ঘরের আগুনই ঘরকে জ্বালায়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ২১ ২০১৮, ০৭:৫৯

তাওহীদ আদনান: কুরআন ও হাদীসের আয়াত ও বাণীর মাধ্যমে অকাট্যভাবেই সাব্যস্ত রয়েছে ওলামায়ে কেরামের মান ও ইজ্জত, শান ও শওকত৷ কুরআনের ঘোষণা ওলামায়ে কেরাম পরহেযগার৷ হাদীসের বাণী ওলামায়ে কেরাম নবীদের ওয়ারিস৷ অতি দামী দুটি কথা৷ জীবন প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হতে যথেষ্ট এতটুকুই৷ শরীয়ত প্রণেতাদের তরফ থেকেই এমন দামী কথা! আর কী চাই ওলামাদের?

ওলামায়ে কেরাম চির উন্নত শীর৷ সিংহের জাতি আমাদের ওলামায়ে কেরাম৷ জাতির গর্ব তারা৷ ধর্ম ও কর্মে অনুসরণীয় তারাই৷ সময়ে সময়ে তাদের বজ্র হুঙ্কারে কেঁপে উঠেছে বাতিলের ভীত৷ ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজ অবধি ছড়িয়ে আছে তাদের গর্বিত ইতিহাসের গৌরবমাথা সেই সব গল্প৷ তবুও আজ সমাজে অনুপস্থিত ওলামায়ে কেরামের ক্বদর৷ ওলামায়ে কেরাম আজ চরম অবহেলিত৷ সমাজে চরম অপদস্থ আজকের ওলামাগণ৷

এসবের কারণ তাহলে কী? কেনো এমন হয়? এমনটা কি হওয়ারই ছিলো, না এসব কিছুই আমাদের হাতের কামাই? এসবের মূলে রয়েছে, কী কারণ তা ভেবে দেখেছি কেউ? এটা ভাববার সময় কি হবে কভু আমাদের? আমরা পারবো কি এসব নিয়ে একটু ভেবে দেখতে? একটু সময় পাবো কি ভাবার? বিবেকবানদের বিবেকের দ্বার কি কভু উন্মুক্ত হবে? বিবেকের বদ্ধ দরজা উন্মোচন হওয়ার সময় কি কভু আসবে?

আমাদের আজকের এই করুণ পরিস্থিতি বা করুণ পরিণতির হতে পারে সম্ভাব্য বহু কারণ৷ খুঁজলে সম্ভাবনাময় বহু বিষয়ই বের করা সম্ভব৷ তবুও এর বাস্তব একটি কারণও তো আছে৷ বাস্তবধর্মী কোনো কারণ থেকে থাকলে তা অনুসন্ধানও করা চাই৷ নতুবা এমন পরিস্থিতি সামলে নেয়া হবে বহু কষ্টের ব্যাপার৷ হয়তো ভেবে দেখার সুযোগটা এখনো রয়েছে আমাদের, কিন্তু একটা সময়ে এসে আর নাও থাকতে পারে সে সুযোগ!

ওলামায়ে কেরামের এই অধঃপতনের বহু কারণ হতে পারে এটা আমি মানি৷ কিন্তু বহু কারণের মাঝেও থাকে একটি প্রধানতম কারণ৷ তাই আজ নির্ধিদ্বায় বলতে পারি এ ক্ষেত্রে সেই প্রধানতম কারণটি হলো, আমসমাজের সামনেই আমরা ওলামায়ে কেরাম একে অন্যকে লাঞ্ছিত করি, অপদস্থ করি৷ ভেতরের ত্রুটিগুলো উন্মুক্ত ময়দানে বর্ণনা করি৷ যে ত্রুটিগুলো আলেম হওয়ার সুবাধে সহমর্মিতা নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে সংশোধনের অভিপ্রায়ে অগোচরে বলা উচিত তা আজ জনসমাজে, মঞ্চে-ময়দানে গলা বাজিয়ে বলি৷ আহ…!

কোনো মাদরাসায় কোনো এক উস্তাদ শিক্ষকতা করেন, তারপর কোনো কারণবশত যদি তাকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হয় তো ব্যস, কেল্লাফতে৷ শুরু হয়ে যায় আমাদের অধিক থেকে অধিক ব্যস্ততা, তীব্র থেকে তীব্র প্রতিযোগিতা৷ না কোনো কাজের ব্যস্ততা ও প্রতিযোগিতা নয় বরং সেই মাদরাসা, মাদরাসার মুহতামিম, নায়েবে মুহতামি, নাযেম ও মাদরাসা কতৃপক্ষের কুৎসা রটনার ব্যস্ততা ও প্রতিযোগিতা৷ তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করে জনসমাজে বর্ণনার ব্যস্ততা ও প্রতিযোগিতা৷

