“কেবল একটা গানের কলি দিয়ে গণহারে সবাইকে মূল্যায়ন কোনোভাবেই সঠিক নয়”

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ০৬ ২০২৩, ০৪:৫৩

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া

কালেমার মর্ম অনেক ব্যাপক। কালেমার আবেদন ও চাহিদাও অনেক বিস্তৃত। এরই প্রেক্ষিতে সাহাবিদের কেউ কেউ সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে, শহীদও হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন নানা ইলমি, দাওয়াতি ও খেলাফতের নানা দায়িত্বে। এই সব-ই ছিল কালেমার ব্যাপক আবেদন পূরণার্থে।
*************************************************
কালেমার আবেদনেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল জালেমের তীব্র নির্যাতন-নিপীড়নের মাঝে শাহাদাত বরণ করেছেন; কালেমার আবেদন পূরণার্থেই ইমাম আবু হানিফা বিচাপতির পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন; কালেমার আবেদন পূরণ করতেই ইমাম আবু ইউসুফ জীবনের বড় একটা সময় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী অনেক আলেম ও বুজুর্গও সময়ের প্রেক্ষাপট ও চাহিদায় একেক সময় একেক পলিসি অবলম্বন করেছেন।
==========================================

মুসলিমদের ঈমান ও বিশ্বাসের মূল বিষয়ই হলো কালেমা; কালেমার মর্মই আমাদের সবকিছুর মূলমন্ত্র। এই কালেমা ও তার শাশ্বত মর্ম পৃথিবীর সকল মুসলমানের জন্য সমান। একই কালেমা কোনো মুসলিমকে সঠিক পথে চালিত করবে, আর কাউকে বিপথে— এমন কল্পনা করাও ভুল ও ভ্রষ্টতা। কালেমার কথা ও মর্ম সবার জন্য সমান; বৃহৎ অর্থে কালেমায় বিশ্বাসী সবাই-ই সঠিক পথে রয়েছে। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, জাহান্নামের আগুনে পুড়ে হলেও সকল কালেমায় বিশ্বাসী ও কালেমা পাঠকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে।

ইদানীং একজন বিতর্কিত ব্যক্তির দর্শনে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের কথিত সমর্থক শিল্পীর একটা গানের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এক কালেমায় রুটি-রুজি, আরেক কালেমায় ফাঁসি। শুনতে খুবই সুন্দর ও মনোহর, কিন্তু আদতে চরম বিভ্রান্তিকর একটা কথা, কালেমার অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা। এর মাধ্যমে সহজে একই কালেমার অনুসারীদের দুইটা ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। একদম সরল রেখার মতো করে। কিন্তু বিষয়টা কি এতই সরল?

প্রচলিত আছে, [সত্যতা আল্লাহ মালুম] সাইয়েদ কুতুব তার ফাঁসির সময় খুব আফসোস করে বলেছিলেন যে— এই কালেমার জন্যই আমার ফাঁসি হচ্ছে, আর তুমি আসছো আমাকে কালেমা পড়াতে! সেই কথার দিকে ইঙ্গিত করেই কেউ কেউ বলছেন— এক কালেমায় রুটি-রুজি, এক কালেমায় ফাঁসি। তারা বলতে ও বোঝাতে চাচ্ছেন— কালেমা তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে পারছে না; আমাদেরকে পারছে। কালেমার কারণে আমরা কষ্টবরণ করছি, জেল-জুলুম সহ্য করছি, ফাঁসির দড়িতেও ঝুলছি। তোমরা তো বেশ আরামেই আছো। আমরা সঠিক পথে আছি; তোমাদের পথ সঠিক নয়।

কথা হলো, তারা এইযে এতটা সরলভাবে একই কালেমার অনুসারী উম্মতের মাঝে একটা বিভক্তি তৈরি করলেন, বিভেদরেখা টেনে দিলেন, এটা কি ন্যায্য? কিংবা আদৌ কি এতটা সরলভাবে বিভেদরেখা টানা যায়? কেউ স্রেফ জেল-জুলুম খাটছে না বলেই কি তার কালেমা তাকে সঠিক পথ দেখাতে পারছে না? কালেমার সঠিক অনুসারী হওয়ার জন্য নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করা কবে থেকে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল?

