের

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ১৮ ২০২০, ২১:০২

।। আরজু আহমাদ ।।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় বিশাল গণজমায়েত হয়েছে। অনেকেই এই কাজের নিন্দা করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে সমালোচনা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।

কিন্তু মন্দ ব্যাপার হচ্ছে, এই সমালোচনার সাথে সাথে ঘৃণাবাদের বিস্তারও চলছে সমানতালে- আঞ্চলিকতা ভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক ঘৃণাবাদ। ঘৃণাবাদের চর্চা কোনও কালেই শুভ কিছুর লক্ষণ নয়। বরং বড়ো ধরনের জাতীয় সঙ্কটের শুরু হয় এর থেকে।

এই যে দেশে নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে ঘৃণাবাদ ছড়ানো হয় এটা বস্তুত জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য বাঁধা এবং ক্ষতিকর। বড়ো কোনও সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা হয়ত তা অনুধাবন করতে সমর্থ হব না।

আর শ্রেণিভিত্তিক যে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, তা হলো উলামাদের বিরুদ্ধে। এই ঘৃণাবাদের চর্চা নতুন কিছু না। সমাজে উলামাবিদ্বেষ গড়ে তোলা হচ্ছে বহু আগ থেকেই। ফলে এধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা বহুগুণে চলবে এটা তো অকল্পনীয় কিছু নয়।

আদতে এই লোক উপস্থিতির সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনও সম্পর্ক নাই। বরং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় লোকদের মৃত্যুতে লোক জমায়েত নতুন ঘটনা না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরেও তা হয়। যদি তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার না হয়ে সিলেট বা ময়মনসিংহের হতেন তবুও এই জমায়েত হত।

বাস্তবতা হচ্ছে, এই জমায়েতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ শামিল হয়েছেন। আশেপাশের জেলা এমনকি গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে পুলিশ স্বীকার করেছে ঢাকা থেকেও বিপুলসংখ্যক লোক এতে জমায়েত হয়েছে।

ফলে এ ঘটনায় বাহ্মণবাড়িয়ার প্রতি এই ঘৃণার প্রকাশ সম্ভবত অন্য জায়গা থেকে উদ্ভূত। বাকি রইলো উলামাদের কথা। এই জমায়েতে শরিক হতে দেশের কোনও আলেম কি জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন? ফতোয়া দিয়েছেন, এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন?

এই লকডাউনের মধ্যেও এত সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হবে এটা তারা আন্দাজ কি করে করতে পারবেন? তাদের নিজস্ব ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি আছে?

মানুষকে তারা কি লাঠি নিয়ে গিয়ে জানাজায় অংশ নিতে বাঁধা দেবে? তাদের কমান্ডে কি কোনও শৃঙ্খলারক্ষক বাহিনী চলে? তাহলে এর দায় তাদের উপর চাপাচ্ছেন কেন? ফলে এই ঘৃণার চর্চাও আলাদা করে এই ঘটনার জন্য নয়। বরং এটাও পুরনো চর্চাই।

জানাজায় যারা এসেছে তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই এসেছে। এই জায়গাটাতে এসে এই প্রশ্ন তোলাই যায়। মানুষ কেন লকডানা না মেনে শামিল হলো। মানুষের সচেতনতার অভাব আছে এটা ঠিক।। এখানে শামিল হওয়াটা খারাপ হয়েছে।

কিন্তু এই জন্য আমরা স্রেফ সাধারণ জনগণের উপর দায় চাপিয়ে দিতে পারি না। মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে কেন? তার সুরক্ষার জন্য। এই যে আপনি আমি কর দিই। রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে আমাদের শাসন ও শাস্তির ক্ষমতা অর্পণ করি। কেন?

কারণ পৃথিবীতে শতভাগ শুদ্ধতার, সচেতনার সমাজ কোথাও পাওয়া যাবে না। মানুষকে ঠিক রাখতে। ভুল ও অন্যায় বন্ধ করতেই মানুষ রাষ্ট্র কায়েম করে নিজেকে রাষ্ট্রের কাছে সোপর্দ করেছে।

লকডাউন তো জনস্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি ব্যাপার। লকডাউন আপনি আমি যেমন ঘোষণা করতে পারি না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের করতে হয়। তেমনই সেটা ঘোষণার পর তা এনফোর্স করার দায়িত্বটাও প্রশাসনের।

এখন এই প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন, লকডাউন অমান্য করা বেআইনি। ওয়েল, মেনে নিলাম। এখানে যারা গেছেন তারা আইন অমান্য করেছেন। ফলত এটা একটা বেআইনি সমাবেশ।

আরও কয়েকধাপ এগিয়ে গিয়ে এটাও ধরে নিলাম এখানে যারা ছিলেন, তারা ক্রিমিনাল অফেন্স করেছেন। তাহলে এইরকম একটা বেআইনি মবকে মোকাবিলা করার দায়িত্বটা কার? অবশ্যই প্রশাসনের।

তারা কি ১৪৪ ধারা জারি করতে পারত না? সমাবেশ ঠেকাতে তারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিল? লকডাউন থাকার পরও রাস্তা কেন ব্লক করা হয় নাই। কেন সরাইলের কোথাও গতকালই ব্যারিকেড বসানো হয় নাই?

