ইমরান খানের বক্তৃতার আলোকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভারত নীতি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ০২ ২০১৯, ১৮:৪০

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত {}

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসংঘে একটি ভাষণ দিয়েছেন। চারিদিকে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। উপমহাদেশে তো বটেই, মুসলিম বিশ্বের সচেতন মহলেও দারুণ ইতিবাচক সাড়া পড়ে গেছে।

কেন এরকম সাড়া পড়ে গেল ইমরান খানের এই বক্তৃতার ফলে? কি বলেছেন তিনি? আসুন একটু বিশ্লেষণ করে দেখি।

প্রথমত তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বাৎসরিক সম্মেলনের প্রাইম টাইমটির সদ্ব্যবহার করেছেন। তার বক্তৃতা নিয়ে তিনি আগে থেকেই একটি বিপুল প্রত্যাশা ও আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছিলেন। এরপরে তিনি সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ে তার ভাষণটি দিয়েছেন। ভাষণটি ছিল একদিকে স্বতঃস্ফূর্ত আবার অন্যদিকে পূর্ব প্রস্তুতিতে সাজানো গোছানো। যথার্থ আবেগ, তথ্য, যুক্তিবিন্যাস ও খন্ডনের মিশেলে তিনি একটি ম্যাগনাম ওপাস যেন ডেলিভার করলেন। এমন বক্তৃতা মুসলিম বিশ্বের কোন নেতা নিকট অতীতে আর দিয়েছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।

এই বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি যে চারটি বিষয় তুলে ধরেছেন সেখান থেকে দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। সেই দুটি বিষয় হল ইসলামোফোবিয়া এবং কাশ্মির। ইসলামোফোবিয়া নতুন কোন ফেনোমেনন নয়। সেই ক্রুসেডের সময় থেকেই ইউরোপ ইসলামোফোবিয়া দেখিয়ে আসছে। তবে ৯/১১ এর পরে ইসলামোফোবিয়া ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। ইমরান খান এই নতুন ইসলামোফোবিয়ার উৎপত্তি ও বিকাশের একটি বয়ান তুলে ধরেছেন। যে কথাটি অনেকে বুঝলেও পশ্চিমা অডিয়েন্সের সামনে পরিস্কার করে বলতে পারে না, ইমরান খান সেই কথাটি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাষায় চমৎকার বাগ্মীতার সাথে তুলে ধরেছেন। কথাটি হল এই যে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ ঘটে তার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এসব হল রাজনৈতিক সংঘাতের ফলাফল। এ প্রসঙ্গে তিনি তামিল টাইগারদের ও জাপানীদের আত্মঘাতী হামলার উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে খোলাসা করেছেন। এই ধরণের যুক্তিবিন্যাস ও খন্ডন পশ্চিমা অডিয়েন্সের সামনে এত প্রাঞ্জল ভাষা ও উপস্থাপনায় আর কোন মুসলিম নেতা পরিবেশন করতে পারেন নি। আর এজন্যেই চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠেছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে তিনি এই বক্তৃতার মাধ্যমে একটি গ্লোবাল অডিয়েন্সের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছেন সেটি হল কাশ্মির ইস্যু। কাশ্মির ইস্যুও নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির কাল থেকেই এই ইস্যুর উৎপত্তি। এরপরে বিগত তিরিশ বছর ধরে কাশ্মিরে একটি আজাদীর সংগ্রাম চলছে। ১৯৪৭ সালে পার্টিশনের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত নামক যে নতুন দুটি রাষ্ট্র গড়ে ঊঠেছিল সেই রাষ্ট্র দুটি প্রথম থেকেই কাশ্মির প্রশ্নে সংঘর্ষে জড়িয়ে গেছে। এই ইস্যুতে বেশ কয়েকদফা যুদ্ধও হয়েছে। সম্প্রতি ভারত কাশ্মিরের আইনগত স্বায়ত্বশাসনের বিশেষ অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কাশ্মিরী জনগণকে দুমাস ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এসবের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষের এক বিশেষ উত্থান ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে। একদিকে ভারতে মুসলিম আইডেন্টিটি হুমকীর সম্মুখীন আর অন্যদিকে কাশ্মিরের মুসলিম আজাদীর প্রশ্নকে দলিত করে সেখানে হিন্দু আধিপত্য কায়েম করার পায়তারা চলছে।

উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের আশা ভরসার হেফাজতকারী হিশেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তি। আর এ কারণেই এর অস্তিত্ব ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিকাশের পরিপন্থী। কাজেই ১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত পাকিস্তানকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে আসছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার জন্য সবরকমের সুযোগ কাজে লাগানোই ভারতের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালে একদফা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে ভারত কোন কসুর করেনি। এখনো পাকিস্তানের এথনিক কনফ্লিক্টকে কাজে লাগিয়ে বেলুচিস্তান ও করাচিতে অন্তর্ঘাত চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে স্থবিরতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও ভারতের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলা যায়।

ইমরান খান এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কাশ্মির ইস্যুকে পাকিস্তান ভারত বিরোধের সর্বোচ্চ স্তর হিশেবে উপস্থাপন করেছেন। কাশ্মিরের অবরুদ্ধ জনগণের আজাদীর তামান্নাকে পাকিস্তানের পক্ষে অবহেলা করা যে সম্ভব নয় সেকথা তুলে ধরেছেন। অবরুদ্ধ কাশ্মিরীরা মুক্তির প্রথম সুযোগেই যে এই জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তিনি বারবার বলছেন যে ভারত যেপথে এগুচ্ছে তাতে কাশ্মিরে ভবিষ্যতে “রক্তবন্যা” বয়ে যেতে পারে। এবং এই সংঘাতে পাকিস্তানকে অন্যায়ভাবে জড়ানো হলে পাকিস্তান তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এর মোকাবেলা করতে পিছিয়ে থাকবে না। পাকিস্তানের চাইতে পাঁচ গুণ বড় ভারতের কনভেনশনাল সামরিক বাহিনীর মোকাবেলায় প্রয়োজনে পাকিস্তান তার স্ট্রাটেজিক ও ট্যাকটিকাল এসেট ব্যবহার করতে পিছপা হবে না।

আসলে এই বক্তৃতার মাধ্যমে ইমরান খান ভারত ও তার মিত্র শক্তিগুলিকে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। সেটি হল এই যে একজিস্টেনশিয়াল থ্রেট হিশেবে ভারত যদি পাকিস্তানের উপরে হামলা করে তাহলে পাকিস্তান এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হবে যার ব্যাপ্তি উপমহাদেশের বাইরে চলে যাবে। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।

পাকিস্তান একটি আইডিওলজিকাল রাষ্ট্র হিশেবে হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে লিপ্ত আছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। বেশ কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে এই দুটি এডভার্সারিয়াল এসিমেট্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে। বাংলাদেশ এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের একটি বাই-প্রোডাক্ট হিশেবে বেরিয়ে এসেছে ১৯৭১ সালে। তারপর থেকে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে এখনো দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক অব্যাহত রেখে হার্ড সভরেনটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে; অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্তত একটি রাজনৈতিক শক্তি ভারতবান্ধব থেকে সফট সভরেনটি মেইনটেইন করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের সাধনায় লিপ্ত।

উপমহাদেশের বৃহৎ শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। ইমরান খান ও শেখ হাসিনা যেন এদিক থেকে দুটি বিপরীত মেরুবর্তী প্যারাডাইমের প্রতীক।

ইতিহাসই বলে দেবে কোন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে বেশি সহায়ক হবে। পাকিস্তানের হার্ড প্রতিযোগিতামূলক দ্বান্দ্বিক ভারত বিরোধীতা নাকি বাংলাদেশের সফট সহযোগিতামূলক ভারতবান্ধবতা।