কওমী অঙ্গনে আলোচনার ঝড়: কী লিখেছে বিবিসি বাংলা?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ২৩ ২০১৮, ১৫:৫৭

একুশে জার্নাল ডেস্ক: বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসায় পড়ছে কারা? শিরোনামে বুধবার ২২মে কওমী মাদরাসা নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন বিবিসি বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক আকবর হুসেইন। প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে আলোচনা সমালোচনা। কওমী মাদসারায় সংশ্লিষ্ট একটি অংশ মনে করেন, কওমী মাদরাসা নিয়ে বিবিসির এই প্রতিবেদনটি যথেষ্ট ইতিবাচক।

কওমী মাদরাসা নিয়ে মিডিয়াগুলোতে অতিতের রিপোর্টগুলো পর্বযেবেক্ষণ করলে দেখা যায় সেগুলোতে কোন না কোনভাবে সত্য-মিথ্যার মিশ্রনে মাদরাসার বিপক্ষে যায় এমনভাবেই সাজানো হতো প্রতিবদেন। সেগুলোতে কওমী মাদরাসার পক্ষের কোন বক্তব্য হাইলাইট করা হতো না। বরং কওমী মাদরাসাকে যারা মূলধারা শিক্ষার অন্তরায় মনে করেন, মাদরাসার প্রতি যাদের আজন্ম হিংসা-বিদ্বেষ, মূলত সেই শ্রেনীর কিছু মানুষের বক্তব্যই ফলাও করে প্রচার করা হতো রিপোর্টগুলোতে। সেক্ষেত্রে বিবিসির এই রিপোর্টটি যথেষ্ট নিরপেক্ষ। কারন এখানে কওমী মাদরাসার কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিতের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

অন্যদিকে আরেকটি অংশ মনে করছে যদিও আপাতত দেখা যাচ্ছে ভালো তবে বিবিসির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ আছে। কারন এই প্রতিবদনে বক্তব্য দানকারী রোকন রাইয়ান অভিযোগ করেছেন, বেফাক ও মাদরাসা বোর্ড নিয়ে তার পুরো বক্তব্য তুলে ধরা হয়নি। বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরায় অনেকেই ভুল ধারনা করছেন।

পাঠকের সুবিধার্থে নিচে বিবিসির পুরো প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

“ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা হাসিনার আক্তার। তাঁর তিন সন্তানের সবাই কওমী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছে।
হাসিনা আক্তার হিসেব করে দেখেছেন, স্কুলে সবার জন্য প্রতি মাসে খরচ হতো কমপক্ষে দশ হাজার টাকা।
কিন্তু মাদ্রাসায় তিনজনের জন্য তাঁর খরচ হচ্ছে দুই হাজার টাকার মতো।
স্কুলে ভর্তির সময় ডোনেশনের মতো মাদ্রাসায় সে ঝামেলা তো নেই, কোন বাধ্যতামূলকভাবে কোচিংও করতে হয়নি।
হাসিনা আক্তার বলছিলেন, এক দিকে ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং অন্যদিকে কম খরচ – এ দুটি কারণে তিনি সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন।

“আমি আমার বাচ্চাকে হাই লেভেলে দিতে চেয়েছি। কিন্তু ৪০ হাজার টাকা অ্যাডভানস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না। এখানে তেমন একটা ব্যয় করতে হয়না। দ্বিতীয় হচ্ছে, মুসলিম হিসেবে আমার বাচ্চাকে এমন শিক্ষাই দিতে হবে যার মাধ্যমে তার ঈমান-আকিদা এবং দুনিয়াবি জিন্দেগিটা কোরআন এবং সুন্নাহর আলোকে হয়,” বলছিলেন হাসিনা আক্তার।

বাংলাদেশের সবেচেয়ে বড় কওমী মাদরাসা ” দদারুল উউলুম হাটহাজারী চট্রগাম”।


ঢাকার বেশ কিছু মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেল এসব জায়গায় ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছেন মূলত পরিবারের ইচ্ছায়।
তবে সাথে-সাথে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাও ছিল কিছুটা। মাদ্রাসা ছাত্রী শিফা আক্তার ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনার পর কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এর কারণ কী?
শিফা আক্তার বলেন, ” আমার আব্বু আগে স্কুল টিচার ছিলেন। তারপর ইসলামের দিকে ধাবিত হয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকতায় যোগ দিলেন। আমার আব্বু চাইতেছিলেন যে আমি মাদ্রাসায় পড়বো। আর আমারও ইচ্ছা ছিল মাদ্রাসায় পড়ার।”

