কালের স্রোতে মহামারি —হুসাইন আহমদ মিসবাহ
একুশে জার্নাল ডটকম
মে ০৯ ২০২০, ২২:২৪
বিশ্বকে থমকে দেওয়া কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ২০১৯ খ্রীস্টাব্দের শেষপ্রান্তে চীনে ধরা পড়ে। সে সময় অনুমান করা যায়নি যে ‘করোনা’ নামের ভাইরাসটি পৃথিবীর উন্নত ও সুপার পাওয়ার দেশগুলির পায়ের নিচের মাটি নাড়িয়ে দেবে। ১২ মার্চ ২০২০ খ্রীস্টাব্দে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (Who) সেটাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা দেয়ার পরও পৃথিবীর অনেক দেশ এই ভাইরাসকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। Who তখন বলেছিল, “সাধারণ সর্দি-কাশির মতো উপসর্গ নিয়ে করোনা ভাইরাস মাত্র ৩ মাসের মধ্যে দুই শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ ছিনিয়ে নিতে পারে”। উন্নত প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যটি হজম করা সত্যিই কষ্টকর ছিল। অথচ ২ মাসও হয়নি, Who এর অনুমান বাস্তব রূপায়নের কাছাকাছি। বিশ্বের উন্নত দেশ ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, এই ভাইরাসে বিপর্যস্ত। সমগ্র পৃথিবী আতঙ্কিত। এই ভাইরাসের কাছে আজ গোটা দুনিয়া অসহায়। খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে দাম্ভিক দেশগুলোর অলিক দম্ভ। প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষে থাকা দেশগুলো স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, “আকাশের অধিবাসী ছাড়া এই ভাইরাস মোকাবেলা করার সাধ্য আর কারোর নেই”। এই ভয়ংকর “করোনা ভাইরাসে” বাংলাদেশসহ এই পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১৮৭টি দেশ। সারা বিশ্বে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩৯,৩৯,৩৪৮ জন, বাংলাদেশে ১৩,৭৭০ জন। এই পর্যন্ত ‘করোনায়’ মৃত্যুবরণ করেছেন ২,৭৪,৯৩৪ জন, বাংলাদেশে ২১৪ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১৩,৯৭,২৫২ জন, বাংলাদেশে ২,৪১৪ জন। আলহামদুলিল্লাহ! মৃত্যুর চে’য়ে সুস্ত্যতার পরিমাণ ১০গুণ বেশি। তাই আমাদের আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি সতর্ক ও সচেতন থাকার বিকল্পনেই।
পৃথিবীর ইতিহাসে ‘করোনা ভাইরাস’ নামক এই মহামারি নতুন নয়। যখনি পৃথিবীর অধিবাসীরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে যায়, নাফরমানী বা অবাধ্যতা করে, তখনি মানুষের উপর নেমে আসে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পবিত্র কুরআনের ভাষায় “জলে-স্থলে যত বিপর্যয় আসে, সবই মানুষের কর্মফল”। জনসচেতনতা লক্ষ্যে পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ কয়েকটি মহামারির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।
১। প্রাগৈতিহাসিক কালের মহামারি :-
খৃষ্টপূর্ব আনুমানিক ৩০০০ বছর পূর্বে প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনের এক প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম মহামারিতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। সেই মহামারিতে ঐ এলাকার আক্রান্ত মানুষদের মৃতদেহ একটা বাড়ির মধ্যে স্তুপ করে রেখে পরে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। এরমধ্যে শিশু-কিশোর-তররুণ-বৃদ্ধ সকলের কংকালই পাওয়া গেছে। চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এই সযত্নে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্বিক এলাকাটির নাম ‘হামিন মান্ঘা’ (Hamin Mangha)। প্রত্নতাত্বিক এবং নৃতাত্বিক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, এতো দ্রুত এবং ভয়ঙ্কর ভাবে এই মহামারিটি সংঘটিত হয়েছিলো যে, মৃতব্যক্তিদের যথাযথ সৎকারের সময়ও পাওয়া যায়নি। এলাকাটিকে পরবর্তী কালে আর বসবাসযোগ্যও করা হয়নি। ‘হামিন মান্ঘা’ আবিস্কৃত হওয়ার আগে, চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ‘মিয়াওজিজৌ’ (Miaozigou) নামের প্রায় একই সময়ের আরেকটি প্রাগৈতিহাসিক গণকবর খুঁজে পাওয়া যায়। এই দুটো গণকবর আবিস্কার থেকে ধারণা করা হয় যে, একই সংক্রামক মারণব্যাধি দ্বারা সংঘটিত মহামারিতে একই সময়ে ওই এলাকাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো।