কোনো ইমাম কোনো মসজিদে ইমামতি করেন, তারপর যদি কোনো কারণবশত তার পরিবর্তে অন্য ইমাম নিয়োগ দিয়ে দেয় মসজিদ কমিটি বা কতৃপক্ষ তখন আবার উল্টোচিত্র৷ মসজিদ কমিটির পিছু ছেড়ে আক্রমণ শুরু হয়ে যায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম বেচারার উপর৷ মসজিদ কমিটিকে ছেড়ে দোষ-ত্রুটি অন্বেষণে হন্য হয়ে পড়ি সেই নতুন ইমাম বেচারার পিছে৷ তাকে একহাত দেখে নিতে মরিয়া হয়ে যাই তখন মসজিদ কমিটিকে ছেড়ে৷

যখন কোনো স্বাধারণ ব্যক্তি আমাদের কোনো একজন আলেমের সমানে অন্য কোনো আলেমের প্রশংসা করে তো আমাদের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় তখন৷ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠি আমরা৷ ফোঁস করে ছোবলে ধরি তখন৷ এরপর একফালি বাদনামের ফুলঝুরি ছুটিয়ে কানখানা ভারী করে দেই সেই নিরীহ স্বাধারণ লোকটির৷ বেচারাও নিরুপায় হয়ে শুনে যায় আর ভরসাহীন হতে থাকে আমাদের প্রতি৷

কোনো একজন বক্তা সুন্দর বয়ান করে তো তার পিছে উঠে পড়ে লাগি৷ অন্য বক্তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় এই সুন্দর বয়ানের দরুন৷ বদহযম শুরু হয়ে যায় অন্য বক্তাদের৷ এরপর শুরু হয়ে যায় চুলচেরা বিশ্লেষণ সেই সুন্দর বয়ান করা বক্তার৷ কথার খৈ ফুটিয়ে এবার তাকে হেয় করতেই হবে এ মর্মে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিই মনে মনে৷ কিভাবে তার উপর কালিমা লেপন করা যায় সেই প্রচেষ্টায় হই আত্মহারা৷ আর নিজেরাই যখন নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করি, অস্তীত্ব বিলীনে তখন আর বেশি বেগ পেতে হয় না আমাদের৷ ফলে সহজেই আমরা হয়ে যাই সফল(!)

প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝেও মাথা উঁচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা একটি মজবুত গাছের ব্যাপারে এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হলো, তীব্র থেকে তীব্র গতির কোনো ঝড় তুফানও এর কোনো ক্ষতি করতে পারে না৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ছোট্ট একটি কুঠার তার অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়৷ এমনটা কেনো? তখন সেই ব্যক্তি বললো, সত্যিই বিষয়টা আশ্চর্যের৷ তবে আসল কথা হলো, ঐ কুঠারেরও কোনো সামর্থ ছিল না গাছটির অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলার৷ কিন্তু মূল বিষয় হলো, কুঠারটির হাতলই তো গাছের একটি আংশ বিশেষ৷ তাই সে খুব সহজেই বিলীন করে দিতে সক্ষম গাছটিকে৷

আমাদেরও একই দশা আজ৷ এক আলেম অপর আলেমের, এক ইমাম অপর ইমামের, এক মাদরাসা অপর মাদরাসার, এক মসজিদ অপর মসজিদের, এক প্রতিষ্ঠান অপর প্রতিষ্ঠানের, এক ইসলামী দল অপর ইসলামী দলের ত্রুটি বর্ণনায় কখনো ক্লান্ত হই না আমরা৷ আমাদের নিত্য দিনের জরুরি বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে যেনো অন্যের কুৎস রটনা৷ জেহেন ও দেমাগ সর্বদা সরব থাকে অন্যের উপর দাগ বসানোর চিন্তায়৷ সর্বদা আমরা বিভোর থাকি অন্যের আত্মমর্যাদা বিনষ্ট করার প্রয়াসে৷

ফলাফলে কী হয় তা ভাবি না কেউই৷ আমরা পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি করি আপরদিকে আমসমাজ থেকে আমাদের উভয় পক্ষেরই সম্মান ও মর্যাদা দূরিভূত হয়ে যায় নিমিষেই৷ জনসমাজে পরিশেষে যে নিজেদেরই মান ক্ষুন্ন হয় তা চিন্তায়ই আসে না আমাদের৷ দিনে শেষে আমরা উভয় পক্ষই জনগণের কাছে অপদস্থ ও অবহেলিত হয়ে বেঁচে থাকি তা করাঘাত করে না আমাদের বিবেকের দরজায়৷ ফলে আফসোস করে এখন বলতেই হয়, হায়! অবশেষে ঘরের আগুনই ঘরকে জ্বালায়…!

শিক্ষার্থী: নদওয়াতুল উলামা লাক্ষ্মৌ, ভারত