এসব মাদ্রাসায় এতিম কিংবা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আধিক্য যেমন আছে তেমনি সমাজে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাও আছে, যারা চাইলে নিজের সন্তানকে ব্যয়বহুল শিক্ষা দিতে পারেন।
অন্যদিকে সমাজে আরেকটি অংশ আছে যারা সাধারণ শিক্ষার খরচ বহর করতে পারেন না।
ফলে কওমী মাদ্রাসা হয়ে উঠে তাদের জন্য একটি ভরসার জায়গা।

মাদ্রাসায় ভর্তি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কী বলছে
তবে উভয় ক্ষেত্রেই ধর্মীয় প্রভাব একটি বড় কারণ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে। সে কথাই বলছিলেন একজন অভিভাবক শহিদুল্লাহ ভুঁইয়া।
মি: ভুঁইয়ার চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ফ্যাশন ডিজাইনার, এক মেয়ে ডাক্তার এবং আরেক মেয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। ছোট ছেলে তিনি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি চাই যে আমার একটা ছেলে হাফেজ হোক। আমি একজন হাফেজের বাপ হতে পারবো। তাছাড়া আমার ছেলে ইসলামের খেদমত করতে পারবে। এটাই হলো উদ্দেশ্য।”

বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে কওমী মাদ্রাসায় পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা।
কওমী মাদ্রাসাগুলোর কার্যক্রম সরকারী তদারকির বাইরে।
এসব প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হবে সে বিষয়য়ে সরকারের কোন নজরদারি নেই।
কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেল এসব জায়গায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছেই।
কওমী মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাকের হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিভিন্ন শ্রেণিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ৫৫ হাজার ছিল, ২০১৮ সালে সেটি দ্বিগুণ হয়েছে।

একটি কওমী মহিলা মাদরাসার ক্লাসরুম।


ঢাকার গাবতলি এলাকায় মেয়েদের একটি কওমী মাদ্রাসা শামসুল উলুম মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৩ সালে। শুরুতে এখানে ৩৫জন ছাত্রী থাকলেও পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখানে ছাত্রী সংখ্যা এখন প্রায় ৩০০।

শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলছেন, অভিভাবকরা যে সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন, এর পেছনে শুধু ধর্মীয় কারণ নয় অর্থনৈতিক কারণও জড়িত।
রাশেদা চৌধুরী বলেন, মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে-ধীরে ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলোর জন্য। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকার ব্যয় করার পরেও ছাত্র-ছাত্রীদের পেছনে বহু টাকা ব্যয় করতে হয় অভিভাবকদের।

“আমরা গবেষণায় দেখেছি, প্রাথমিক শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার যে টাকা ব্যয় করে, তার দ্বিগুণ কখনো-কখনো তিনগুণ ব্যয় করতে হয় পরিবারগুলোকে। যেখানে মাদ্রাসাগুলোতে, বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাগুলোতে, কোন ধরনের ব্যয় বহন করতে হয় না। বিশেষ করে বিত্তহীন বা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো পছন্দ করেন বা বেছে নেন। বাধ্য হয়ে বলা যেতে পারে। “বলছিলেন রাশেদা কে চৌধুরী।
তবে বাংলাদেশের সমাজে অনেকেই আছেন যারা মনে করেন, তাঁর তিনটি সন্তান হলে একজনকে মাদ্রাসায় দেবেন। এ ধরনের চিন্তাধারা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত- সবার মাঝেই দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন রাশেদা চৌধুরী।

কওমী মাদ্রাসায় টাকা আসে কোথা থেকে?
কওমী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই তাদের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশোনার খরচ বহন করে।
অনেক মাদ্রাসা আছে যেখানে নির্ধারিত কোন বেতন নেই। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচ্ছলতার উপর নির্ভর করে বেতন নেয়া হয়।
এতো বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহন করছে কারা? কোত্থেকে আসছে এতো টাকা?
কওমী মাদ্রাসার যারা সমালোচক তাদের মনে এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এসব মাদ্রাসা বিদেশী সহায়তা পায় কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ-কেউ।

কিন্তু এসব মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, কোন বিদেশী সহায়তা নয়, সমাজের ভেতর থেকেই টাকার জোগান আনে।।কওমী মাদ্রাসায় বহু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

ঢাকার একটি অন্যতম বড় কওমী মাদ্রাসা জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামি আরজাবাদে গিয়েছিলাম আমি।
সেখানে প্রায় ১২০০ ছাত্র পড়াশোনা করছে, যাদের অধিকাংশই সেখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুবিধা পায়।
মাদ্রাসায় দুটি ভবন রয়েছে। একেকটি চারতলা করে।
এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বলেন, ” আমাদের যে ছাত্র সংখ্যা আছে তার দুভাগ হলো দরিদ্র ফ্যামিলির ছেলে। এ দেশের যে মুসলিম জনসাধারণ আছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুদানে মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। তেমন একটা সমস্যায় পড়তে হয় না আমাদের। একজন দিনমজুরও এখানে অনুদান প্রদান করেন তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী।”