হকের কথা বলতে গিয়ে, কালেমার বাণী উচ্চকিত করতে গিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য মহাপুরুষ কারাবারণ করেছেন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন। তাই বলে এটা বলা একদমই উচিত হবে না যে— এটাই হকের মানদণ্ড। হকের কথা বলতে গিয়ে যাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন এসেছে, কেবল তারাই সত্য; যারা শহীদ হয়েছেন, তারাই কেবল হক; অন্যরা না-হক।

ইসলামের শুরু থেকে অদ্যাবধি নিছক কালেমার জন্য যারা নির্যাতন নিপীড়ন সয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, শহীদ হয়েছেন— তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই। অবশ্যই অন্যদের চে তাদের মর্যাদা অনেক অনেক উর্ধ্বে। এক্ষেত্রে মর্যাদার মধ্যে তারতম্য স্বীকৃত। একজন মুজাহিদ ও সাধারণ মুসলমানের মাঝে অবশ্যই তফাৎ আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সকলেই নিছক কালেমার জন্য জেল-জুলুম বরণ করে না। সকলেই নিছক আল্লাহর বাণী উচ্চকিত করার জন্য আত্মত্যাগ করে না। প্রাচীনকাল থেকেই কালেমা ও ধর্মের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক পলিসি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল, ভিন্নমত ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর বোঝাপড়ার বিষয় ছিল। এখনো তাই আছে।

কালেমার মর্ম অনেক ব্যাপক। কালেমার আবেদন ও চাহিদাও অনেক বিস্তৃত। এরই প্রেক্ষিতে সাহাবিদের কেউ কেউ সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে, শহীদও হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন নানা ইলমি, দাওয়াতি ও খেলাফতের নানা দায়িত্বে। এই সব-ই ছিল কালেমার ব্যাপক আবেদন পূরণার্থে। সাহাবি পরবর্তী তাবেয়ি ও ইমামদের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। কালেমার আবেদনেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল জালেমের তীব্র নির্যাতন-নিপীড়নের মাঝে শাহাদাত বরণ করেছেন; কালেমার আবেদন পূরণার্থেই ইমাম আবু হানিফা বিচাপতির পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন; কালেমার আবেদন পূরণ করতেই ইমাম আবু ইউসুফ জীবনের বড় একটা সময় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী অনেক আলেম ও বুজুর্গও সময়ের প্রেক্ষাপট ও চাহিদায় একেক সময় একেক পলিসি অবলম্বন করেছেন। কালেমার ব্যাপক আবেদনের প্রেক্ষিতেই বিভিন্নজন নিজেদেরকে নানা কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। কেউ জঙ্গলে, বনে-বাদাড়ে, কেউ নগরের মসজিদ প্রাঙ্গণে, কেউ দাওয়াতের ময়দানে, কেউ দরস-তাদরিসের অঙ্গনে, কেউ হাদিসের মসনদে, কেউ জীর্ণ কুঠুরিতে, কেউ রাজপ্রাসাদে জালেম শাসকের সম্মুখে, কেউ যুদ্ধের ময়দানে।

বর্তমানেও আমরা অনেককে দেখেছি, শুধু কালেমার জন্য রক্ত দিতে। পাঁচই মের গভীর রাতে অনেকেই নিছক নবিপ্রেম ও কালেমার জন্য রক্ত দিয়েছেন। কোনো ধরনের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বার্থ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। পরবর্তী সময়েও অনেককেই দেখেছি বন্দি হতে, নির্যাতিত হতে, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে। সবই যে কালেমার জন্য ছিল, তা কিন্তু বলা যাবে না। ক্ষমতার পালাবদল, ক্ষমতার দ্বন্দ ও স্বার্থ, শাসকগোষ্ঠীর রোষাণলসহ আরো অনেক কিছুই থাকতে পারে। যে সকল ভাই কালেমার ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে ‘এক কালেমায় রুটি-রুজি, আরেক কালেমায় ফাঁসি’ আওড়িয়ে এর একটা অন্যায্য ফায়দা নিতে চাচ্ছেন, নিজেদেরকে একটু আলাদা, একটু ভিন্ন, একটু এলিট ইসলামিস্ট শ্রেণি ভাবতে চাচ্ছেন, তারা ঠিক করছেন না।

শুধু জুলুম-নির্যাতন সওয়া-না সওয়ার ভিত্তিতে এই সমীকরণ অনুচিত ও বে-ইনসাফি। কেবল একটা গানের কলি দিয়ে যেভাবে গণহারে সবাইকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, হক-বাতিল পরিমাপ করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সঠিক নয়। এ ধরনের ইমোশনাল বিষয় নিয়ে বিভক্তি ও বিতর্ক ভবিষ্যতের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।