কওমী ধারায় উচ্চশিক্ষার সংকট

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১৮ ২০২০, ২৩:৪৯

।। সৈয়দ শামছুল হুদা ।।

বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। কুরআন ও হাদীসের ইলম চর্চার জন্য যথেষ্ট পরিমানে কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, দেশে ঘরে ঘরে জামেয়া আগে থেকেই চালু হয়ে যাওয়ার কারণে নতুন করে উচ্চশিক্ষার কোন ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করছেন না। কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদাভাবে কোন প্রতিষ্ঠান করার তাগাদা অনুভব করেন না।

এদেশে যেন-তেন প্রকারে দাওরায়ে হাদীস পাশ করা যায়। ১৬/১৭ বছরেই অনেকে দাওরায়ে হাদীস পাশ করে যাচ্ছে। অনেক মেয়ে খুব অল্প বয়সেই দাওরায়ে হাদীস পাশ করে যাচ্ছে। যোগ্যতার বিষয়টি এখানে মুখ্য হয়ে উঠে না। যে কোন মূল্যে তাদের সনদ ধরিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য থাকে।

১৬/ ১৭বছরেই দাওরায়ে হাদীস শেষ করার পর গড়পরতা যে কোর্সগুলো এখন পড়ানো হয়, সেগুলো হলো ইফতা, তাফসীর ও আদব বিভাগ। খুব সীমিত জায়গায় রয়েছে উলুমুল হাদীস। দাওরায়ে হাদীস শেষ করার পরও যে শিক্ষার অনেক কিছু বাকী থেকে যায়, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। যখন তরুন ফারেগীনরা কর্মস্থলে ঢুকেন, তখন অনুভব করেন, “আরে, এখনোতো অনেক কিছুই শিখা হয়নি।”
আমাদের দেশে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থায় দাওরায়ে হাদীসকেই শিক্ষাস্তর সমা্প্তি মনে হয় করা। অথচ বর্তমানে সমাজ ও রাষ্ট্রে কাজ করতে গেলে আরো অনেককিছু শিখতে হয়, শিখার বাক থাকে, সেটা নিয়ে কেউ কোথাও কোন আলোচনা করেন না। সিলেবাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংশোধন, বিয়োজন প্রয়োজন এটা নিয়ে কেউ কোন চিন্তা করেন না। করলেও কেউ সফল হন না। কারণ প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর সামনে সেই চিন্তাশীলরা পাত্তাই পান না।

দাওরায়ে হাদীস পাশ করার পরও অনেক তরুনদের সামনে প্রচুর সময় থাকে আরো বেশি কিছু শিক্ষা অর্জনের। কিন্তু তারা কোথায় পড়বে? কী পড়বে? এটা নিয়ে কোথাও কোন কাজ হচ্ছে না। দাওরায়ে হাদীস পাশ করার পরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়ার বাইরে থেকে যায়। ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ নেই। তথাকথিত জামেয়াগুলোতে বিশেষ বিষয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার কোন সুযোগ নেই।

দাওরায়ে হাদীস পাশ করার পর তরুন আলেমদের বিশেষ শিক্ষার জন্য কয়েকটি ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেগুলোর মান এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। ইসলামের অর্থ ব্যবস্থা, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ধারণ করে ইসলামের সমন্বয় করে কোন শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনো গড়ে উঠেনি।

দেশে কিছু বড় বড় মাদ্রাসা রয়েছে। সেগুলোতে কওমী ফারেগীনদের জন্য উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলে দিতে উদ্যোগ নিতে পারতো। কিন্তু কেউ সেভাবে চিন্তা করছে না। গতানুগতিক যা পড়ানো হচ্ছে তাতেই উনারা সন্তুষ্ট। অথচ দেশের বাইরে বিভিন্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণামূলক শিক্ষার যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তা কোন ভাবেই এদেশে অনুসরণ করা হয় না। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার একমাত্র মানদন্ড দারুল উলূম দেওবন্দ। এই কারিকুলামের বাইরে আমরা কিছুই যেন চিন্তা করতে পারছি না।

অথচ শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে প্রতিনিয়ত বিশ্বে গবেষণা হচ্ছে। সব লাইনেই কাজ হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা নিয়ে যেমন গবেষণা হচ্ছে। তেমনি ইসলামী শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ হচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় আলকারওইন। একজন নারী সেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল আজহার, উম্মুল কুরা, মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ আজকে যেই শিক্ষা ব্যবস্থার আমরা উত্তরসুরী বলে পরিচয় দিই, সেই নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে মান ছিল তাও আমরা ধারণ করি না।

প্রচলিত ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর অটল, অবিচল থাকলে কোন কালেই আমরা যুগের ভাষা বুঝতে পারবো না। যুগের নেতৃত্ব কিছুই দিতে পারবো না। আফসোসের বিষয় হল: যেভাবে হাইয়াতুল উলয়ার মাধ্যমে সনদের মান দেওয়া হয়েছে এটা দিয়েও বিশ্বের কোথাও উচ্চ শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ নেই। দেশেও নেই, বিদেশে ও নেই। চাকুরীর ক্ষেত্রে যেমন এ সনদের কোন মূল্য নেই, তেমনি লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও এর কোন ভূমিকা নেই। এই সংকট কাটিয়ে উঠা দরকার।

যেভাবে পরিবর্তন সম্ভব
* একটি পদক্ষেপ হতে পারে, হাইয়াতুল উলয়ার মাধ্যমে সনদের যে মান দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে উচ্চশিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত করতে কওমী মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগে সরকারের নিকট থেকে বাকী অধিকারটুকু আদায় করা। সরকারকে অন্তত এটুকু বুঝানো দরকার যে, আমাদের যে সনদ দিয়েছেন তা দিয়ে সাধারন ধারার কিছু কিছু বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিন। আমরা আরো বেশি পড়তে চাই।

* আমাদের দেশে বড় বড় মাদ্রাসাগুলোতে বিশ্বের উন্নত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসৃত পদ্ধতিতে গবেষণামূলক জ্ঞান অর্জনের জন্য২/৩/৪বছর মেয়াদী কোর্স চালু করা যেতে পারে। দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণকে সীমিত দুয়েকটি কোর্সে ভর্তি হতে বাধ্য না করে, আরো অনেক বেশি বিষয়ে কোর্স চালু করা হোক। তার মাধ্যমে শিক্ষার সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। বর্তমানে গবেষণামূলক ইলম চর্চার কোন বিকল্প নেই। কুরআন ও সুন্নাহকে বুঝার জন্য হলেও গবেষণামূলক জ্ঞান চর্চা দরকার। আমাদের কওমী অঙ্গনে এ ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি আছে। সেটা হয়তো অনেকে গায়রতের কারণে স্বীকার করবেন না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এটাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।

জেনারেল সেক্রেটারী
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)