সংক্রামক ব্যাধি আইনে যানবাহন ভাইরাসের জন্য ঝুঁকি মনে হলে বাজেয়াপ্ত করার সুযোগ আছে। একটা গাড়িকেও কেন বাজেয়াপ্ত করা হলো না।

স্থানীয় ফোর্সে না কুলোলে প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করা যেত। এই সুযোগ আইনে রয়েছে। আশি কিলোমিটারের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট ছিল। অনেকেই বলেছেন, ভায়োলেন্স হত।

সেরকম কিছুর সম্ভাবনা ছিল না। এখানে কেউ মারমুখী ভঙ্গিতে সংঘবদ্ধভাবে বড়ো বড়ো দল পাকিয়ে আসে নাই। বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে। এই লোক স্রোত ঠেকিয়ে দেয়া কঠিন ছিল না।

আজকে এইরকম অরাজনৈতিক জটলা না হয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক প্রতিবাদ সমাবেশ হত। সেক্ষেত্রে কি এইরকমই লোক জমায়েত হতে পারত?সাম্প্রতিককালের অভিজ্ঞতা কি বলে?

ফলে এই সমাবেশ চাইলেই ঠেকিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা করা হয় নাই। পত্রিকায় প্রশাসনের বক্তব্য দেখলাম, তারা বলছে এত সংখ্যক লোকের উপস্থিতি তারা ‘ধারণা করতে পারে নাই’।

ইন্টিলিজেন্স তাহলে কেন আছে? জুবায়ের আহমদ আনসারী পাবলিক স্পিকার, সমস্ত বাংলাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় বক্তা। শুধু তাই নয়, খেলাফত মজলিসের মত প্রাচীন ও নিবন্ধিত সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি।

রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সহজাতভাবেই দীর্ঘদিনে রাজনৈতিক সহযোগীরা নানাপ্রান্ত থেকে এতে শামিল হবেন। এইসব থেকে লোক উপস্থিতির সম্ভাবনাকে আন্দাজ কি দুরূহ ছিল?

লকডাউন ভেঙে শেষকৃত্যে উপস্থিতি কি কেবল বাংলাদেশেই হচ্ছে? ব্রিটেনে এত কিছুর পরও প্রত্যেকদিনই এইরকম খবর দেখা যাচ্ছে। লেবার পার্টির এক এমপিকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের গণজমায়েতে শরিক হওয়ার দায়ে পুলিশের কাছে রীতিমতো মুচলেকা দিতে হয়েছে।

কেবল সাধারণ মানুষকে দোষারোপ না করে মূল জায়গায় তাকান। এই যে গার্মেন্টসের হাজার হাজার শ্রমিক পদব্রজে ঢাকা গেল, ফিরে আসলো। এই যে, ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করছে মানুষ।

বেতনের জন্য শ্রমিক রাস্তায় নামছে। টিসিবির গাড়িতে লাইনে মানুষ দাঁড়ায়ে থাকে শতশত। এই যে জানাজায় লোক জড়ো হতে পারে। এইসব কিছুর সমাধান রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছেই সন্নিহিত।

এইরকম বিভিন্ন ঘটনায় যাদের উপর প্রকৃত দায় বর্তায়- তাদের দিকে আঙুল না তুলে সাধারণ মানুষের উপর দায় চাপানোর যে সংস্কৃতি এ দেশে চালু হয়েছে এর ফলে শাসনযন্ত্রের কাছে জবাবদিহিতা চাইবার শেষ জায়গাটাও ক্রমশ ক্ষীণ করে দেওয়া হচ্ছে।

যা হোক, ফেসবুকে আমরা দ্বীনি মহল অনেক বেশি এপোলোজেটিক। যেন জাত গেল, জাত গেল বলে আমাদের উৎকণ্ঠা সবসময়। অনেকে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ইসলামোফোবিকদের হাতে ঘৃণা ছড়ানোর সুযোগ তুলে দেওয়া হলো।

আসলে যারা ঘৃণা ছড়ানোর, তারা ছড়াবেই। কারণ ছাড়াই ছড়াবে। কোনও যুক্তির অপেক্ষা তারা করে না। শত্রুতা বসতই ঘৃণার চর্চা করে। কোরআন এসব ব্যাপারে বলছে,

قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ ۚ

শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখ ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে আছে, তা আরো অনেকগুণ বেশি জঘন্য (আল ইমরান)