কওমী মাদরাসার ক্লাসরুম


বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেল, অর্থের উৎস সম্পর্কে এসব মাদ্রাসা পরিচালনাকারীরা একই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। ইসলাম বিষয়ক লেখক এবং গবেষক মাওলানা শরিফ মোহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশের সবগুলো কওমী মাদ্রাসা সমাজের ভেতর থেকে অনুদান নিয়ে পরিচালিত হয়।
“জুম্মার নামাজে অংশগ্রহণ করে এমন কোন ধার্মিক মুসলমান আপনি পাবেন না যার কওমী মাদ্রাসায় ১০ টাকার অংশগ্রহণ নেই। ১০ টাকা থেকে এক কোটি টাকা অনুদান দেবার মতো মানুষ এ সমাজে আছে,” বলছিলেন শরীফ মোহাম্মদ।

কীভাবে পরিচালিত হয় কওমী মাদ্রাসা
কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান কোথায় হয়?
যে কোন শিক্ষা ব্যবসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কর্মসংস্থান কোথায় হবে।
কওমী মাদ্রাসায় যারা পড়াশুনা করছেন, তারা কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়েও তাঁরা খুব একটা চিন্তিত নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মনে করেন, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ যেসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে সেখানেই তাদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

ঢাকার অন্যতম একটি বড় মাদ্রাসা জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামী আরজাবাদ-এর ছাত্র আজিজুর রহমান।
তিনি ইসলামি উচ্চতর আইন গবেষণা শেষ করেছেন। তাঁর পড়াশুনা প্রায় শেষের দিকে।
তিনি আমাকে বলছিলেন, পড়াশুনা শেষ করে কর্মসংস্থানের বিষয়ে কী ভাবছেন? “শিক্ষকতাকে আমরা সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান মনে করি। সেই সাথে ইমামতি এবং আরো অনেক জায়গা আছে যেখানে আমরা কাজ করতে পারি,” বলছিলেন আজিজুর রহমান।
ঢাকার আরেকটি মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রী তাসনীম আক্তার জানালেন, পড়াশুনা শেষ করে তিনি ‘ইসলামি শরিয়ত-সম্মত কাজে’ যেতে চান।

বাংলাদেশের অন্যতম একটি পুরনো মাদ্রাসা ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা। এখানকার ছাত্র সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এখানকার শিক্ষক আহলাল্লুাহ ওয়াসেল বলছেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে তারা একটি জীবন-ধারা হিসেবে বিবেচনা করেন।
সেজন্য এখানে যারা পড়ে তারা ইসলামী ভাবধারা বজায় রাখার পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কাজ করার যোগ্যতা রাখে বলে মনে করেন মি: ওয়াসেল।

বিবিসি’তে বক্তব্য দেন লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ


বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমান মর্যাদা দিয়েছে।
সাধারণত কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা যে ধরনের পেশার সাথে জড়িত থাকেন, তার বাইরে সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরিতে আসতে সরকারি স্বীকৃতি তাদের কতটা সহায়তা করবে?

শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের রাশেদা কে চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে প্রশ্ন। রাশেদা চৌধুরী বলেন, ” আমাদের জানা মতে তারা ব্যাংকে কোথাও যেতে পারেন না, তাঁরা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন সরকারী চাকরীতে যেতে পারেন না।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, যেহেতু কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে, তাহলে তাদের কোথায় স্থান দেয়া হবে?
কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা কি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে? রাশেদা চৌধুরী বলেন, এসব বিষয় এখনো পরিষ্কার হয়নি।

তবে কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা কর্মসংস্থান নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত নয়।বিভিন্ন মাদ্রাসা ঘুরে সে ধারণাই পাওয়া গেল। তাঁরা মনে করেন, ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ আছে।

ইসলাম বিষয়ক লেখক এবং গবেষক মাওলানা শরীফ মোহাম্মদও মনে করেন, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের স্বীকৃতি দিলেও অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভিন্ন কোন-কর্মসংস্থান বেছে নেবে না।
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রের জন্য সরকারি স্বীকৃতিকে বিশাল কোন প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন না কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। আগে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
সরকারি স্বীকৃতির মাধ্যমে সে জায়গা থেকে উত্তরণ ঘটেছে বলে মনে করেন মাওলানা শরিফ মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, ” তাদের প্রধান কর্মতৎপরতা বা অংশগ্রহণ ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলোতেই ব্যাপক থাকবে। এখান থেকে বের হয়ে কেউ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ধারায় চলে যাবে, এটা আমার কাছে মনে হয় না।”
কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের বিশ্বাস, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়তে থাকবে।

