কওমি মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা ও কিছু গুরুতর প্রশ্ন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ০১ ২০১৯, ১৮:১৫

ইফতেখার জামিল

ইমাম গাজালি রাহ. ইহইয়ায়ু উলুমীদ দ্বীনের ইলম অধ্যায়ে একটা শহরে কি পরিমাণ আলেম থাকা উচিত, সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে লেখেছেন, মুসলিম বিশ্বের অনেক জায়গায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেহাল দশা, অথচ অধিকাংশ ছাত্ররা ফিকাহের গভীর থেকে গভীরতর মাসায়েল নিয়ে পড়ে আছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, সবার জন্য ফিকাহের গভীর মাসায়েল জানা জরুরী নয়, সবার সেই মেধা বা আগ্রহও নেই।

মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর অতিরিক্ত সংখ্যক লোকের ফিকাহ চর্চা আর অতিজরুরী থাকে না। অথচ দেখা যায়, মুসলিম দেশগুলোতে, গাজালী বলছেন, চিকিৎসা সেবার মান খুবই কম। ফলে চিকিৎসা শিক্ষা ফরজে কেফায়া বা সামাজিক দায়িত্বে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো, এটা গাজালির নিজের অবস্থান নয়, যারা ইসলামী শিক্ষা চিন্তা বিষয়ে পড়েছেন, তারা জানেন, এটা মূলধারার আলেমগণ সবসময় বলে এসেছেন। তালীমমুল মুতাআল্লিমের মধ্যেও এই আলোচনা পাবেন।

বাংলাদেশে গত বছর প্রায় সাতাশ হাজার ছাত্র মাওলানা হয়েছেন। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত বিপুল সংখ্যক আলেম কি বাংলাদেশে প্রয়োজনীয়? খুব সহজ উত্তর হচ্ছে, প্রয়োজনীয় না। এর এক তৃতীয়াংশ মাওলানা হবার যোগ্য বা প্রস্তুতও না। নিছক মাদরাসার ফারেগিন বাড়ানোর জন্য অনেকে এই কাজ করে থাকেন। ফলে বিপর্যয় ঘটছে ও আরও ঘটবে। অধিক সংখ্যক অযোগ্য মানে যোগ্যদের অবমূল্যায়ন হবে। যোগ্যদের পেছনে সময় ও ফাণ্ড কম ব্যয় হবে। কর্মসংস্থানে বিপর্যয় ঘটবে।

অনেকে মনে করেন, মাদরাসা শিক্ষা বুঝি খুব সহজ, এটা খুবই ভুল ধারণা। আপনাকে যদি শুধু আরবি ভাষা, পূর্ণ কোরআনের অনুবাদ ও হাদিসের একাধিক কিতাব কোন সাহায্য ছাড়া পড়তে বলা হয়, আপনি বুঝবেন, আসলেই এই পাঠ্যক্রম আসলেই অতটা সহজ নয়। এবং মেইক নো মিস্টেক, ধর্মীয় শিক্ষায় আলিয়া বা ইসলামিক স্টাডিজ মোটেই বিকল্প নয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, আপনি অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি করে একদিকে যেমন যোগ্যদের বঞ্চিত করছেন, আবার অপ্রয়োজনীয় কিছু শ্রম ও মেধা নষ্ট করছেন।

সবার মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা দরকার। তবে সেটা মাধ্যমিক পর্যন্ত। উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। সিহহা সিত্তার সব কিতাব শেষ করার মতো ধৈর্য বা দম অন্তত অর্ধেক ছেলেদের নেই। ছাত্র কমিয়ে আপনি বরং প্রকাশনা করুন। মেধাবী ছাত্রদের ধরে রাখুন। তাতে একদিন এখানেও অক্সফোর্ড প্রেস তৈরি হবে। সেগুলোও ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে এসেছে। জানেন তো?

আপনি নিশ্চয় বলবেন, আকাবিররা কি তাহলে ভুল করেছেন? উত্তর হচ্ছে, তারা ভুল করেননি। তখনকার সময়ের প্রয়োজন ও এখনকার বাস্তবতা এক নয়। নব্বই দশক পর্যন্ত সবাইকে মাওলানা বানানোর প্রকল্প ঠিক ছিল। এখন সবাইকে মাওলানা বানানোর প্রকল্পের বিপদের কথা একটু আগেই বললাম। মাদরাসার ছাত্ররা পুঁজিবাদী চিকিৎসক বা প্রযুক্তিবিদ বা এডমিন হোক, সে নিয়ে আমার কোন উচ্ছাসা নেই। তার জন্য মাদরাসার ছাত্রদের দরকার নেই। সাধারণ ছাত্ররাই সুযোগ পাচ্ছে না। তবুও তারা কিন্তু মৌলিক অনেক বিভাগে অতিরিক্ত ছাত্র নিচ্ছে না।

আমি বরং বলছি, ইসলামী সভ্যতায় যেভাবে চিকিৎসা ও অবকাঠামো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ওয়াকফের অধীনে ছিল, তাতে এই মৌলিক প্রয়োজনীয় জ্ঞানশাখা ও সেবায় পুঁজিবাদ হাত বাড়াতে পারেনি। এই শিক্ষাগুলোকেও ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হত। আপনি মানবিক কোন শাখায় পড়লেই আপনি দুনিয়ার জ্ঞান অর্জন করছেন, দুনিয়া ও আখেরাতের এই বিভাজন ইসলাম কখনো মানেনি। বরং এটাই সেকুলারিজম। পাশাপাশি অযোগ্য ও অদক্ষ ছাত্রদের হাতে উচ্চশিক্ষা ছেড়ে দেওয়াও ধর্মীয় কাজ কিনা সে নিয়ে শক্ত প্রশ্ন তুলা উচিত।