উস্তাযজী মুফতী নূর আহমদ রাহ.র সংক্ষিপ্ত জীবনী 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ৩১ ২০২৩, ১৪:৩৩

আশরাফ আলী নিজামপুরী: সালাফদের একজন বলেছিলেন— “একজন আলিমের মৃত্যু, পৃথিবীর মৃত্যুতুল্য”। দু’-তিন দিনের ব্যবধানে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন নক্ষত্রের চিরবিদায়। মাওলানা মুমতাযুল কারীম বাবা হুযুর, ইমামুন নাহবি ওয়াস সারফ আল্লামা শাব্বির আহমদ ও বাহরুল উলূম আল্লামা মুফতী নূর আহমদ রাহমাতুল্লাহি ‘আলাইহিম।

উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসার সদ্য প্রয়াত প্রধান মুফতী ও মুহাদ্দিস, উসতাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা মুফতী নূর আহমদ রাহি. চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৮ ঈ. সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ এলাকায় প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৬০ ঈ. সনে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সমাপ্ত করেন। এরপর প্রায় দু’ থেকে আড়াই বছর তৎকালীন মুফতীয়ে আযম মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ.র সুহবতে থেকে ফিক্বহ ও ফতাওয়ার জ্ঞান অর্জন করেন এবং ফাতাওয়া প্রদানের অনুমতি প্রাপ্ত হন। অতঃপর মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ. স্ব-হস্তে লিখে একটি চিঠি হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব রাহ.র নিকট প্রেরণ করেন। মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ.র স্ব-হস্তে লিখিত মূল্যবান চিঠি শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব রাহ.র হস্তগত হওয়ার পর তিনি মুফতী নূর আহমদ রাহি.কে হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন।

দু’ আড়াই বছর পর একটি ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে হযরতুল উস্তায মুফতী নূর আহমদ রাহি. হাটহাজারী মাদরাসা থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬৪ ঈ. থেকে ১৯৮৪ ঈ. পর্যন্ত তিনি হাটহাজারী থানায় অবস্থিত বাথুয়া মাদরাসায় একাধারে বিশ বছর শিক্ষকতা করেন। বাথুয়া মাদরাসার শিক্ষক থাকাকালীন হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা ক্বারী হাফিয হামেদ রাহ.র মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮২ ঈ.তে আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব রাহ.র ইন্তিকালের পর হযরত মাওলানা হাফিয ক্বারী হামেদ সাহেব রাহ.কে হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম পদে সমাসীন করা হয়‌। তিনি মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর হযরতুল উস্তায মাওলানা মুফতী নূর আহমদ রাহি.কে পুনরায় ১৯৮৪ ঈ.তে হাটহাজারী মাদরাসায় মুফতী ও মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ দেন। সে থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর তিনি মাদরে ইলমীর খিদমাত—ফাতাওয়া প্রদান, নাযিমে তা’লীমাত, কোষাধ্যক্ষ, নাযিমে দারুল ইকামাহর দায়িত্বসহ বিভিন্ন যিম্মাদারী সুচারুরূপে আঞ্জাম দেন। হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতার জীবনে তিনি ইলমুল মানত্বিকের শারহে তাহযীব, ক্বুত্ববী, সুল্লামুল উলূম; ইলমুত তাফসীরের তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বাইযাবী, তাফসীরে ইবনে কাসীর; ইলমুল ফিক্বহের মুখতাসারুল ক্বুদূরী, কানযুদ্দাক্বায়িক্ব, হিদায়া [২য় খণ্ড], ইলমুল আক্বায়িদের শারহুল আক্বায়িদ; ইলমে হাদীসের মুয়াত্বা ইমাম মুহাম্মাদ, মুয়াত্বা ইমাম মালিক, ইবনে মাজাহ শরীফ, মুসলিম শরীফ এবং শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলাভী রাহি.র হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহসহ আরও জটিল ও কঠিন কিতাবসমূহের দারছ প্রদান করেন। তার লিখিত গ্রন্থ সমূহ প্রায় ত্রিশটি। তবে, অধিকাংশ কিতাব এখনো পাণ্ডুলিপি ও যন্ত্রস্থ অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। বিশেষ করে—উর্দূ ভাষায় তাঁর সংকলিত ফাতাওয়া সমগ্র ‘আশরাফুল ফাতাওয়া’ নামে ছয় খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। যা বাংলা ভাষায় অনুবাদ হওয়া সময়ের দাবি।

সর্বশেষ এই তো গত বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন হযরতের মুমূর্ষু অবস্থায় আমি অধম আরো জামি‘আর কয়েকজন শিক্ষকসহ আমরা হযরতের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যে তাঁর কক্ষে যাই। সালাম দিয়ে মুসাফাহারত অবস্থায় আমি হযরতকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘হযরত, আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, “আশরাফ আলী”

অতঃপর আলতো করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, “রিযা বিল ক্বাযা; আল্লাহর ফায়সালার ওপর আমিও রাযি। আপনারাও রাযি থাকবেন।” এটিই হযরতের সাথে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।

আজ ৩১ মার্চ, পবিত্র রামাযান মাসে, জুমার দিনে, সুবহে সাদিকের কিছুক্ষণ পূর্বে, রাতের শেষ প্রহরে তিনি মাওলার ডাকে সাড়া দেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল চুরাশি বছর।

মহান আল্লাহ তা’আলা উস্তাযে মুহতারামকে জান্নাতের আ’লা মাক্বাম দান করুন!