২। এথেন্সের প্লেগ :-
প্রাচীন এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই এথেন্স এক মহামারির কবলে পড়ে। এটা আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৪৩০ বছর আগের কথা। এথেন্সের নিকটবর্তী বন্দর নগরী পিরাইয়ুস ছিল খাদ্য এবং অন্যান্য রসদ আনার একমাত্র পথ। এই পথেই প্লেগের আগমন ঘটেছিলো বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিকের মতে, এই মারণব্যাধি ইথিওপিয়া থেকে মিসর ও লিবিয়া হয়ে গ্রীসে প্রবেশ করে এবং বিস্তৃত ভূমধ্যসাগর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ নতুন এই রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদেরও কোনো ধারণা ছিল না। ফলে রোগীর দ্বারা সংক্রমিত হয়ে অনেক চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেন। ঘনবসতিপূর্ণ এথেন্সের প্রায় ২৫ভাগ অধিবাসী আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এথেন্সের নেতা, বীর পেরিক্লিসও এই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চারিদিকে কেবলই দাহকার্যের আগুন চোখে পড়ায় রোগাক্রান্ত শত্রুর সংস্পর্শের ঝুঁকি থেকে বাঁচার জন্য স্পার্টানরা কিছুকাল নিজেদেরকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে রাখে। প্রায় ৫ বছর স্থায়ী এই মহামারিতে আনুমানিক ৭৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো। এই মহামারির লক্ষণ ছিল- আকস্মিক ভাবে মাথা অত্যন্ত গরম হয়ে যাওয়া, চোখ রক্তবর্ণ হওয়া এবং প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকা। এছাড়া, শরীরের ভেতর দিকের কিছু অংশে, যেমন গলার ভেতর বা জিহ্বা রক্তবর্ণ হওয়া এবং অস্বাভাবিক ও দুর্গন্ধময় শ্বাস-প্রশ্বাস হতে থাকা।
৩। আন্তোনাইন প্লেগ :-
১৬৫-১৮০ খৃষ্টাব্দে সৈনিকরা পশ্চিম-এশিয়া, তুরস্ক, মিশর অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রোম সাম্রাজ্যে এই মহামারিটি বহন করে এনেছিলো বলে ধারণা করা হয়। গ্রীক চিকিৎসক ‘গ্যালেন’ তখন রোমে বাস করছিলেন এবং তিনিই এটার বিবরণ দিয়েছিলেন বলে তার নামেও এই মহামারি ‘প্লেগ অব গ্যালেন’ হিসেবে চিহ্নিত। যদিও প্রকৃত তথ্য এখনো অনাবিস্কৃত বলেই ধরে নেয়া হয়, তবু গবেষকরা একে জলবসন্ত বা হাম বলেও অনুমান করেন। মনে করা হয় যে, রোমান সম্রাট ‘লুসিয়াস ভেরু’ ১৬৯ খৃষ্টাব্দে এই রোগে মারা যাওয়ার ৯ বছর পর এই মহামারি পুনরায় দেখা দেয়। তখন রোমে একদিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার পর্যন্ত মানুষ মারা গিয়েছিল। সব মিলিয়ে এই মহামারি প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো এলাকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়।
৪। সাইপ্রিয়ানের প্লেগ :-
মোটামুটি ২৪৯ থেকে ২৬২ খৃষ্টাব্দে সংঘটিত এই মহামারি কালে রোমান সাম্রাজ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলো। ধারণা করা হয় যে, এই প্লেগে মৃত্যুর ফলে খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছিলো। তিউনিসিয়ার কার্থেজ নগরীর বিশপ ‘সেইন্ট সাইপ্রিয়ান’র নামে এই মহামারির নামকরণ হয়েছে ‘সাইপ্রিয়ানের প্লেগ’। তিনি এই মহামারির প্রত্যক্ষদর্শী এবং এর বিবরণ রেখে গেছেন। মহামারির ভয়াবহতা দেখে তিনি বলেছিলেন- “এই প্লেগে পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে”। জানা যায়, কেবল রোমেই নাকি একদিনে ৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও ঠিক কোন রোগ থেকে এই মহামারি ঘটেছিলো, তা এখনো নিশ্চিত ভাবে আবিস্কৃত হয়নি; তবে গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে, এর লক্ষণগুলির মধ্যে ছিলো জলবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ইবোলা ভাইরাসের মতো প্রচণ্ড ক্ষতিকারক জ্বর। তাছাড়া লাগাতার ডায়রিয়া এবং ভেতরে এক ধরনের দহন সৃষ্টি হয়ে মুখের ভেতর ক্ষত তৈরি হতো। খুব সম্প্রতি, ২০১৪ সালে, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই প্লেগের শিকার মানুষদের এক বিশাল গণকবর আবিস্কার করেছেন।
