কওমী ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদি জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ২৫ ২০২০, ১৩:০৮

সৈয়দ শামছুল হুদা

দেশে রাজনৈতিক দলের অভাব নেই। সাধারণ ধারার পাশাপাশি ইসলামী অঙ্গনেও অনেকগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। বিশেষভাবে কওমী ধারার ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি যে, দিন দিন এসব দলগুলো জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে এখন নিজ নিজ মাদ্রাসার চারদেয়ালের ভেতর সীমিত হয়ে পড়েছে। আর যে কারণে কেউ এখন সমমনা ৬দলের কর্মসূচীর দিন স্টেটাস দেয়, হে আল্লাহ! ৩৬৫দিন বৃষ্টি দিলেও আজকের দিনটায় বৃষ্টি দিও না। কওমীভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি কতটা জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেলে এ ধরণের স্টেটাস আসতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

কওমীভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরণের সীমাহীন কর্তৃত্ববাদি সংগঠন। এখানে কোন জবাবদিহিতা নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচীর সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে পর্যালোচনার কোন সুযোগ নেই। এখানে আছে শুধু ছাত্র আর কিছু ভক্তদের গুণকীর্তন করার অশুভ সংস্কৃতি। কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরণের দ্বি-চারিতায় অভ্যস্ত। মাদ্রাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ। তারা সরকারের সব কর্তৃত্বের বাইরে। আবার নিজ নিজ মাদ্রাসায় একদলীয় শাসন ও ত্রাসন। যে কোন প্রোগ্রামে ভরসা ঐ ছাত্ররাই। আর সাবেক ফারেগীন কিছু বড় ছাত্র। এক মাদ্রাসায় অন্য ছাত্র সংগঠনের অনুপ্রবেশ সম্পুর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অথচ নিজেরা ঠিকই ছাত্রদেরকে দলীয় কাজে ব্যবহার করেন।

কওমী ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোন প্রকার ধারাবাহিক কার্যক্রম নেই। থাকার সুযোগও নেই। যিনি মাদ্রাসার মুহতামিম, তিনিই আবার শাইখুল হাদীস। তিনিই আবার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বড় পদে। মনে চাইলে, সুযোগ পাইলে, চাপে পড়লে শুক্রবার দিন সুযোগ মতো ছাত্রদেরকে নিয়ে একটু নড়াচড়া দেন।এইটাইতো অনেক বেশি। রাজনীতি করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ছুটে যাওয়া, মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা, তাদের সুখে-দুখে পাশে দাঁড়ানোর জন্য উনাদের সুযোগ কই। দেশের বড় বড় সমস্যা, জনগণের সমস্যা নিয়ে ভাববার এত ফুরসত কই।

কওমী ভিত্তিক দলগুলোতে ধারাবাহিক নেতৃত্তের সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই। কারা? কিভাবে? দল চালাবেন, কে? কোথায়? কখন? কিভাবে কাজ করবেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সবসময়ই একজন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ক্ষমতার কোনো বিকেন্দ্রীকরণ নেই। এছাড়া কওমি ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে সারা দেশকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকা হয়। এর বাহিরেও যে কোটি কোটি জনতা রয়ে গিয়েছে তাদের চাওয়া-পাওয়ার কোন মূল্য কওমি ভিত্তিক কোন রাজনৈতিক দলের সামনে নেই।

অন্যান্য আর দশটা দলের মতো কওমী ভিত্তিক দলগুলোতেও দলীয় গঠনতন্ত্র, সাংগঠনিক কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা, নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি কোন কিছুই মানা হয় না। ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতি। ব্যক্তি নাই দল নাই। সংগঠনগুলোতে ভিন্নমত পোষণ করার মতো সাহস রাখে, নিত্য-নতুন আইডিয়া দিতে পারে এমন যোগ্যতা রাখে, অথবা সংগঠনের যে কোন পদে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা রাখে এমন লোকদের খুব কৌশলের সাথে আস্তে করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।

কওমী ভিত্তিক দলগুলোতে সাধারণ মানুষকে কোনভাবেই ঘেষতে দেওয়া হয় না। পদ-পদবী পাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না। খেলাফত মজলিস দলটা ভেঙ্গেছে আহমদ আব্দুল কাদের যোগ্যতা ভীতিতে। বড় হুজুর না- এমন কেউ যোগ্যতা দিয়ে দলের দায়িত্বে চলে আসবে এটা মেনে নেওয়ার কোন সুযোগই কোন কওমী দলে রাখা হয়নি। সবগুলো দলে এক ধরণের অঘোষিত কর্তৃত্ববাদি রাজনীতি চলে। বড় হুজুর মনে চাইলে রাজনীতি চলবে, মনে না চাইলে কোন কর্মসুচী ঠিক করা যাবে না। কর্মীরা হাজারো অনুরোধ করলেও কোন কর্মসূচী আসবে না। এভাবে কাজ করতে করতে আজ তারা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে নিজেরাও মনে হয় জানে না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সমন্বয়ের রাজনীতির একটি সংস্কৃতি কওমী অঙ্গনে ছিল।বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের শুরুটাতে কওমী আলেমদের কোন কোন রাজনীতিবিদ সবাইকে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছেন। ২০০১এ সামান্য ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে এই যে একলা চলো রাজনীতির সংস্কৃতি চালু হয়েছে এ থেকে আর গত ৩০বছরেও বের হয়ে আসতে পারেনি। ব্যরিস্টার কোরবানী আলী, অধ্যাপক আখতার ফারুক, আহমদ আব্দুল কাদের, মেজর জলিল, আনোয়ার জাহিদ, মাসুম মজুমদার প্রমুখ একসময় ইসলামী রাজনীতি বিশেষ কওমী ধারার রাজনীতির সাথে সমন্বয় করে কাজ করেছিলেন। তাদের সময় পর্যন্ত কওমী ধারার দলগুলোর কিছুটা হলেও সামাজিক প্রভাব ছিল। বর্তমানে একেবারেই সামাজিক প্রভাব নেই।

সমন্বিত রাজনীতির সুফল কী তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই। ৭১টিভি চ্যানেলটি দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামী আদর্শ ও ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আসছিল। কিন্তু কেহই এ নিয়ে কিছুই বলতে পারছিল না। কারণ রাজনৈতিক পরিবেশটা সেভাবেই তৈরী করে রাখা হয়েছে। যেই না উদীয়মান ছাত্রনেতা নুরুল হক নূর ৭১টিভিকে বয়কটের ডাক দিলো, এমনি সাথে সাথে সমর্থনে বিবৃতি দিলো
মাওলানা মামুনুল হক, শাইখ আহমাদুল্লাহ, মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী প্রমুখ। এক কঠিন প্রতিক্রিয়া হলো জনগণের মধ্যে। কিন্তু নুরুল হক নূর এর আহবান ছাড়া অন্য কোন হুজুর আহবান করলে এর কিছুই হতো না, বরং উল্টো একশন হতো।

এমনিভাবে ফ্রান্স নিয়ে সারাবিশ্বের মুসলমানদের হৃদয় পুড়ছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ছাড়া। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন ব্যবসায়ী, কোন বড় মিডিয়া বা বড় কোন রাজনৈতিক নেতা বা দল কেউ এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। আমরা হুজুররা নিজেরা নিজেরা কিছু কথা বলছি। পণ্য বর্জনের তালিকা করে ফেসবুকে দিচ্ছি। এর কোন ফল নেই। কারণ আমরা ফ্রান্সের পণ্য কিনিই না। যারা কিনে, যারা ফ্রান্সের পণ্য আনে তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণটা কি? কারণ হলো হুজুরদের দলে কোনভাবেই সাধারণ শিক্ষিতদের সমন্বয় করা হয়নি। এদেশের হুজুররা নিজেদেরকে নিজেরাই জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমাদের দৌঁড় বায়তুল মুকাররম পর্যন্ত, আমাদের সর্বোচ্চ স্রোতা শুক্রবার দিন আটকে রাখা কিছু সাধারণ মুসুল্লি এবং নিজেদের মাদ্রাসার ছাত্ররা ছাড়া আর কেউ নয়।

আজ খুব কষ্ট হয় যখন দেখি কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সমমনা দলগুলোকে নিয়ে কোন ইসলামী দল উপহাস করে। সমমনাদের আন্দোলন নিয়ে ট্রল না করতে ফেসবুকেই আবার আহবানও জানানো হয়। এটাই প্রাপ্য ছিল। আগামী দিনে আরো তিরস্কার পাবে।