কওমী মাদ্রাসা বোর্ডে এতো বিভক্তি কেন?
২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স-এর সমান মর্যাদা দিয়ে ঘোষণা দিলেন, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ব্যাপক সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। কথা ছিল স্বীকৃতির পর থেকে সবগুলো কওমী মাদ্রাসা একটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা নেবে।

কারণ বর্তমানে কওমী মাদ্রাসাগুলোর ছয়টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবং সেখানে সরকারি কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক আহলালুল্লাহ ওয়াসেল বলছেন, স্বীকৃতির পর থেকে দাওরায়ে হাদিস অর্থাৎ সর্বোচ্চ স্তরের পরীক্ষা একটি সম্মিলিত বোর্ডের অধীনেই হচ্ছে। দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা একটি সম্মিলিত বোর্ডের অধীনে হলেও নিচের স্তরের পরীক্ষাগুলো এখনো ছয়টি আলাদা বোর্ডের অধীনেই হচ্ছে।

সম্মিলিত বোর্ডের গঠন কাঠামো নিয়ে মনক্ষুন্নতা আছে বিভিন্ন পক্ষের মাঝে। হাটহাজারি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আহম্মদ শফির নেতৃত্বাধীন বেফাকের আধিপত্য রয়েছে এ বোর্ডে। তাঁদের অনুসারী মাদ্রাসার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণে এ বোর্ডে তাদের প্রাধান্য বেশি।
কওমি মাদ্রাসার একজন পর্যবেক্ষক রোকন রায়হান, যিনি নিজেও কওমি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন।
তিনি বলেন, সম্মিলিত বোর্ডে আহমদ শফির নেতৃত্বাধীন বেফাকের আধিপত্য নিয়ে অন্যদের মাঝে অসন্তুষ্টি রয়েছে। যদিও ৮০ শতাংশ কওমি মাদ্রাসা বেফাকের অধীনে এবং কওমী মাদ্রাসাকে প্রতিনিধিত্ব করে বেফাক নামের বোর্ডটি। এমনটাই বলছেন মি: রায়হান।

অনেকে বলেন কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে প্রতিন্দন্দ্বিতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে নিচের স্তরসহ সবগুলো মাদ্রাসাকে একটি বোর্ডের আওতায় একটি বোর্ডের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। শোলাকিয়া ঈদ জামাতের ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদও একটি বোর্ডের নেতৃত্বে রয়েছেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কওমী মাদ্রাসাগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে বিভক্তি কতটা প্রকট?
ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, ” এটার মধ্যে কিছুটা সত্যতা আছে, তবে এটাই মূল কারণ না। যদি এটাই মূল কারণ হইত, তাহলে দাওরায়ে হাদিসের ক্ষেত্রে সবাই একত্রিত হয়ে গেল কিভাবে? তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো থাকতেই পারে। সামাজিক অবস্থান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিভিন্ন বিষয় থাকে। সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।”
কিন্তু এ বিষয়টিকে কোন ‘প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে দেখছেন না মি: মাসউদ।

কওমী মাদ্রাসার নিচের স্তরগুলোতে পড়াশুনার সিলেবাসের ক্ষেত্রে কিছু তারতম্য আছে।
কোথাও ফার্সির উপর জোর দেয়া হয়, কোথাও উর্দুর উপর জোর দেয়া হয়। কোথাও বাংলা চর্চার উপর জোর দেয়া হয়না, আবার কোথাও সীমিত আকারে বাংলা-ইংরেজি পড়ানো হয় বলে শিক্ষকরা বলছেন।

এদিকে মি: রায়হান বলছেন, কওমী মাদ্রাসাগুলোতে যারা নেতৃত্বের পর্যায়ের আছেন তাদের রাজনৈতিক ‘চিন্তাধারার’ কারণে মতপার্থক্য রয়েছে।
তিনি বলেন, ” তাদের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস আছে। সবাই একসঙ্গে রাজনীতি করেন না। যার কারণে এতগুলো বোর্ড আমরা দেখি। ”

তবে কওমী মাদ্রাসার নেতারা বলছেন, কওমী মাদ্রাসার মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরা মনে করেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এসব মাদ্রাসার গুরুত্ব ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা সেটিই নির্দেশ করছে বলে তাদের ধারণা”
-বিবিসি বাংলা