৫। জাস্টিনিয়ানের প্লেগ :-
বাইজেন্টাইন সম্রাট ‘জাস্টিনিয়ান’ এর আমলে ৫৪১-৫৪২ খ্রী এই প্লেগের শুরু। তাঁর সময়েই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ বিস্তার লাভ করে। রাজধানী কনস্টানটিনোপলে (বর্তমান ইস্টত্মান্বুল) জাস্টিনিয়ান ‘হাজিয়া সোফিয়া’ নামের সুবিশাল ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করেন। জাস্টিনিয়ান নিজেও প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন; যদিও তিনি আরোগ্যলাভ করেন। তার নামেই এই মহামারির নামকরণ হয়েছে। এই মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য খর্ব হতে থাকে। বলা হয়, এই প্লেগ দিয়ে বাইজেন্টিয়াম সভ্যতার ধ্বংসের শুরু। এই প্লেগ শতাব্দি জুড়ে বারে বারে ফিরে এসেছিল। কোনো কোনো হিসেবে পৃথিবীর প্রায় ১০ ভাগ মানুষ এই মহামারিতে মৃত্যুবরণ করে।
৬। কৃষ্ণমৃত্যু :-
১৩৪৬-১৩৫৩ খ্রীস্টাব্দে এই মহামারি আঘাত হানে। ১৩৪৭-এর অক্টোবর মাসে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির মেসিনা প্রদেশের সিসিলিয়ান বন্দরে ভিড়লো ১২টি জাহাজ। বন্দরে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে দেখলো জাহাজের নাবিকেরা প্রায় সকলেই মৃত। যারা তখনো জীবিত আছে, তাদের শরীরে কালো কালো ফোঁড়া। তা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত আর পুঁজ। সিসিলি কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে জাহাজগুলিকে বন্দরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলো। কিন্তু ততক্ষণে যা বিলম্ব হওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো হিসেবে এই বৈশ্বিক মহামারি চতুর্দশ শতকে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক (আনুমানিক ২ কোটি) জনসংখ্যাই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। “যারসিনিয়া পেস্টিস” নামের এক ব্যাকটেরিয়া ছিল এর মূলে- যা এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলেই গবেষকদের ধারণা। এই ব্যাকটেরিয়া ইঁদুরের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল। মৃতদের স্থান হয়েছিলো গণকবরে। প্রায় ৪ শতাব্দী ধরে ফিরে ফিরে আসা কৃষ্ণমৃত্যুর এই দীর্ঘ পর্যায় ইউরোপের ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। এই বিপুল মৃত্যুর পর কাজের জন্য শ্রমিক পাওয়া দুর্লভ হয়ে উঠেছিল। ফলাফল হিসেবে শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বৃদ্ধি পায় এবং সম্ভবত কারিগরী আবিস্কারের প্রণোদনাও তৈরি হয়।
৭। গুটিবসন্ত :-
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম থেকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু। বিংশ শতাব্দীতে গুটিবসন্তে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগে গুটিবসন্তে মৃত্যুহার ছিল ৩০ শতাংশ, যদিও এর অধিকাংশ উপাদান ছিল প্রাণঘাতী। তবে এ রোগ আয়ত্তে আসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেয়।
৮। কোকোলিজৎলি মহামারি :-
১৫৪৫-১৫৪৮ খ্রীস্টাব্দে মেপিকো এবং মধ্য আমেরিকার ১.৫ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো এই মহামারিতে। এটা ছিল এক ধরনের হেমোরেজিক ফিভার। এমনিতেই মহামারির আগে থেকেই এই অঞ্চলে চূড়ান্ত দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ ছিল বিপর্যস্ত; তার ওপর এই রোগ একেবারে ধ্বংস ডেকে আনে। এই মহামারির শিকার মৃতমানুষের ডি এন এ পরীক্ষা করে খুব সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে যে, Salmonella নামের এক ব্যাকটেরিয়ার উপগোত্র Salmonella paratyphi C থেকে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছিলো। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা বা টাইফয়েড, জলশুন্যতা বা ডিহাইড্রেশন এবং পেটের পীড়া অন্তর্ভুক্ত।
