ঈদুল আজহার গুরুত্ব এবং নামাজ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় মাসআলা 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ১১ ২০১৯, ১৬:৩৯

এহসান বিন মুজাহির

মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তম দুইটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম একটি আনন্দ উৎসব হলো পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। সোমবার ১২ আগস্ট সাররাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ঈদ শুধু আনন্দ আর উল্লাসের নয়, বরং একটি ইবাদতও।

 

ঈদের সূচনা :

হিজরতের পূর্বে ঈদ প্রথার প্রচলন ছিল না, বরং তৎকালীন সময় মদিনার আনসারগণ বসন্ত ও পূর্ণিমার রাত্রে, ‘মেহেরজান’ ও ‘নওরোজ’ নামে দু’টি উৎসব পালন করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- একদিন নবী করিম (সা) হিজরত করে মদিনায় তাশরিফ নিয়ে দেখতে ফেলেন মদিনাবাসীরা, ‘নববর্ষ ও মেহেরজানের’ দু’টি উৎসব পালন করছে, তখন মহানবী (সা) তাদেরকে জিজ্ঞাস করলেন তোমরা এ দু’দিনে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠ কেন? মদিনার আনসার এবং নওমুসলিমগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল আমরা জাহেলি যুগে এ দু’দিনে আনন্দ উৎসব করতাম, যা আজ পর্যন্তও প্রচলিত। তখন রাসুল (সা) তাদেরকে বললেন আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদেরকে সেই দু’টি উৎসবের পরিবর্তে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা দান করেছেন। (আবু দাউদ : ১৯৪৬)।

ঈদুল আজহার গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন যে-‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত্রে পূণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগী করে, কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্ত কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সেদিনও মরবে না’। (আতরাগীব)।

রাসুলুল্লাহ (সা). আরো এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পূণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে সেই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’। পূণ্যময় ৫টি রাতেরর অন্যতম ১টি হলো পবিত্র ঈদুল আজহার রাত। (বায়হাকি)।

 

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই। (মেশকাত শরিফ : ১৯৬৭)।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা রা. থেতে বর্ণিত, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন-‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করেনা সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়। (ইবনে মাজাহ শরিফ : ১৬৩৯)।

মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তারা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লস্নাহর নাম উচ্চারণ করে। (হজ : ৩৪)।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘নিশ্চই আমার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার নিকট পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। (হজ : ৩৭)।

ঈদুল আজহার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সকল গুণাহ মোচন করে দেয়া হয়। (তিরমিজি শরিফ : ১/১৮০)।

মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে। (মুসলিম শরিফ : ২৮৩১)।

বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় দশ বছর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি শরিফ : ১/১৮৯)।

একদিন হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসুল সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোরবানি কি? তখন উত্তরে রাসুল সা. ইরশাদ করলেন কোরবানি হচ্ছে ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ. এর জীবনাদর্শ’ সাহাবী পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন কোরবানি র ফজিলত কি? রাসুল সা. বললেন- পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয়’। (মিশকাত শরিফ : ১/১২৯)।

ঈদের সুন্নাতসমূহ :

ঈদের দিন সাজ-সজ্জা করা এবং খুশি করা।  গোসল করা। সাধ্য অনুযায়ী উত্তম পোষাক পরিধান করা। মিসওয়াক করা। খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। ফজরের নামায পড়েই খুব সকালে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খোরমা বা অন্য কোন মিষ্টি দ্রব্য ভক্ষণ করা, সম্ভব হলে সেমাই, মিষ্টি জাতীয় পিঠা খাওয়া। ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া। ওজর ব্যতিত মসজিদে ঈদের নামাজ না পড়া। ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরা। তাকবীরে তাশরীক, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পাঠ করে করে ঈদগাহে যাওয়া।

ঈদের নামাজের নিয়ম :

ঈদের নামাজ অন্যান্য নামাজের মতো হলেও এর আদায়ের পদ্ধতি কিছুটা ব্যতিক্রম। যেমন- অন্যান্য নামাজ জামাতে আদায় করতে হলে আজান এবং ইকামতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঈদের নামাজ পড়তে আজান ইকামতের প্রয়োজন হয় না।

যেভাবে ঈদের নামাজ পড়বেন :

প্রথমে এভাবে নিয়ত করবেন যে, আমি ঈদুল আজহার দু’রাকাত ওয়াজিব ঈদের নামাজ ছয় তাকবীরের সাথে ইমামের পেছনে আদায় করছি আল্লাহু আকবার। এ বলে হাত বেঁধে নিবেন এবং ছানা সুবহানাকা…পুরো দো’য়াটি পাঠ করে তাকবীর আল্লাহু আকবার বলবেন, প্রত্যেকবার হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ছেড়ে দিবেন এবং প্রত্যেক তাকবীরের পর তিন বার সুবহানাল্লাহ পরিমাণ সময় থাকবে। তৃতীয়বার তাকবীর বলে হাত ছেড়ে দিবেন না বরং দু’হাত পুনরায় বেঁধে নিবেন তারপর ইমাম সাহেব আউযুবিল্লাহ-বিছমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতেহা এবং অন্য একটি সুরা পড়বেন। মুক্তাদিরা ইমামের পিছনে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকবেনন অতপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু, সেজদা করে ২য় রাকাত পড়ার জন্য দাড়াবেন। এই দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম প্রথমে সুরায়ে ফাতেহা এবং অন্য একটি সুরা পড়ার পর উপরিউক্ত নিয়মে ৩ বার তাকবীর বলবেন। প্রত্যেক বার কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিবেনন অতপর ৪র্থ তাকবীর হাত উঠানো ছাড়া বলা অবস্থায় রুকুতে যাবেন। বাকী নামাজের অন্যান্য নিয়ম দৈনিক নামাজের ন্যায় আদায় করবেন।

 

নামাজের জরুরি মাসাইল :

ঈদের নামাজের পর ইমাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবাহ পাঠ করতে হবে। ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা সুন্নাত, কেননা রাসূল (সা.) আজীবন ঈদের নামাজ মাঠে আদায় করেছেন। কারণবশত: কারোও ঈদের জামাত ছুটে গেলে তিনি একা ঈদের নামাজ পড়তে পারবেন না, কারণ ঈদের নামাজের জন্য জামাত শর্ত।আবার কোন ব্যক্তি জামাতে শামিল হওয়ার পর কোনো কারণে নামায ভঙ্গ হয়ে গেলে একা তিনি কাযা পড়তে পারবেন না। ঈদের নামাজ পড়ার স্থানে ঈদের দিন কোন নফল ও বা অন্য কোনো নামাজ পড়া মাকরুহ। আসুন ঈদের তাৎপর্য উপলব্ধি করে যথাযথ আমলের মাধ্যমে কাটানোর চেষ্টা করি। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হোক মুমিন হৃদয়। মহান রবের প্রেমে উৎসর্গ হোক আমাদের কোরবানি। সবাইকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।

 

লেখক: আলেম সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক