এ এক অন্য রকম নেশা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ০১ ২০১৯, ০৮:০৩

আবদুল্লাহ আশরাফ

অনেকের অনেক শখ থাকে। এক দুটো বিশেষ শখ। থাক না। এতে আমি কোনো ক্ষতি দেখি না। শখ মানেই উপার্জনের উপায় বা মাধ্যম এমনটা নয়। মাধ্যম হয়ে গেলে ভিন্ন কথা। জগতে কতো মানুষ কতো রকম। বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে শখেরও বৈচিত্র থাকাটা স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক না।

শখ থাকবে। পৃথিবী সুন্দর ভাবে চলবে। কেননা শখের মধ্যে আনন্দ আছে। সে আনন্দ দেয়। মনকে তৃপ্তিতে ভরে তোলে। প্রত্যহিক দীনতার উর্ধ্বে নিয়ে যায়। এই শখ জাগতিক চিন্তা-ভাবনা, সুখ-দুঃখকে দূরে ঠেলে দিয়ে অন্য এক পথ তৈরি করে। আগামির পথ চলাকে করে মসৃণ। তাই কখনো কখনো এই শখ হয়ে ওঠে কারো জীবনে নেশা! তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তখন এ নেশা তাকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। যার ফলে তার জন্য মাত্রা মেনে চলা অসম্ভব হয়ে পরে। সকাল-সন্ধ্যা এই নেশা তাকে একধরণের মুগ্ধতায় বেস্টন করে ফেলে। আর সে মগ্ন হয়, তা পূরণ করতে। এভাবে জগৎ সংসারের তাবৎ চিন্তা-ভাবনা তার কাছ থেকে দূর হয়ে যায়। তখন তার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার এক মাত্র সম্বল হয় নেশাকে বাস্তবায়ন করা।

নেশা। যার শাখা প্রশাখা আছে। তার মধ্যে এক ধরনের নেশা মানুষকে ক্ষতি করে। অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়। ধূমপান ও মাদক সেবন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি আমরা সবাই জানি। তার বিপরিধ নেশা পড়া-লেখা। এই পড়ার নেশা কখনো কাউকে নিঃস্ব করে না, দেউলিয়ার জীবন-যাপনে বাধ্যও করে না। এই পড়ার নেশার সঙ্গে আগের নেশার বিশাল পার্থক্য। কেননা বই পড়ে কারো স্বাস্থ্য খারাপ হয় না, চোখের জ্যোতি একটু কমলে কমতে পারে। কেননা বই পড়তে গেলে সে আলো অন্ধকার, সময় অসময়কে বিবেচনা করে না। যার ফলে চশমা নামক বস্তুকে গ্রহণ করতে হয়। বই পড়ুয়াকে অর্থ খরচ করতে হয়; কিন্তু তা এমন নয় যে সে তার ফলে দেউলিয়া হয়ে যাবে। একটা বিখ্যাত উক্তি আছে না!Ñ ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয়নি’। তবু আমার মতো এই মধ্যবিত্ত সংসারে কিছু হোঁচট খেতে পারে। জীবন চলতে কিছুটা কষ্ট ভোগ করতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। এর মধ্যে আছে সুখ-আনন্দ।