৯। আমেরিকান প্লেগ :-
ষোড়শ শতাব্দি। ইনকা এবং এ্যাজটেক সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে এই মহামারির গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে বলে ধারণা করা হয়। ইউরোপ থেকেই জলবন্তসহ একগুচ্ছ মারণরোগের আমেরিকায় অভিযান ঘটেছিলো এই মহামারিকালে। কোনো কোনো হিসেবে বলা হয় যে, পশ্চিম গোলার্ধের প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী এতে নিশ্চিহ্ন হয়। ১৫১৯ এবং ১৫৩২ সালে দুই
দফায় স্পেনীয় সেনা অভিযানের মাধ্যমে যথাক্রমে এ্যাজটেক এবং ইনকা সাম্রাজ্য বেদখল হয়। এই দুই যুদ্ধেই এ্যাজটেক এবং ইনকা সৈন্যবাহিনী পরাভূত হয় মূলত মারণরোগে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে পরবর্তীতে বৃটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডের অধিবাসীদের এসব এলাকায় বসত গড়ে তোলা সহজ হয়।
১০। লন্ডনের বৃহৎ প্লেগ :-
কৃষ্ণমৃত্যুর শেষ ধাক্কায় রাজা দ্বিতীয় চার্লসের নেতৃত্বে বিশাল সংখ্যক মানুষ লন্ডন থেকে অভিবাসনে চলে গিয়েছিলো। ১৬৬৫ সালের এপ্রিলে যে প্লেগ শুরু হয়েছিলো, তার সংক্রমণ ঘটানোর পেছনে প্লেগ-আক্রান্ত ইঁদুরেরই ভূমিকা ছিল প্রধান। বছর খানেকের মধ্যেই লন্ডনের ১৫ ভাগ অধিবাসীসহ মোট প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
১১। মার্সাইয়ের বৃহৎ প্লেগ :-
১৭২০-১৭২৩ খ্রীস্টাব্দ। পূর্ব-ভূমধ্যসাগর থেকে গ্র্যান্ড সেইন্ট আন্তোয়েন নামের এক পণ্যবাহী জাহাজ ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় এই ভয়াবহ প্লেগ। যদিও জাহাজটিকে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছিলো, কিন্তু তারমধ্যেই ইঁদুরবাহিত প্লেগ শহরে ঢুকে পড়ে। এই প্লেগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং পরের তিন বছরে মার্সাইয়ে এবং আশেপাশের এলাকার প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
১২। রাশিয়ার প্লেগ :-
১৭৭০-১৭৭২ খ্রীস্টাব্দ। রাশিয়ার এই মহামারির সময় খুব ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। প্লেগ-জর্জরিত মস্কোয় কোয়ারেন্টাইনে রাখা অধিবাসীরা প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা শুরু করে। শহরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কেউ কোনো নির্দেশ মান্য করছিল না। পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে ওঠে যে, “আর্চবিশপ এ্যামব্রোসিয়াস” যখন প্রার্থনার জন্য সমাবেশ করতে নিররুৎসাহিত করলেন, তখন উন্মত্ত জনতা তাকে হত্যা করে। রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথেরিন (ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট) জনশৃংখলা ফিরিয়ে আনা ও প্লেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া হয়ে আদেশ জারি করলেন যে “সব কারখানা মস্কো থেকে সরিয়ে নিতে হবে”। এই মহামারিতেও প্রায় ১ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিলো।
১৩। ফিলাডেলফিয়ার হরিদ্রা জ্বর :-
১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় যখন হরিদ্রা জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভ্রান্তিবশত বিশ্বাস করেছিলো যে, দাসদের এই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। ফলে, অসুস্থদের সেবার জন্য নার্স হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিলো আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষদের। এই রোগ মশাবাহিত এবং তার দ্বারাই সংক্রামিত। সে বছরে গরমকালের আবহাওয়ায় ফিলাডেলফিয়ায় যেন মশার চূড়ান্ত প্রজনন ঘটেছিলো। শীতের আগমনে মশাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এই মহামারি অব্যাহত ছিল। তখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