কওমী ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোতে ভাঙ্গন এক প্রকার নিত্যদিনের ঘটনা। কেন এমন হয়? এর অন্যতম কারণ, দলে নিয়মতান্ত্রিকতা রক্ষা করা হয় না। নিয়ম মোতাবেক কারো কোন কাজ করতে হয় না। কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। বড় হুজুর- বড় পদ এই নীতিতে চলে কওমী ভিত্তিক সবগুলো কওমী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল । যে কমিটি গুলো করা হয়, তা শুধু বড় হুজুরদের চেহারা দেখে করা হয়। কোন কাজ করতে হয় না। বড় হুজুর সুযোগ হলে, আল্লাহ তৌফিক দিলে কখনো কখনো দলের দিকে একটু নেক নজর দেন। নইলে নয়।উনারা কাজ করতে পারবেন কি না এটা কখনোই দেখা হয় না। সংগঠনের জন্য উনার সময় দেওয়ার সুযোগ হবে কি না এটা কখনোই বিবেচনায় নেওয়া হয় না। বরং বলা হয়, হুজুর আপনি বড় গ্রহন করে দলে একটি বরকত দিন। এসব নিয়েই মূলত: দল ভেঙ্গে যায়। যারা কাজ করতে আগ্রহী, যারা সামান্য সংগঠন বুঝে, দেখা যায়, বড় হুজুর এদেরকে নানা ট্যাগ লাগিয়ে দলে দুর্বল করে রাখে।একসময় দল ভেঙ্গে যায়। জমিয়ত, মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি কারণেই ভেঙ্গেছে। আরো ভাঙ্গবে।

যতদিন ইসলামী দলগুলোতে কাজের মূল্যায়ণ না হবে, যতদিন বড় হুজুরের তৌফিক হলে কাজ করবেন, আর না হলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বড় পদ আকড়ে থাকবেন ততদিন দল ভাঙ্গতেই থাকবে। দল চলবে নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতিতে। দল চলবে সাংগঠনিক পরামর্শে। দল চলবে গঠনতন্ত্র মেনে। কাজ করার সুযোগ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দলে পদ দেয়া হবে। এর কোনটাই কওমী ভিত্তিক দলগুলোতে ভালোভাবে অনুসরণ করা হয় না। এখানে মেধার মুল্যায়ণও নেই। যোগ্যতার স্বীকতি নেই। শুধু ভয় কখন পদ চলে যায়। সাধারণ মানুষকে দলে ভিড়তে দেওয়া হয় না। তারা নানা দোষ ধরতে থাকে সাধারণ মানুষের। শুধু আমরা আমরাই হক, আমরা আমরাই ইসলামের খাটি অনুসারী মনে করা হয়। রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তি হতে হলে যে, সবারই সমর্থন প্রয়োজন এটা আমরা ভুলেই গেছি।

জানি না, এই অন্ধকার গহ্বর থেকে কবে নাগাদ কওমী ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বের হয়ে আসতে পারবে। কবে নাগাদ তারা বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করতে পারবে। কবে নাগাদ তারা মাদ্রাসার মুহতামিমের পদ ধরে রেখে নিরাপদ রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। কবে নাগাদ তারা রাজনীতির জন্য, জনগনের জন্য, গণস্বার্থে ঝুকি নিয়ে রাজনীতি করা শুরু করবে। একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কওমী ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোতে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, সুমতি ফিরে আসুক, সেই প্রার্থনা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জানাই।

পাশাপাশি প্রস্তাব করছি যে, এখন থেকে কওমী মাদ্রাসায় সকল প্রকার দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। হয় দল নয় রাজনীতি দুটোর যে একটি গ্রহণ করুন। কোন মাদ্রাসার ভিতরে কোন প্রকার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কোনো কর্মসূচি পরামর্শ আলোচনা চলতে দেওয়া যায় না। এর জন্য রাজনৈতিক অফিস থাকবে। রাজনীতির সাথে যারা কাজ করবেন তারা সবকিছু পরিচালনা করবেন। নতুবা সকল মাদ্রাসায় সকল ছাত্র সংগঠনকে আন্দোলন করার সুযোগ দেয়া হোক। সেখানে ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র আন্দোলন ছাত্র খেলাফত ছাত্র মজলিস সবাইকেই রাজনীতি করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হোক। তা না দিলে একক কোন দল একক কোন মাদ্রাসায় রাজনীতি করতে পারবে না।

লেখক: জেনারেল সেক্রেটারী
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)