ছোট বেলা যখন বই পড়তে পারতাম না, তখন নিজেকে বড় অপরাধি মনে হতো। সবাই বই পড়ে মজার গল্প জানে অথচ আমি পারি না। শুধু ছড়া কবিতাগুলা আমার মুখস্থ। বাবা যখন বাড়ি আসতেন তখন হরেক রকম খাতা নিয়ে আসতেন। আমি এগুলো পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। বই পড়তে না পারলেও বইয়ের লেখাগুলো ঠিকই আমি লিখতে পারতাম। কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতে পারতাম না। আমি ছোট ছিলাম বলে এ বিষয়গুলো বুঝতে পারতাম না; এমটি নয় বরং সব বুঝতাম। কিন্তু বাংলা হরফগুলো শিখে তার বানান করার যোগ্যতা আমার তখনো হয়নি। আমার কাছে অসম্ভব মনে হতো। তবে কবিতা মুখস্থ করতে একটুও কষ্ট হতো না। আরেকটা জিনিস পারতাম। তা হলো ছবি আঁকা। হ্যাঁ ছবি আঁকা। আমার মনে পড়ে তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। বোবার মতো সব লিখতে পারি। খাতা ভরা ছবি। বইয়ের সব ছবি আমার খাতায়। পিরিউডে স্যার আমাকে পড়া জিজ্ঞেস করলে, বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। একদিনের ঘটনাÑ পড়া জিজ্ঞেস করার পর পড়া না পাড়ায়, স্যার তখন আমাকে কী বলেছিলো আমার মনে নেই। সাথে বসে থাকা বন্ধু-বান্ধবীরা তখন স্যারের কাছে নালিশ করেছিলো, স্যার দেখেন! ওর খাতা ভরা ছবি! ছবি আঁকতে পারে কিন্তু পড়া শিখতে পারে না। আমি লজ্জায় যতটুকু মনে পড়ে খাতাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে লোকানো চেষ্টা করছিলাম। স্যার খাতাটা নিয়ে অনেকক্ষণ পাতা উল্টিয়ে দেখে ছিলেন। আর তখন আমার বুকে ধুকধুক শব্দ শুনতে পেরেছিলাম। স্যার সেদিন আর কিছু বলেননি। স্কুল থেকে চলে আসার পর আর কোনোদিন আমি ক্লাস চলাকালিন স্কুলে যাইনি। পরে অবশ্যই ছাত্রদের কাছ থেকে শুনতাম, স্যার প্রায় আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। এই ছবি আঁকার পিছনে কেউ ছিলো কি না আমার জানা নেই। তবে মার হাতে আঁকা বাহারি ফুলের অ্যালবামগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলতো। সময়-অসময়ে বার বার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরে সাজানো সেই অ্যালবামগুলো দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পরে যখন বরমীতে লেখা পড়া করি, তখন হাসান নামে একজন ছাত্র ছিলো। আমাদের চেয়ে অনেক উপরের ক্লাসে পড়তো। শিক্ষকের ছেলে হিসেবে আমাকে অনেক মুহাব্বত করতো। সে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতো। তার হাতের তুলি আমাকে চমকিয়ে দিয়ে ছিলো। সেখান থেকে আবার ছবি আঁকার প্রতি মনযোগি হই। আমার হাতে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি অঙ্কিত হতো। আমি মাঝেমধ্যে বিস্ময় হতাম কিন্তু তা আর বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। হঠাৎ করে আমি বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরি।

বাংলা বর্ণমালা বাবার কাছে শিখেছিলাম। শুধু বাংলা না আরবি, ফার্সি, উর্দূ, ইংরেজি। অর্থাৎ আমার যা অর্জন সবটকু বাবার কাছ থেকে। ‘আদর্শ লিপি’ বাবার কাছ থেকে পড়ার পর, সর্বপ্রথম আমার হাতে তিনি তুলে দেন, ছোটদের ‘নবীদের কাহিনী’। আমি কয়বার যে সেই বইটা পড়েছি আমার মনে নেই। কিন্তু আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগতো। বইয়ের প্রতি আমার অসম্ভব ভালো লাগার পিছনে বাবার ভূমিকা অপরিসীম। বই পড়তে যখন সবার কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হতাম, তখন বাবায় আমার আশ্রয়দাতা ছিলেন। বাবা একটা কথায় বলতেন। আমার ছেলে তো অন্য কিছু করেনি। বই পড়েছে। এটা তো ভালো। সেদিন থেকে বুঝতে পেরেছিলাম বাবা সত্যিই বইয়ের প্রতি দুর্বল।

আমার শৈশবের পৃথিবী বহু বর্ণিল রূপে একমাত্র সাজিয়ে তুলেছিলো, বই। শৈশবের কল্পরাজ্য এই বই আমার চোখের সামনে তুলে ধরে। আমি প্রায় আমার ছেলে বেলার শৈশব কৈশোরের উচ্ছ্বাস ভুলে গিয়ে আচ্ছন্ন, উদাস হয়ে থাকতাম বই পড়ে। আমার মধ্যে বাস্তব ও পরাবাস্তব চিন্তার বীজ রোপিত হচ্ছিল ক্রমেয়।

বইয়ের জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। দূর বহু দূর চলেগেছি বইয়ের সন্ধানে। কেননা মানুষের জীবনকে উপভোগের জন্য আনন্দের প্রয়োজন অসীম। সেই আনন্দ অনেক ভাবে হয়ে থাকে। কেউ আনন্দ পায় খেলাধুলা করে। কেউ ছবি দেখে। কেউ ছবি এঁকে। কেউ বা ঘুরে ঘুরে; যাকে আমরা ভবঘুরে বলে থাকি। তবে সময়ের ব্যবধানে তার রূপ পাল্টে। বিচিত্র্য রকম অভ্যেস শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দেয়। আমারো তার একটি পেয়ে বসেছিলো। আমি বেঁচে থাকার জন্য আঁকড়ে ধরেছি বই পড়া। আজও নিজিকে যখন একলা মনে হয় তখন শান্ত ও নিবিড়ভাবে সময় কাটে বইয়ের সঙ্গে।