১৪। কলেরা :-
১৮০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে মহামারি আকারে কলেরা শুরু হয়। বলার কথা হলো, কলেরা মহামারিটি প্রথম শুরু হয়েছিল আমাদের বাংলা অঞ্চলে। এ অঞ্চলে এ রোগকে ‘ওলা ওঠা’ নামে ডাকা হতো। কলেরায় এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখনো প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ এই রোগে প্রাণ হারায়। চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭ সালে ইয়েমেনে এক সপ্তাহে কলেরায় অন্তত ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। মুলত আগে আমাদের স্যানিটেশন ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা, যার ফলেই এই রোগ মহামারি আকার ধারণ করতো। আসতে আসতে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এই পানিবাহিত রোগ প্রায় নিশ্চহ্ন হয়ে গেছে।
১৫। বৈশ্বিক মহামারি ফ্লু :-
১৮৮৯-১৮৯০ খ্রীস্টাব্দ। এই ফ্লু’তে প্রথম আক্রান্তের খবর পাওয়া যায় রাশিয়ায়। সেন্ট পিটার্সবার্গে অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো এই ভাইরাস। যদিও পৃথিবীতে তখন পর্যন্ত আকাশপথে যাতায়াত শুরু হয়নি, তবু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ইউরোপ এবং সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এই ফ্লু। ৫ সপ্তাহের মধ্যে মহামারিটি চূড়ান্ত রূপ নেয়। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো এই মহামারিতে
১৬। আমেরিকান পোলিও :-
আজকাল সকল শিশুকে পোলিওর টিকা খাওয়ানো বাধ্যতামূলক করা হলেও ১০০ বছর আগে এটি ছিল এক ভয়াবহ ব্যাধি যার কোনো ভ্যাকসিন ছিল না। পোলিও মুলত শিশুদেরই হয় এবং কখনো কখনো শিশুর শরীরে স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা রেখে যায়। ১৯১৬ সালে নিউইয়র্কে ২৭ হাজার শিশু পোলিও আক্রান্ত হয় এবং সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৬ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে। ১৯৫৪ সালে সাল্ক ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝে মাঝেই এই রোগ দেখা যেতো। যদিও পোলিও এখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি, তবে ভ্যাকসিন আবিস্কারের পর থেকে পৃথিবীতে এই রোগের হার একেবারেই কমে গেছে।
১৭। স্প্যানিশ ফ্লু :-
১৯১৮-১৯২০ খ্রীস্টাব্দ। স্প্যানিশ ফ্লু’কে ভয়াবহতম বৈশ্বিক মহামারি বলা হয়। দক্ষিণ সাগর থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত প্রায় ৫০ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুর শিকার হয়েছিলো। এরমধ্যে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৫ কোটি। অনেক সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে চলে যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সুস্থ কিংবা দুর্বল সকলেই এই ফ্লুর শিকার হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে এই মহামারির সূচনা। সৈনিকেরা নিজ দেশে ফিরে আসার পরই দ্রুত শহর-গ্রাম-জনপদে ছড়িয়ে পড়ে এই ফ্লু। এই ফ্লু’র সঙ্গে স্পেনের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম মহাযুদ্ধে স্পেন ছিল নিরপেক্ষ অবস্থায়। তাদের সংবাদমাধ্যম ছিল স্বাধীন। যুদ্ধকালীন সংবাদ তারা নিরপেক্ষ ভাবেই প্রকাশ করতো। তারাই প্রথম এই ফ্লুর সংবাদ পরিবেশন করে। সে কারণে এই ফ্লুর নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু।
১৮। এশিয়ান ফ্লু :-
এটাও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভিত্তিক বৈশ্বিক মহামারি।১৯৫৭-১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে চীন থেকে উদ্ভূত এই মহামারিতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলো ১ লক্ষ ১৬ হাজার মানুষ। এভিয়ান ফ্লু গোত্রের সমন্বিত ভাইরাসের আক্রমণে সংঘটিত এই মহামারি খুবই দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিলো। ১৯৫৭-এর ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে, এপ্রিলে হংকংয়ে এবং তারপরই যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র-উপকূলীয় নগরগুলিতে এটা ছড়িয়ে পড়ে।
১৯। ইনফ্লুয়েঞ্জা :-
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণামতে, ১৯১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর পরিমাণ ১০ কোটির বেশি হতে পারে।
২০। পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা :-
১৯৭৬-এ প্রথম সুদান ও কঙ্গোয় ইবোলার প্রকাশ ঘটে। অনুমান করা হয় যে ভাইরাসটি বাদুড় থেকে এসেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬-এর মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায় ২৮ হাজার ৬ শত জন ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত হয় এবং ১১ হাজার ৩২৫ জন মৃত্যুবরণ করে বলে জানা যায়। ২০১৩-এর ডিসেম্বরে আক্রমণ হয় গিনিতে। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিয়নে। মূলত এই তিন দেশই ইবোলার প্রধান আক্রমণক্ষেত্র। তবে আরো কিছু মানুষ আক্রান্ত হয় নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে। ইবোলার ভ্যাকসিন আবিস্কারের কাজ চলছে।
২১। এইডস :-
১৯২০ খ্রীস্টাব্দে এই রোগের সূচনা হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে এসে এইডস (Acquired Immune Deficiency Syndrome-AIDS) বৈশ্বিক মহামারির রূপ নেয়। যতটুকু জানা যায়, পশ্চিম আফ্রিকায় এক শিম্পাঞ্জি ভাইরাস থেকে মানবদেহে স্থানান্তরণের মাধ্যমে এইডস-এর মূল ভাইরাস এইচআইভির [Human immunodeficiency virus (HIV) উৎপত্তি। এই ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে ৩৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এখন আক্রান্তদের প্রায় ৬০ ভাগই সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের অধিবাসী। দীর্ঘকাল এই ভাইরাসের প্রতিষেধক ছিল না। তবে ১৯৯০ থেকে এক ধরনের নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে অসুস্থতা নিয়েও আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে। ২০২০ সালে আরো কিছু অগ্রগতি হয়েছে।
২২। সোয়াইন ফ্লু :-
২০০৯ খ্রীস্টাব্দে সোয়াইন ফ্লু প্রথম মেপিকোয় চিহ্নিত হয়। এটা GUv H1N1 গোত্রের একটা নতুন ভাইরাস। দ্রুতই সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস, এবং মাত্র এক বছরে ১.৪ বিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। আনুমানিক দেড় লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে এই ফ্লু। এই ভাইরাসের প্রধান শিকার হয়েছে শিশু এবং তরুণরা। ৮০ ভাগ মৃত্যুই ঘটেছে ৬৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যায়।
২৩। যক্ষ্মা :-
গবেষণা বলছে, গত দুই শতাব্দীতে ১০০ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ২০২০ সালের মধ্যে ৬ থেকে ৯ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবে।
২৪। জিকা ভাইরাস :-
২০১৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে জিকা ভাইরাস শিশু কিংবা বয়স্ক কারো জন্যই তেমন ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই ভাইরাস ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে মায়ের জঠরে থাকা এখনো জন্ম নেয়নি যে শিশু-তার। উষ্ণ এবং আর্দ্র পরিবেশ পছন্দ করে বলে ভাইরাসটি মাতৃগর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি করে বেশি। জিকা ভাইরাসের আক্রমণে নানা ধরনের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম নেয় নবজাতক। এটা সাধারণত মশাবাহিত তবে যৌনসংক্রমণেও ঘটে। এডিস গোত্রের মশাই এই জিকা ভাইরাস বহন করে। সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় জিকা মহামারি আকার ধারণ করার আগে তেমন করে এর খবর পাওয়া যায়নি। মূলত আমেরিকায়ই এখনো জিকার চলাচল।